‘কাঠিতে তুলা লাগিয়ে আলতা দিয়ে পোস্টার লিখতাম’

ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি মানে তো বহু আগের কথা। আমার যা বয়স হয়েছে তাতে সেসব দিনের কথা খুব বেশি মনে করতে পারি না। ছয়-সাত দশক পার হয়ে গেছে। সেসব দিনের কথা মনে করা কঠিন। তাই তারিখ ও সালের হিসাবে স্মৃতি কথায় গরমিল হতে পারে। অনেক ব্যক্তির নামও ভুলে গেছি।

১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করি আমি। ভাষা আন্দোলন হয়েছে তার আগে ও পরে- ধীরে ধীরে, দীর্ঘ সময়জুড়ে। কলেজে পড়ার জন্য আমি প্রথমে ঢাকায় এসেছিলাম। জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। পরে আবার যশোর ফিরে যাই। আর আমাদের অঞ্চলের যোগাযোগ তখনো প্রধানত কলকাতার সঙ্গেই ছিল। আমি ঢাকা থেকে ফিরে এসে এমএম কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। যশোরে আমার ভগ্নিপতি শামস-উল-হুদা সাহেবের বাসায় থাকতাম।

এ সময়ে আমাদের প্রভাবিত করেছিলেন স্থানীয় বামপন্থীরা। তাদের সাথে আমাদের ওঠা-বসা শুরু হয়। এরা অধিকাংশই ছিলেন আবদুল হক সাহেবের সহযোগী। অধ্যাপক শরীফ হোসেনের সঙ্গেও আমার যোগাযোগ ছিল। তার মাধ্যমেই জাতীয় রাজনীতির খোঁজ খবর পেতাম আমরা। যশোর থেকেও একটি পত্রিকা প্রকাশ হতো তার মাধ্যমে। হক সাহেবের ছোট ভাই একরামুল হকের কথাও মনে পড়ছে। আমরা একসাথে মিছিলে যেতাম। 

লেখক: ভাষা সৈনিক মো. জাহিদ হোসেন মুসা। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

ঢাকাকেন্দ্রিক ভাষার লড়াইয়ের কিছু ছাপ এই অঞ্চলেও পড়েছিল তখন। সব সংগঠনের কর্মীরা মিলেই তখন এ নিয়ে মিছিল মিটিং করত। আলমগীর সিদ্দিকী, আফছার সিদ্দিকী প্রমুখ তখন খুব সক্রিয় ছিলেন। আলমগীর সিদ্দিকী খুবই ভালো একজন সংগঠক ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ উৎসাহ ছিল এসব কাজে। হক সাহেবদের অতিরিক্ত প্রভাবে কিছুদিন পরই তাদের সব কার্যক্রম গোপনে চলে যায়। তবে আমরা যে সব ছেড়ে দিয়েছিলাম, তা নয়। গোপনেই যোগাযোগ থাকত। কাজও করেছি ওভাবেই।

হক সাহেব ও তার সহযোগীরা স্থানীয়ভাবে বিশেষ উদ্বুদ্ধ করেছেন। আসলে, ১৯৪৬ থেকে ওই অঞ্চলে কমিউনিস্টদের প্রভাব ছিল। তবে জোয়ার বলতে যা বোঝায়, সেটি তখন ছিল মুসলিম লীগের। কয়েকজন কমিউনিস্ট সংগঠক ১৯৪৬ সালের দিকে মায়ের কাছ থেকে আমাদের ঝিনাইদহের বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির অফিস স্থাপন করেছিলেন। তারা এখানে দিন শেষে আলাপ-আলোচনা করতেন। তাদেরই একজন অধীর ধর, আমাকে পড়াতেন। আমি তখন সিক্সে পড়তাম। উনি ছিলেন এমএ পাস। উনারা আমাকে অনেক প্রভাবিত করেছিলেন। তারা ১৯৪৬ সালকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। আমরা শুনতাম, তখন অনেককে ঢাকা থেকে আটক করে যশোরে এনে রাখা হচ্ছে।

ঝিনাইদহে ছাত্র রাজনীতি তখনো খুব একটা গোছাল ছিল না। যশোরেই তা শক্তিশালী ছিল। যশোরে ছাত্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় ও ঝিনাইদহে বাড়ি হওয়ায় মহকুমা শহরে ছাত্রদের সংগঠিত করার মূল দায়িত্ব আমার ওপরই অর্পিত হয়। সে সময় সংগঠনের কাজে যশোর থেকে ঝিনাইদহে আসার লাল সুরকির রাস্তার ক্লান্তিকর ভ্রমণ মোটেও কষ্টের মনে হতো না; বরং এ ভ্রমণটিকে আদর্শের জন্য লড়াইয়ের অংশ ধরে রোমাঞ্চিত হতাম। তবে আমরা সে সময়ে ঝিনাইদহের কিছু উৎসাহী তরুণকে সাথে নিয়ে কাজ করতাম। তাদের মধ্যে টিপু (আনোয়ার জাহিদ), হায়দার, দীপু (নূরে আলম সিদ্দিকী), মঞ্জু, আমীর, টুলু, তোফাজ্জেল, আব্দুল হক- তাদের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। আরো অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে তাদের সঙ্গে নিয়েই সব কাজকর্ম করতাম। সে সময়ে স্কুলপড়ুয়া এক ঝাঁক তরুণের উদ্যোগেই ঝিনাইদহের মতো একটি মফস্বল শহরে ভাষা আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

আমরা হাতে লেখা পোস্টার লাগাতাম। সাড়ে পাঁচ আনা দিয়ে এক শিশি আলতা কিনতাম। কাঠিতে তুলা লগিয়ে সেই আলতা দিয়ে পোস্টার লিখতাম। এমএম কলেজের হোস্টেলে বসেই এসব কাজ করতাম, কারণ অনেক শিক্ষকেরই নীরব সমর্থন ছিল ভাষাকেন্দ্রিক সংগ্রামে। আর এ ধরনের কাজে অল্প যা অর্থকড়ি লাগত, আমরা নিজেরাই তা খরচ করতাম। ছাত্ররা যে যার আগ্রহে আসত মিছিল-মিটিংয়ে। কাউকে জোর করে আনার ব্যাপার ছিল না। আর কোনো ভয়াবহ পুলিশি নিপীড়নও ছিল না। অনেক কাজ আমরা অবাধেই করেছি। হরতালও হয়েছিল, মনে পড়ছে।

আমার বাবা মারা যান, যখন আমার বয়স ১৩ বছর। ফলে রাজনীতির কাজে বাধা দেয়ার মতো কেউ ছিল না। ইচ্ছামতো যা ভালো লেগেছে, তা করেছি। ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে বেশ ভালোভাবে জড়িয়ে যাই। ১৯৪৯-৫০ সালে আমরা ঝিনাইদহে আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে তুলি। আমার মূল উৎসাহদাতা ছিলেন আমার চাচাতো ভাই সিরাজুল ইসলাম। আমরা তাকে ‘মিয়া ভাই’ বলতাম। আমি দলের সেক্রেটারি হই। ঝিনাইদহে আমাদের প্রতিপক্ষের শক্তি তখন মুসলিম লীগ। যশোরে মসিউর রহমান ও খুলনায় খান এ সবুর তখন মুসলিম লীগের বড় নেতা। আর কমিউনিস্টরা কাজ করত গোপনে।

ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালের দিকে মানুষ রাজনীতির বিষয়ে দারুণ আগ্রহী হয়ে ওঠে। এটি ছিল ভাষা আন্দোলনের বড় এক সামাজিক দিক। তবে এ সময়ে ছাত্র রাজনীতিই ছিল রাজনীতির প্রধান দিক। এ সময়ে ভোট এলে মানুষের মাঝে সেখানে খুব উৎসাহ দেখা গেল। মওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী ও শের-ই-বাংলা ফজলুল হক তখন জাতীয় নেতা। আমরা উনাদের সামনে রেখেই এগোতে চেষ্টা করছিলাম।

বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের ওই সময়কার আরো যেসব সংগঠকের নাম মনে পড়ছে তাদের মধ্যে ছিলেন ইমান আলী মাস্টার, হামিদা বেগম, শেখ আমানুল্লাহ, সৈয়দ আফজাল হোসেন প্রমুখ। সৈয়দ আফজাল হোসেন মুসলিম লীগ করলেও ভাষা আন্দোলনে অনেক সক্রিয় ছিলেন। আমানুল্লাহ আমাদের সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৭-৪৮ সালে আমরা ওই পত্রিকা বের করেছিলাম। আরো অনেকে ছিলেন। এ মুহূর্তে সবার নাম মনে করতে পারছি না। 

লেখক: ভাষাসৈনিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //