ভাষা সব সময় সমাজতান্ত্রিক

আমার মনে হয় বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে না সর্বস্তরে। মূলত এর ব্যবহার হচ্ছে না দুটি জায়গায়। ওই দুটো জায়গায় খুব ব্যবহার করার দরকার ছিল। একটা হচ্ছে উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রে ও উচ্চ আদালতে। এই দুটি জায়গায় ব্যবহৃত না হওয়া মানে হচ্ছে যে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার না হওয়ার অন্যতম প্রমাণ। 

যেখানে ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানেও বিকৃতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অর্থাৎ শুদ্ধ বাংলা, মানসম্মত বাংলার ব্যবহার হচ্ছে না। যেমন ধরা যাক, সংসদে যে বাংলা ব্যবহৃত হয়, সেটি সব দেশেই একটি মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে। ভাষার ব্যবহারে, ভাষার প্রয়োগে, শব্দ ব্যবহারে, উপমা ব্যবহারে, উচ্চারণে। 

এই থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আমরা যাদের কাছ থেকে ভাষা শিখেছি ঔপনিবেশিক আমলে, সেই ইংরেজদের যে পার্লামেন্ট, সেখানে তাদের যে বক্তৃতা হতো, সে বক্তৃতাটি কিন্তু অত্যন্ত উন্নতমানের সাহিত্য হয়ে যেত। অনেকের বক্তৃতা লিখিত আকারে আছে। ওটা সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলত। এই ধরনের ভাষা ব্যবহার করা উচিত; কিন্তু আমরা সংসদে যে বাংলা পাচ্ছি, সেটি নিম্নমানের বাংলা; এবং সেখান থেকে অনুকরণীয় কোনো আদর্শ নেই। বরঞ্চ, ওটিরই একটি প্রভাব পড়ছে যারা শ্রোতা, দর্শক- তাদের ওপর। 

আগে যখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বক্তৃতা হতো, তখন তো সেটি প্রকাশ পেত না এ রকম। এখন তো এটি প্রচার পায় গণমাধ্যমে। ফলে এই মাধ্যম যে ভাষাটিকে নিয়ে আসছে সংসদ থেকে, সেটি মোটেই দৃষ্টান্ত নয়, আদর্শ নয় এবং অনুকরণীয় নয়, বরং পরিত্যাজ্য। আর গণমাধ্যম নিজেও ভাষাকে বিকৃত করছে। যেটি আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যেই আছে। যেমন- এফএম রেডিও, সরকার পরিচালিত রেডিও, টেলিভিশন, নাটকের সংলাপে বিকৃত ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার এফএম রেডিওতে তো বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে, যার প্রভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে পড়ছে। আবার দেখা যাচ্ছে যে, যারা সমাজের বিত্তবান মানুষ তাদের জীবনে বাংলার ব্যবহার আরও সংকুচিত হচ্ছে। তারা যখন বাংলা ব্যবহার করে, তখন তারা আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট থাকে, উচ্চারণ বিকৃতি ঘটে; সর্বোপরি ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে এক ধরনের ভাষা ব্যবহার করে। তো তাদের কাছ থেকেও শেখার কিছু নেই।

এখন যেটি দাঁড়াচ্ছে যে, তাহলে এ বিষয়টি কেন ঘটল। আমরা তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছি। আমরা তো বলি, ভাষার একটি জাতীয়তাবাদ আছে। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে ধর্মভিত্তিক চেতনা প্রত্যাখ্যান করে একটি দীর্ঘ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তাহলে কেন এমন হলো? এর কারণটি কী? এর কারণটি হচ্ছে, আমাদের যারা শাসক শ্রেণি তারা আত্মসমর্পণ করেছে। এখন প্রশ্ন হলো, কার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে? আত্মসমর্পণ করেছে পুঁজিবাদের কাছে। পুঁজিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার অর্থ হচ্ছে দুটি। এক. পুঁজিবাদের ভাষা হচ্ছে ইংরেজি; একে পুঁজিবাদের মাতৃভাষা কিংবা রাষ্ট্রভাষাও বলতে পারি। কাজেই রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রেরও আত্মসমর্পণ ঘটল। এই আত্মসমর্পণের কারণে ইংরেজি তার আগের আধিপত্য তো বজায় রেখেছেই; বরং আধিপত্য আজকে আরো বেড়েছে। 

এটি আমরা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতে পারি যে, ব্রিটিশ আমলে ইংরেজি তো ছিল রাষ্ট্রের ভাষা, শাসকদের ভাষা; কিন্তু সেখানে বাংলা ভাষার আশ্চর্য রকমের সমৃদ্ধি ও বিকাশ ঘটেছে। চর্চা হয়েছে। আমাদের বড় সাহিত্যকরা তখনই বেরিয়ে এসেছেন। বাংলা গদ্যের যে প্রচলন তখন ওই রকমভাবেই ঘটল। অর্থাৎ তখন ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে মধ্যবিত্ত গড়ে উঠেছে, তারা একটা প্রতিবাদ করেছে। তারা আত্মসমর্পণ করেননি। এই প্রতিবাদটিই প্রতিফলিত হচ্ছে বাংলা ভাষা ব্যবহারের মধ্য দিয়ে এবং বাংলার উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে। কাজেই যখন যারা নেতৃত্বে থাকেন, তারা যখন আত্মসমর্পণ করে, তখন এর প্রতিক্রিয়া ভাষার মধ্যেই ঘটে। ভাষার আর চর্চা হয় না। বাঙালি মুসলমানের জন্য একটি বড় সমস্যা ছিল যে, তারা আবার আত্মসমর্পণ করেছিল তাদের অতীত ইতিহাসের কাছে। তাদের পুরনো ধারণার কাছে যে তারা কেউ কেউ মনে করত, তাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, উর্দু- যা টেকেনি।

বাংলা সব সময় জনগণের ভাষা। ভাষা যখন মধ্যবিত্ত জনগণের সঙ্গে যুক্ত ছিল, তখন বাংলা ভাষার প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল। বাংলা ভাষা তাদের অবলম্ব^ন হিসেবে ছিল; কিন্তু যখন এই মধ্যবিত্ত থেকে একটা অংশ উচ্চবিত্তে পরিণত হয়েছে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা, অর্থনীতি, সবই উচ্চবিত্তদের হাতে চলে গেছে। এই উচ্চবিত্তরা কখনোই বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষক ছিল না। কিংবা বাংলা ভাষার প্রতি তাদের আগ্রহ ছিল না। তারা ইংরেজদের সহযোগিতা করেছে। পাকিস্তান আমলেও যে আন্দোলনটি হলো, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ওটা মধ্যবিত্তের আন্দোলন। কেননা তখন বাঙালি মধ্যবিত্ত গড়ে উঠছিল। গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় এই ভাষাকে তার কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ করেছিল। কাজেই ভাষা আন্দোলন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। যদিও এটি ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও বটে। মূল বিষয়টি হচ্ছে রাজনৈতিক।

এই যে পাঞ্জাবিরা আমাদের মাতৃভাষা উর্দু না হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছিল, মধ্যবিত্ত তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছিল। ওই মধ্যবিত্তের একাংশ এখন উচ্চবিত্ত হয়ে গেছে ও তাদের পুঁজিবাদের সাথে, সাম্রাজ্যবাদের সাথে সম্পর্ক হয়ে গেছে। এই সম্পর্কের কারণে তারা এখন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। মধ্যবিত্ত এখন আর মধ্যবিত্ত নেই। তাদের কিছু অংশ এখন উচ্চবিত্ত ও বেশির ভাগ অংশ এখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত। ফলে তারাই এখন বাংলাকে রক্ষা করছে ও তাদের জীবনেই বাংলা আছে। উচ্চবিত্তদের জীবনে এখন বাংলার চেয়ে ইংরেজি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, তারা সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত। এ কারণে তারা বিদেশমুখী হয়ে পড়েছে। তাদের দেশপ্রেমও কমে গেছে। তাদের মধ্যে এই ধারণাও তৈরি হয়েছে যে বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কাজেই তারা তাদের সম্পদ, যা আছে, পাচার করছে। বাড়ি-ঘর বিদেশে তৈরি করছেন। প্রত্যেক উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যেই দেখা যাবে যে, তাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে আছে। একাংশ বিদেশে আছে হয়তো আর অল্প অংশ এখানে আছে। ফলে তাদের জীবনে আর বাংলা থাকছে না। কাজেই তাদের কাছ থেকে তো আর কিছুই আশা করা যায় না। 

মধ্যবিত্ত আছে, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার, জনসাধারণ আছে। ফলে বাংলা ভাষার প্রচলনের যে সমস্যা, সেটি তো রাজনৈতিক সমস্যা এখনো। কাজেই আমরা রাজনৈতিকভাবে এই রাষ্ট্রকে জনগণের রাষ্ট্রে পরিণত করতে না পারি, তবে বাংলা সর্বত্র প্রচলিত হবে না।

উচ্চশিক্ষায় কেন হলো না বাংলার ব্যবহার? কারণ ওই পরিমাণে একটি বই আমরা লিখতে পারলাম না। পাঠ্য বই বা সহযোগী বই অনুবাদ করতে পারলাম না। যারা উচ্চবিত্ত, তাদের ছেলেমেয়েরা বাংলা মাধ্যমে পড়ছে না। সেজন্য বাংলা যে শিক্ষার মাধ্যম সর্বস্তরে সেই রাষ্ট্রীয় আগ্রহ কিংবা আন্দোলন নেই। রাষ্ট্রীয় আন্দোলন মানেই হচ্ছে রাজনীতির আন্দোলন। উচ্চ আদালতে কেন হচ্ছে না? এটি ধারাবাহিকভাবে ব্রিটিশ আমলেরই আইন-কানুন সব চলছে। আইনের বইও ওইভাবে লিখিত। যারা আইনজীবী তারা ওইভাবে অভ্যস্ত, বিচারকরাও ওইভাবে রায় লিখতে অভ্যস্ত। এটি এক অদ্ভুত পরিস্থিতি, যেখানে বাদী-বিবাদী, আইন-বিধি, বিচারক- সবাই বাঙালি; কিন্তু ভাষাটি ইংরেজি। আমরা ওই ব্যবস্থাটিকে ভাঙতে পারিনি। 

মূল সমস্যাটি হচ্ছে, এই যে আমাদের রাষ্ট্র রাজনৈতিকভাবে একটি স্বাধীনতা পেয়েছে; কিন্তু রাষ্ট্রের চরিত্রের পরিবর্তন হয়নি। সমাজে কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজের যদি পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রকে পরিবর্তন করতে হবে। এই পরিবর্তন চরিত্রগতভাবে, আয়তনগতভাবে না।

আয়তনগতভাবে রাষ্ট্র ক্ষুদ্র হয়েছে; কিন্তু চরিত্রগতভাবে বদলায়নি। চরিত্রগতভাবে পরিবর্তন না হওয়ায় নানা রকম দুর্ভোগ দেখছি। যেমন- অর্থনৈতিকভাবে এগোতে পারছি না। বৈষম্য বাড়ছে। সেই বৈষম্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে। সেই জায়গাটিতে আগের বৈষম্য আছে; কিন্তু এর সাথে বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার মানে রাষ্ট্র আগের মতোই রয়ে গেছে। ফলে এই রাষ্ট্রকে যদি আমরা বদলাতে না পারি, তাহলে ভাষার প্রচলন হবে না। 

আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে কথা বলবো বা ক্ষোভ প্রকাশ করবো বা আমরা দু-চারটি প্রবন্ধ লিখব, এর দ্বারা হবে না। এটি হচ্ছে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি বাংলাদেশ স্বাধীন না হলে হতো না। পাকিস্তান আমলে যে গোঁজামিলটা দেয়া হয়েছিল, সেটি হলো উর্দু ও বাংলা দুটিই রাষ্ট্রভাষা হবে- তা আমরা মানিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে। স্বভাবতই এটি স্বীকৃত যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। এটি না হলে, যদি আমরা রাষ্ট্রকে ভাঙতে না পারতাম, তাহলে আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পেতাম না। কিন্তু রাষ্ট্রের শুধু চরিত্র নয়, কাঠামোও আগের মতো রয়ে গেছে। আগের আইন, বিচারব্যবস্থা, প্রসাশনব্যবস্থা, আগের বিভিন্ন বাহিনী- সবই একই ধারাবাহিকতায় রয়ে গেছে; শুধু নামের পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রের যে শোষণমূলক চরিত্র, অর্থাৎ রাষ্ট্র বৈষম্যকে তুষ্ট করে।

বর্তমান সময়ে রাষ্ট্র আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদের সাথে বেশি যুক্ত। আর সাম্রাজ্যবাদের ভাষা কখনোই বাংলা না। তাই পৃথিবীব্যাপী ২৫-২৬ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলছে; কিন্তু তারা বড় অসহায় হয়ে আছে। কেননা তাদের যে ভরসার জায়গাটি হচ্ছে বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশই এখন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় হয়ে গেছে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে সাম্রাজ্যবাদের পরিধি, ব্যাপ্তি, প্রভাব অনেক বেশি। যদিও আগে ঔপনিবেশিকরা এখানে বসেই ছিল ও সাম্রাজ্যবাদীদের যে প্রতিযোগিতা এখানে আধিপত্য বিস্তারে, সেটি আমাদের রাজনীতির ওপর প্রভাব ফেলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বিদেশিদের হাতে, কাজেই আমরা একটি বাজারে পরিণত হয়েছি। আমাদের সেবা খাত, সেবা খাত মানে কোম্পানির চাকরি, ব্যাংকের চাকরি, করপোরেট হাউসে চাকরি- এগুলো লোভনীয়। যেজন্য বিবিএ, কম্পিউটার সায়েন্স অনেক দামি দর্শন বা সাহিত্যের তুলনায়। বাংলা পড়তে গেলে ছেলেমেয়েরা কেঁদে ফেলে। তারা বলে, বাংলা তো বাড়িতেই পড়তে পারবো। এ রকম পরিস্থিতির যদি পরিবর্তন না করতে পারি, তাহলে আমরা কোনো রকম সংশোধনের মাধ্যমে এটি করতে পারব না। একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন দরকার। এর জন্য সমাজ বিপ্লবের প্রয়োজন হবে। 

ব্রিটিশ শাসনের আগে আমাদের একটি সমাজ ছিল। সেখানে গ্রামগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। সেই সমাজটিকে ব্রিটিশ তার বাণিজ্যিক প্রয়োজনে, প্রশাসনিক প্রয়োজনে ও শোষণের প্রয়োজনে একটি জায়গায় এনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে লর্ড কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে। এর ফলে জমিদারি ব্যবস্থা উঠে গেছে; কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত রয়ে গেছে। এতে কিছুসংখ্যক লোক প্রভুর মতো থাকবে, আর বাকি লোকরা তার অধীনে থাকবে। ফলে দুই ভাগ হয়ে গেছে জমিদার ও প্রজা। বেশির ভাগ মানুষই তো কৃষক ছিল। উচ্চবিত্তের যে বিলাস-বৈভব তার সাথে নিম্নমধ্যবিত্তের কোনো রকমের মিল নেই। এই যে বিভাজনটি, এটি ভাষার ক্ষেত্রে হচ্ছে। সমাজের উচ্চ অংশে বাংলার বিকৃত ব্যবহার আর নিম্ন অংশের ব্যবহারের সে সুযোগ নেই। ব্যবহারের সীমিত সুযোগ ও তারা হীনম্মন্যতায় ভোগে। তাদের পরাজিতের মনোভাব যে তারা পরাজিত হয়ে গেছে। এত যুদ্ধ হলো, সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হলো; কিন্তু ব্রিটিশ যেদিন ধরে এসেছে, সেদিন থেকেই ওই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আর ওই ব্যবস্থাটি ভাঙলো না এখনো। 

পরাজিতের মনোভাব এসে গেছে আমাদের মধ্যবিত্তের মধ্যে, যে আমরা তো পারব না, আমাদের এগোতে হলে ব্যক্তিগতভাবে এগোতে হবে, আমাকে মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। সমষ্টিগত মুক্তি সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তিগত মুক্তি আর সমষ্টিগত মুক্তির মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়ে গেছে। আমি যদি ব্যক্তিগতভাবে মুক্তি চাই, তাহলে আমাকে ইংরেজি ভাষা শিখতে হবে। 

আমাদের লক্ষ্য থাকবে সামাজিক পরিবর্তনের। কারা আনবে? আনবে তারাই, যারা দেশপ্রেমিক ও যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধটি এখানে জরুরি। কেবল দেশপ্রেম দিয়ে হবে না। দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে যারা উদীপ্ত, তারা জনগণের সাথে মিশে যে শক্তি তৈরি হবে, সেই শক্তি পারে সমাজে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে ও রাষ্ট্রকে বদলে দিতে। রাষ্ট্র কিন্তু বাধা দেবে। রাষ্ট্র তো স্বার্থ দেখছে। রাষ্ট্র যে কোনো মুক্তির আন্দোলনকেই বাধা দেয়। এই মুক্তির আন্দোলনকে অবশ্যই বাধা দেবে। কেননা রাষ্ট্রের যারা শাসক, তাদের বিরুদ্ধেই এ আন্দোলন। কাজেই রাষ্ট্রকে বদল করতে হলে এই বিরাট, বিপুল যে শক্তি, সে শক্তিকে সংগঠিত করতে হবে রাজনৈতিকভাবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই এই বিজয় অর্জন করতে হবে। আমি বলবো, মুক্তির যে আন্দোলন চলছিল, এটি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে শেষ হয়ে যায়নি। এটির একটি মাত্র স্তর আমরা অতিক্রম করেছি। আমরা ব্রিটিশকে সরিয়েছি, পাকিস্তানকে সরিয়েছি ও আমরা এই প্রথম মনে করলাম, নিজেরা নিজেদের শাসক হয়েছি। আগে তো বিদেশিরা শাসন করত, এখন বাঙালিরাই শাসন করছে। আজ আমরা ভাষার প্রচলনের কথা বলছি, ভাষার যে বিস্তৃত ব্যবহার, যথার্থ ব্যবহার এ কথা যখন বলছি, তখন আমরা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলছি। 

যাদের আমি দেশপ্রেমিক ও সমাজতান্ত্রিক বলছি, তাদের সমাজতান্ত্রিক হতে হবে। কারণ ভাষা সব সময় সমাজতান্ত্রিক। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। কাজেই সমাজতান্ত্রিক ধারাটিকে আমাদের শক্তিশালী করতে হবে, বেগবান করতে হবে। আমাদের ভাষার মুক্তি ও মানুষের মুক্তি অবিচ্ছেদ্য।

মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়েই আমরা ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে পারব। না হলে ভাষা তো ব্যক্তিগত চর্চার মধ্য দিয়ে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। যেমন- একটা বক্তৃতা বা একটা বই লেখার মধ্য দিয়ে আমরা এই মুক্তি আনতে পারব না। সেই মুক্তির আলোকে রাষ্ট্র আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। 

আর প্রত্যাশা যদি পূরণ করত, তাহলে বাংলাই সর্বস্তরে প্রচলিত হতো এবং বাংলা আন্তর্জাতিক মানের ভাষায় পরিণত হতো। আমরা বাংলায় বই লিখতাম, আমরা বাংলায় চর্চা করতাম। অন্যরাও বাংলা ভাষা বিষয়ে আগ্রহী হতো। কেন আগ্রহী হতো? তারা দেখত যে এই ভাষার মধ্যে জ্ঞান আছে, দ্বিতীয় দেখত যে যারা এখানে আছে, এই রাষ্ট্রে, তারা একটি উন্নত স্তরে চলে গেছে অর্থাৎ অর্থনৈতিক শক্তিতে। যেমন চীন এখন অর্থনৈতিক শক্তিতে উন্নত। কারণ মানুষ চীনা ভাষা শিখছে এখন। বিশ্বব্যাপী একটি আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করা মানে হচ্ছে আমাদের নিজেদের সমৃদ্ধ করা। আমরা নিজেদের সমৃদ্ধ না করলে ভাষা শুদ্ধ হবে না। অন্যের আগ্রহও তৈরি হবে না। আমরা সম্মানজনক জায়গায় পৌঁছতেও পারব না। আজকে বিশ্বের মধ্যে ঢাকা হচ্ছে নিকৃষ্টতম শহর। 

একটা নিকৃষ্টতম শহরের যে ভাষা, সে ভাষা যতজনেরই ভাষা হোক, সে ভাষা কেমন করে একটা আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছবে? আন্তর্জাতিক আগ্রহ সৃষ্টি করবে বা সম্মান পাবে? আমরা ভাষার দুর্দশা বা ভাষার দারিদ্র্য বা ভাষার অপ্রচলন যা-ই বলি না কেন, এটি হচ্ছে আমাদেরই ব্যর্থতার একটি প্রতিফলন। আমাদের পশ্চাৎপদতারই একটি দলিল বলা যায়। কারণ আমরা আমাদের মুক্তি ঘটাতে পারিনি, সমষ্টিগত মুক্তি। ব্যক্তিগত মুক্তিটিকে আমরা প্রধান করে তুলেছি। ফলে ব্যক্তিগত মুক্তির আঘাতে বা ব্যক্তিগত মুক্তির যে তৎপরতা, সেটি সমষ্টিগত যে মুক্তির স্বপ্ন, সেটি নানাভাবে লাঞ্ছিত, বিপর্যস্ত হচ্ছে। আর তার জন্যই আমরা যে ব্যক্তির মুক্তির কথা ভাবছি, সেটি কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী; কিন্তু সমষ্টিগত মুক্তি সমাজতান্ত্রিক। 

তাই আমি বলেছি যে, ভাষা হলো সমাজতান্ত্রিক। কেননা ভাষা শ্রেণি, ভাষা, ধর্ম, মানে না এবং ভাষা বর্ণ মানে না। একটি জনগোষ্ঠীর ভাষা মানে হচ্ছে সর্বজনীন এবং সবারই অধিকার আছে; কিন্তু এই অধিকারটি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার কারণে। কাজেই সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমেই আমরা আমাদের মুক্তির দিকে এগোতে পারব। ভাষার মুক্তি ও জনগণের মুক্তি অবিচ্ছেদ্য।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //