ক্ষমতা, দুর্নীতি এবং হাল রাজনীতির গতিমুখ

সাম্প্রতিক সময়ে নানা ঘটনায় রাজনীতির মাঠে নতুন উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে; বিরোধ-বিভাজন আর প্রতিহিংসার রাজনীতিও নতুন করে আবার চাঙ্গা হয়েছে। যখন দরকার ছিল গত ক’বছর ধরে ঘনীভূত হওয়া রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে আন্তরিক উদ্যোগ নেয়া, তখন সে ব্যাপারে যত্ন ও মনযোগের পরিবর্তে এমন সব ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে- যাতে রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাসের পরিবর্তে বিরোধ বৈরিতা আরো প্রকট ও বিস্তৃত হয়েছে। 

অনাকাক্ষিত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে; আরো সহিংসতার আশঙ্কা বাড়ছে। দেশ পরিচালনায় সরকারের রাজনৈতিক ও নৈতিক জোর না থাকার সুযোগ গ্রহণ করছে দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, মাফিয়া গোষ্ঠীসহ কায়েমি স্বার্থান্বেষী নানা মহল। এই অবস্থায় দেশ ও দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ দ্রুতই আরো অনিশ্চিত ও অন্ধকার পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে।

গণতন্ত্রের সূচকে শোচনীয় নিম্নগামিতার মধ্যে চার ধাপ অগ্রগতির কথা বলা গেলেও গেল বছর দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের আরো আধাগতির কথা প্রকাশ করা হয়েছে। এসব তথ্যে সরকারের কোনো বিকার নেই; দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের লাগাম টেনে ধরার ব্যাপারেও দৃষ্টিগ্রাহ্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বরং অতীতের সরকারসমূহের ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি এখন নীতিতে পরিগণিত হয়েছে। বিদ্যমান শাসনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে; ক্ষমতা আর আধিপত্যকে যেন দুর্নীতির সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। 

১ ফেব্রুয়ারি কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক টেলিভিশন মাধ্যমে তাদের সম্প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ শীর্ষক ভিডিও প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মাফিয়া সন্ত্রাসীনির্ভর দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এই রিপোর্ট যে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ ও দেশের সরকারের সম্মানহানি ঘটিয়েছে, বদনাম রটিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই; এই প্রতিবেদন যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তাও না বোঝার কারণ নেই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্রবাহিনীর পক্ষে এই প্রতিবেদনকে নাকচ করে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সমালোচনা করা হয়েছে; কিন্তু প্রতিবেদনের জবাবে যেসব প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির জন্ম হয়েছে এখনো তার নিরসন হয়নি।

এসব বিষয়ে এখনো পর্যন্ত সরকারি তরফ থেকে তথ্যভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা আসেনি। সরকারের দিক থেকে এ সম্পর্কে যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা না থাকলে আলজাজিরার ‘অসৎ উদ্দেশ্যের’ কথা বলে জনগণের জিজ্ঞাসা ও কৌতূহল দূর করা যাবে না। বাংলাদেশে আলজাজিরার সম্প্রচার বন্ধ করেও উত্থাপিত প্রশ্নসমূহ থেকে দায়মুক্তি ঘটবে না। গোটা বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বেতপত্র প্রকাশের মাধ্যমে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারে। তা না হলে আলজাজিরা উত্থাপিত অভিযোগসমূহ জনসম্মুখে আরো জায়গা করে নেবে।

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মতো দেশসমূহে ক্ষমতা ও দুর্নীতি হাত ধরাধরি করেই চলে, তারা যেন হরিহর আত্মা। এখানে যিনি যত ক্ষমতাবান তার দুর্নীতি করার সুযোগও তত বেশি। এখানে এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা অনেকখানি একীভূত। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার এই যুগলবন্দি এখানে দুর্নীতি আর দুর্বৃত্তায়নের ছোট বড় অসংখ্য সিন্ডিকেট তৈরি করেছে। এরা এক রাষ্ট্রের মধ্যে যেন অসংখ্য ছোট ছোট রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। দুর্নীতি আর সুবিধাভোগের প্রশ্নে এদের মধ্যে এক ধরনের অশুভ আঁতাতও গড়ে উঠেছে। দেশ থেকে অর্থ পাচারেও এরা এগিয়ে। কিছুদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থ পাচারে আমলাদের এগিয়ে থাকার কথা জানিয়েছিলেন। 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে মাঝে মধ্যে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালিত হলেও দুর্বল রাজনৈতিক কর্তৃত্ব, সদিচ্ছার ঘাটতির কারণে দুর্নীতির এসব সিন্ডিকেট, মাফিয়াতন্ত্রের বিরুদ্ধে কার্যকর ও ধারাবাহিক কোনো ব্যবস্থা নেই; বিদ্যমান ব্যবস্থায় তা সম্ভবও নয়। কারণ গোটা ব্যবস্থার ওপরই লুটেরা ধনিক শ্রেণি ও তাদের মধ্যকার নানা গোষ্ঠী ও পরিবারের রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্তমান ও সাবেক মেয়রের মধ্যকার দুর্নীতির পাশাপাশি অভিযোগ অনেক কৌতুহলের জন্ম দিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। বলা চলে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ এটি চলতে থাকলে, হয়তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ত। ক্ষমতাধর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এই ঝুঁকি কেন নেবেন। এসব ঘটনাবলি সরকারের জন্য বিব্রতকর, সন্দেহ নেই। সরকারের ভাবমূর্তিতেও টান পড়ছে। সরকার ও সরকারি দলের প্রতিক্রিয়া থেকেও তাদের অস্থিরতা বোঝা যাচ্ছে। সরকারও পাল্টা বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ ধরে রাখতে তৎপর রয়েছে।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ‘জেড ফোর্সের’ প্রধান জিয়াউর রহমানের ‘বীরউত্তম’ খেতাব কেড়ে নেবার সিদ্ধান্ত দেশবাসীর মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু ঘুরিয়ে দিয়ে বিএনপিকে এর বিরোধীতায় ব্যস্ত রাখার কৌশলী পদক্ষেপ কিনা এই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পর রাজনৈতিক বিবেচনায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খেতাব বাতিলের পদক্ষেপ যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ তা নিয়েও সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে যদি বীরউত্তমসহ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের স্বীকৃতির প্রতীক খেতাব বা পদক বাতিল করতে হয়; তবে তা অনেক অপ্রয়োজনীয় ও বিব্রতকর বিতর্কেরও জন্ম দেবে। আর গণেশ উল্টে গেলে তো তা অনেকের জন্য আত্মঘাতীও হতে পারে। বস্তুত এই ধরনের তৎপরতা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব ও মর্যাদাকেই খাটো করছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশকে আজ যখন স্বাধীনতার ঘোষণা ও ’৭২-এর সংবিধানের তার মূলনীতির বিপরীতে ঠেলে দিয়ে পাকিস্তানি জমানার মতো এক দেশে দুই সমাজ এবং দুই অর্থনীতি কায়েম করা হয়েছে, তখন খেতাব আর পদক বাতিলের রাজনীতির আড়ালে মুক্তিযুদ্ধের মৌন চেতনাকে যে তিমির থেকে আরও তিমিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাতে আর দ্বিমতের অবকাশ কোথায়!

এসব তৎপরতার আশু রাজনৈতিক তাৎপর্যও যথেষ্ট বিপজ্জনক। এসব পদক্ষেপ দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিভেদ-বিভাজন আরও বাড়িয়ে তুলছে। সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে বিরোধ-বৈরিতা আরও উসকিয়ে দেবে, যা দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট কেবল ঘনীভূতই করতে পারে। বেশ ক’বছর ধরে চলে আসা রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে যখন সরকারি তরফে সরকার ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণকে আস্থায় নিয়ে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাসহ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করা।

নির্বাচনকেন্দ্রিক সংকট সমাধানে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার গঠনে অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা, তখন সরকার আবার উল্টোমুখী যাত্রা শুরু করেছে। সরকারের এই উল্টোমুখী যাত্রায় সংলাপ-সমঝোতার পথ যদি আবারো বন্ধ হয়ে যায়; ভোটের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ যদি এবারও রুদ্ধ থাকে তা কি ধরনের পরিণতি ডেকে আনে বাংলাদেশসহ সমসাময়িক দুনিয়াতেও তার অসংখ্য ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই ধরনের অভিজ্ঞতাই রয়েছে। শাসকদের এই ধরনের চরম কর্তৃত্ববাদী বেপরোয়া মনভাবে একদিকে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের অনাকাক্ষিত নানামুখী তৎপরতা বাড়তে থাকে। আর অন্যদিকে চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট শক্তির রাজনৈতিক উত্থানের জমিন উর্বর হতে থাকে।

এর বাইরে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জনগণের সামনে পথ বিকল্প কি? ইতিহাসের সাক্ষ্য হচ্ছে শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক দমনমূলক তৎপরতাই পরোক্ষভাবে জনগণের কর্তব্য, তাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধরন ঠিক করে দেয়। শাসকরা যদি দমন ও বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতো, তখন আত্মরক্ষায় জণগণের সম্মিলিত ইচ্ছার প্রকাশ হিসেবে গণপ্রতিরোধ গণজাগরণের কোন বিকল্প থাকে না। তবে আশা করতে দোষ কি? জনগণের সম্মিলিত ই্ছা আর আকাক্সক্ষার মুখে শেষ পর্যন্ত সরকার ইতিহাসের পাঠ নিতে পারবে; শুভ বুদ্ধির পরিচয় দেবে; শেষ অবধি তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্যও গণতান্ত্রিক ধারায় হাঁটবে।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী, ওয়ার্কার্স পার্টি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //