সোনালি আঁশের সোনালি অতীত ও দিশাহীন ভবিষ্যৎ

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)

বাংলাদেশে ১৯৭১ স্বাধীনতা যুদ্ধ অবধি ৭৭টি পাটকল স্থাপিত হয়েছিল। এর মধ্যে এশিয়ার সর্র্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিল অন্যতম। এর মধ্যে ৫২টি পাটকলের মালিকই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি শিল্পপতি। 

যুদ্ধের পর পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার ‘বাংলাদেশ জুট বোর্ড’ গঠন করে। বাংলাদেশ সরকার নবগঠিত জুট বোর্ডকে পরিত্যক্ত মিলগুলোকে অধিগ্রহণ করতে আদেশ দেয়। জুট বোর্ড মিলগুলোর জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেয়। রাজনৈতিক যোগাযোগ ও দলীয় আনুগত্যের যোগ্যতায় এদের নিয়োগ দেয়া হলেও এরা ছিলেন মূলত অযোগ্য ও অকর্মণ্য। শিল্পজাত কল-কারখানা চালানোর কোনো যোগ্যতা তাদের ছিল না। 

এক নৈরাজ্যকর অবস্থায় ১৯৭২ সালে সংবিধানে সমাজতন্ত্রের ধারা সন্নিবেশিত হলে সরকার অন্যান্য সব শিল্প কল-কারখানার ন্যায় পাটকলগুলো অধিগ্রহণপূর্বক জাতীয়করণ করে। জাতীয়করণকৃত পাটকলগুলোকে নবগঠিত বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে ন্যস্ত করা হয়। বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন দেশের অভ্যন্তরে পাট ক্রয়, বিক্রয় ও দর নির্ধারণের দায়িত্ব পায়। ১৯৭০ সালে পাটের উচ্চমূল্য, টাকার অবমূল্যায়ন ও পাটকলগুলোতে প্রচণ্ড দুর্নীতির ফলে বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন বিপুল লোকসান দিয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ সালে সরকার ‘পাট বিভাগ’ খোলে ও উক্ত বিভাগকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে। 

সম্পর্কহীন একটি বিভাগকে ভিন্নধর্মী একটি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার পদক্ষেপ সরকারের অপরিপক্বতা ও অপরিণামদর্শিতার পরিচয় বহন করে। পরবর্তীতে সরকার তার ভুল বুঝতে পেরে ১৯৭৬ সালে পাট বিভাগকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে এনে পাট মন্ত্রণালয়ে উন্নীত করে। পাশাপাশি সরকার পাটবিষয়ক একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করে। সেই কমিটি ১৯৭৯ সালে জাতীয়করণকৃত পাটকলগুলোকে ব্যক্তি খাতে দিয়ে দেয়ার সুপারিশ করে। এর মধ্য দিয়ে সরকারি ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নব্য ধনিক শ্রেণি তাদের অভিলাষ পূরণের আরো একটি সুযোগ পেয়ে যায়। 

অথচ এই কমিটি জাতীয়করণকৃত পাটকলগুলোর সমস্যা ও সংকট তুলে ধরে জাতীয়করণের সংকট সমাধানের সুপারিশ গ্রহণ করতে পারত! সরকারও যেন এ ধরনের সুপারিশ হাতে পাওয়ার জন্য বসেই ছিল। এরপর পরেই ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে তিনটি পাটকল মূল মালিকদের ফেরত দিয়ে দেয়া হয়  ও দুইটি পাটকলকে ব্যক্তি খাতে দিয়ে দেয়া হয়। 

১৯৮০ সালে সরকার পাটকলগুলোকে একটি বিশেষ সহায়ক তহবিল ও রফতানি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিশেষ প্রণোদনা তহবিল প্রদান করে। অব্যাহত ক্ষতির চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে বিশেষ রফতানি প্রণোদনাও ঘোষণা করা হয়। একইভাবে ১৯৮২ সালে সরকার আরো ৩৫টি পাটকল এগুলোর মূল মালিকদের ফেরত দেয়।

পাটের সঠিক অবস্থা, বাজার দর, পাটশিল্পের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরতে বিশ্বব্যাংক ১৯৯০ সালে একটি খ্যাতিসম্পন্ন আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের অনুমোদন দেয়। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যে তথ্য দেয়, তাতে দেখা যায় যে, স্থানীয় ব্যাংকের নিকট পাটকলগুলোর মোট ২০.৭৫ বিলিয়ন টাকার দায়বদ্ধতা আছে। এছাড়াও প্রায় ১৩ বিলিয়ন টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর কাছে ও বাকি টাকা ব্যক্তিখাতের পাটকলগুলোর কাছে দায়বদ্ধতা ছিল। বিশ্ব ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে পাটকলগুলোর উৎপাদন কমানো ও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলকে ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেবার সুপারিশ করা হয়। উপরোক্ত সুপারিশসহ আরো কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ঋণের প্রস্তাব দেয়। এ যেন গাধার নাকের ডগায় মূলো ঝুলিয়ে দেয়া! 

বাংলাদেশ সরকার যথারীতি চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয় এবং বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে তাদের শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা প্রদান করে। 

এ পদক্ষেপে পাটকলগুলোর আর্থিক ক্ষতি যেমন হ্রাস পায়নি, তেমনি এগুলোকে লাভজনক করে গড়ে তুলতেও পারা যায়নি। ব্যক্তিখাতের পাটকলগুলোও লাভ করে উঠতে পারছিল না বরং এর মধ্যে ব্যক্তি খাতের দুইটি পাটকল বন্ধও হয়ে গেল। সংকট সমাধান না করে কীভাবে উঠতি ধনিক শ্রেণির সুবিধা করে দেয়া যাবে, এ নিয়েই যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল কর্তৃপক্ষ। ২০০২ সালে সরকার এতদাঞ্চলের বৃহত্তম পাটকল আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেয়। তা সত্ত্বেও বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে ক্ষতি না কমে বরং বেড়েই চলল। এতে সরকার বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ২০০২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ৭৮ শতাংশ ভাগ শেয়ার ও মাত্র ২৯টি পাটকল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি শেয়ার ও পাটকল ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়। 

২০১০ সালে সরকার চিনি, গম, সার ও চালের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের তাদের দ্রব্য/মালামাল গুদামজাত, সরবরাহ, বিক্রয়, বিতরণ ও প্যাকেটজাতকরণে পাটের বস্তা, চটের ব্যাগ অর্থাৎ পাটজাতীয় বস্তু ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করে। ২০১৮ সালে এ আদেশের পরিধি আরো বাড়িয়ে এসব মালামালের সাথে পশুখাদ্যকেও প্যাকেটজাতকরণে পাটের বস্তা, চটের ব্যাগ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

পাটশিল্পের উন্নয়ন ও স্বল্প ব্যয়ের ঋণ প্রদানের জন্য ‘পাট খাত উন্নয়ন তহবিল’ নামে ১০০ বিলিয়ন টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ প্রেরণ করে। পাটশিল্পজাত দ্রব্যের বার্ষিক বিক্রয় মূল্য প্রায় হাজার ইউএস বিলিয়ন। সরকার ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে স্থানীয় পাটশিল্পে পাটের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে কাঁচা পাট ও অপ্রক্রিয়াজাত পাট রফতানি নিষিদ্ধ করে; কিন্তু পাট ব্যবসায়ী সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (ইঔঅ) দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের জুন মাসেই এ আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। 

২০১০ থেকে ২০১৯ সাল অবধি এই ১০ বছরে বিজেএমসি পাট খাতকে লাভের ঘরে আনতে পারেনি। ২০১০-১১ সাল বাদে (বিজেএমসি) প্রতি বছর বিরাট অঙ্কের ঘাটতি নিয়েই এগিয়েছে। ২০১৭ সালে ভারত বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানিকৃত চটের ব্যাগ, বয়নসুতা ও হেসিয়ান বস্ত্রের ওপর অন্যায্য অশুল্ক কর আরোপ করে। পরে ২০১৯ সালে এ পাটের বস্তার ওপর অশুল্ক করের পরিমাণ বাড়িয়ে ইউএস ডলার ১২৫.৩১/টন করা হয়। 

বাংলাদেশের পাটশিল্পের বিরুদ্ধে গৃহীত এ ধরনের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় বিজেএমসি শুধু তার উদ্বেগ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থেকেছে। শুধু এটুকুই বলে যে, ভারত যেহেতু পাট ও পাটসংক্রান্ত দ্রব্যাদির প্রধান ভোক্তা সুতরাং ভারতের এ পদক্ষেপ বাংলাদেশের পাটশিল্পকে ধ্বংস করারই শামিল। সরকার এর পাল্টা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমানে জনতা জুট মিল ও আফিল জুট মিল হলো ব্যক্তিখাতের বড় জুট মিল। (চলবে)

লেখক: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //