এমপি পাপুলের শাস্তি কি যথেষ্ট?

লক্ষ্মীপুর থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম ওরফে পাপুলের পদ যে শূন্য ঘোষণা করা হবে, অর্থাৎ তিনি যে এমপি থাকতে পারবেন না, সেটি গত জুনেই মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। আনুষ্ঠানিক ঘোষণাটি এলো ২২ ফেব্রুয়ারি সোমবার। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে এই সময়টুকু লেগেছে।

তার আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছে জাতীয় সংসদ সচিবালয়। জ্যেষ্ঠ সচিব জাফর আহমেদ খানের সই করা গেজেটে বলা হয়, ‘কুয়েতের ফৌজদারি আদালতে ঘোষিত রায়ে নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে চার বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন লক্ষীপুর-২ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম। এ কারণে বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী, সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য নন তিনি। সে কারণে সংবিধানের ৬৭(১)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রায় ঘোষণার তারিখ (গত ২৮ জানুয়ারি) থেকে তার আসন শূন্য হয়েছে।’

উল্লেখ্য, গত জুন মাসে মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার হন পাপুল। তখন তাকে রিমান্ডেও নেয়া হয়। এরপর ঘুষ লেনদেনের মামলায় গত ২৮ জানুয়ারি তাকে চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার বা ৫৩ কোটি ১৯ লাখ ৬২ হাজার টাকা জরিমানা করেন দেশটির আদালত। বাংলাদেশের ইতিহাসে বিদেশের মাটিতে কোনো সংসদ সদস্যের ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডিত হওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।

প্রশ্ন হলো- শহিদ ইসলাম পাপুলের এই শাস্তিটি কি যথেষ্ট? কারণ তিনি শুধু একজন ব্যক্তি বা একজন ব্যবসায়ী নন। তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের আইনসভার সদস্য। ফলে এটি জাতীয় সংসদের জন্যও অস্বস্তির বিষয়।

বাস্তবতা হলো- পাপুল ধরা পড়েছেন ও কুয়েতের বিচারব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি বলে নিজেকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি। দেশের আদালতে তার বিচার হলে সেই বিচারপ্রক্রিয়া কতটুকু প্রভাবমুক্ত থাকত, সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারা যে দেশের বিচারব্যবস্থা প্রভাবিত হয়, সেটি নতুন কোনো বিষয় নয়। বিশেষ করে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা ও শাস্তি নিশ্চিত করা খুব সহজ নয়। বরং নির্বাচন করতে অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পরও, আদালতের রায় নিয়ে এসে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার উদাহরণও আছে।

মানবপাচার একটি অপরাধ; কিন্তু অনেক সংসদ সদস্য এর চেয়ে অনেক বড় অপরাধ ও লুটপাটের সাথে যুক্ত বলে অভিযোগ আছে। সেসব ঘটনার কতগুলো জানা যায় বা জানা গেলেও তার কয়টি ঘটনার বিচার করা সম্ভব, সেটিও একটি প্রশ্ন। 

যশোরের এক সংসদ সদস্যের ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। যেখানে তিনি এক আইনজীবীকে ফাঁসাতে ‘ডাকাতির উদ্দেশ্যে বোমা হামলা’ মামলা করতে স্থানীয় থানার ওসিকে নির্দেশনা দিয়েছেন। একজন আইনপ্রণেতা কী করে পুলিশকে এমন ভয়াবহ নির্দেশ দিতে পারেন? এরকম একজন ভয়ংকর লোক কী করে সংসদ সদস্য হলেন? সংসদ সদস্যরা প্রিভিলেজ বা বিশেষ সুবিধা পান। সেই সুবিধার অর্থ কি এই যে, তারা যা খুশি তা-ই করতে পারেন? যেহেতু ফোনালাপটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে; অতএব, জাতীয় সংসদেরই উচিত ছিল বিষয়টির তদন্ত করা। কারণ একজন এমপি হয়ে তিনি যা করেছেন, সেটি গুরুতর অসদাচরণ। আর এই অভিযোগ সত্যি হলে, তিনি সংসদ সদস্য থাকার যোগ্যতা হারাবেন। কেননা, সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি যে বিশেষ সুবিধা বা দায়মুক্তি পান, সেটি এই ফোনালাপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। 

ফলে শুধু একজন নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও একজন অপরাধীর শাস্তি দেয়াই নয়, বরং রাষ্ট্রে আইনের শাসন নিশ্চিত করা এবং জাতীয় সংসদের ভাবমূর্তি রক্ষার্থেও বিষয়টির সুরাহা করা দরকার। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় ওই এমপির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া বা ঘটনা তদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, এমন খবর পাওয়া যায়নি। তাছাড়া তদন্ত হলেও সেটি নিরপেক্ষ হবে কি-না, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। তদন্তকারীরা প্রভাবমুক্ত থেকে বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন দিতে পারবেন কি-না, সেটি আরও বড় প্রশ্ন।

সম্প্রতি পুরান ঢাকার আলোচিত সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইরফান সেলিমের দায়মুক্তি সেই প্রশ্ন আরো বাড়িয়েছে। ইরফান সেলিমকে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সাজা দিলেও এই মামলায় পুলিশ তাকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন জানিয়েছে। ফলে, প্রশ্ন উঠেছে, কে সঠিক, র‌্যাব না পুলিশ? র‌্যাবের অভিযানটি কি তাহলে সঠিক ছিল না বা যে অপরাধে সাজা দেয়া হয়েছিল, সেটি কি মিথ্যা? অভিযানের দিন যে পিস্তল, গুলি, এয়ারগান, ওয়াকিটকি ও বিদেশি মদ উদ্ধারের দাবি করা হলো ও যেসব ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হলো, তা কি ভুল? তাহলে সেই অস্ত্র ও মাদক কার? এসব প্রশ্নের জবাব খুব স্বস্তিদায়ক নয়। বরং এসব ঘটনায় বারবার রাজনীতি ও রাজনীতিবিদরাই প্রশ্নবিদ্ধ হন। কিছু লোকের কারণে পুরো রাজনীতির ব্যাপারেই সাধারণ মানুষের বীতশ্রদ্ধা তৈরি হয়। 

পাপুলের মতো এমপিরাও শুধু নিজেদের বিতর্কিত করেন না, বরং তাদের কারণে অসম্মানিত হয় পুরো আইনসভা। তিনি যেহেতু শুধু নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করেননি, বরং অসম্মানিত করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে। যেহেতু তিনি বিদেশে দণ্ডিত হয়েছেন, অতএব তিনি বহির্বিশ্বের কাছে ছোট করেছেন বাংলাদেশকে। মানব পাচারের অপরাধে শুধু তার আদালতে দণ্ডিত হওয়া কিংবা সংসদ সদস্যপদ হারানোই নয়, বরং তার আরো অনেক শাস্তি প্রাপ্য। বিদেশের মাটিতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অপরাধেও তার বিচার হওয়া উচিত।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //