স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রত্যাশা

আলোর সাথে যেমন অন্ধকার থাকে, প্রতিটি গণবিপ্লবের যেমন ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক থাকে, তেমনি এই মানচিত্রের জনগোষ্ঠীর অতীত ইতিহাস থেকে প্রবহমান সব সবলতা-সামর্থ্যরে সীমাবদ্ধতা-দুর্বলতাও মিশে ছিল। একাত্তরের মার্চের শুরুতে পূর্ব বাংলা ছিল গণসংগ্রামে উত্তাল।

২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত ১২টার কিছুক্ষণ পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা’ দেন। ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে, তা নিয়ে (পাকিস্তানি) সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হউক। জয় বাংলা।’ এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। 

প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে-পরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার কয়েকটি দিক আমাদের বিবেচনায় নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক-শোষকগোষ্ঠী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদে গণবিরোধী নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করায় মুক্তিযুদ্ধ প্রগতিমুখীন রূপ নেয়। দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় আপামর জনগণের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে রূপ নেয়। তৃতীয়ত, আমাদের গণসংগ্রামের সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হওয়ায় ও মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অংশগ্রহণ সর্বতোভাবে থাকায়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ অসাম্প্রদায়িক রূপ নেয়।

লেখক: শেখর দত্ত, কলাম লেখক, রাজনীতিক

জাতীয় এই পরিস্থিতিতে তখনকার বিশ্ব বাস্তবতায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক রূপ পরিগ্রহ করা অবশ্যম্ভাবী ছিল। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, পাকিস্তানসহ ব্যতিক্রম কিছু দেশ ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর মতোই আমাদের দেশ সমাজতন্ত্রমুখী পথ গ্রহণ করে। তবে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য ও পছন্দ অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ‘গণতন্ত্রের পথে সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও জাতীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ জাতীয় চার মূলনীতি ঘোষণা করেন। এভাবেই স্বাধীনতার সাথে সাথেই আমাদের রাষ্ট্রের মর্মবাণী সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে কোনো অর্থ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান না থাকা ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত বিবেচনায় নিয়ে বলেন, ‘আমি তোমাদের তিন বছর কিছু দিতে পারব না। আরও তিন বছর যুদ্ধ চললে, তোমরা যুদ্ধ করতে না? তাহলে মনে কর যুদ্ধ চলছে। তিন বছর যুদ্ধ চলবে। সেই যুদ্ধ দেশ গড়ার যুদ্ধ। অস্ত্র হবে লাঙল আর কোদাল।’

বঙ্গবন্ধু কিছু দিতে পারবেন না বলেছিলেন; কিন্তু তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে লাখ লাখ শরণার্থীকে পুনর্বাসিত, রাস্তা-পুল-স্কুল-কলেজ-অফিস পুনর্গঠন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মাইন সরিয়ে তা চালু করা, রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করা প্রভৃতি কাজকে সুসম্পন্ন করেছিলেন। ছিল না খাদ্য, ছিল না অর্থ। পরাজিত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের মধ্যে তিনি তারও সুরাহা করেছিলেন। দেশবাসীর জন্য সবচেয়ে বড় উপহার ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অভিমুখীন সংবিধান। এটিই ছিল দেশের ইতিহাসের প্রথম সংবিধান, যা বিশ্বের সংবিধানগুলোর মধ্যে রয়েছে সামনের কাতারে। আজ পঞ্চাশ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলা যায়, তিনি জনগণের ইচ্ছা-আকাক্ষা ও প্রদত্ত অঙ্গীকার অনুযায়ী সব কিছুই সাজিয়ে তুলেছিলেন। কর্মযজ্ঞও শুরু হয়েছিল।

তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে এটি তো স্বতঃসিদ্ধ ছিল যে, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রাপ্তি সুনিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ফারাক থাকবে। কল্যাণকর কাজ অগ্রসর করতে সমস্যা-বাধা দাঁড়াবে, নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হবে। দুই গণশত্রু জাতির উন্নয়নের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বঙ্গবন্ধু তাদের ‘রাতের বাহিনী’ ও ‘চাটার দল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই দুই গণশত্রু আমাদের জাতীয় চার মূলনীতিকে, আমাদের জাতিসত্তাকে, আমাদের সহনশীল সমাজকে একদিকে উগ্রতা-অন্ধত্ব আর অন্যদিকে অনৈতিকতা-অবৈধতা দিয়ে আঘাত করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে গণতন্ত্রকে দিয়ে গণতন্ত্রকে আঘাত করার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর শাসনামল। এই আঘাতের বাড়বাড়ন্ত আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে খাদ্য নিয়ে চক্রান্তের কারণেই জাতীয় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংসদীয় গণতন্ত্র স্থায়ী হতে পারল না। বঙ্গবন্ধু চললেন তখনকার আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় গণতন্ত্রকে শর্তযুক্ত করে সমাজতন্ত্র অভিমুখে। বাকশাল আর দ্বিতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে একটা কালপর্ব অতিক্রম করতে চাইলেন। বললেন, আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। 

আজ পঞ্চাশ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে বিগত দিনগুলোর দিকে তাকালে এটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সামরিক শাসন ও হত্যা-ক্যুয়ের ভেতর দিয়ে জাতীয় পরিস্থিতির যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিরও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্ব মানচিত্র পাল্টে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশে^র কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাধা ডিঙিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী হয়েছিল, সেই দ্বিতীয় বিশ্ব আর নেই। মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারত ছিল মার্কিনিদের বিরুদ্ধে। এখন ভারতের সেই অবস্থান পাল্টে গেছে। সর্বোপরি সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা পতনের পর বিশ্ব এককেন্দ্রিক অর্থাৎ আমেরিকাকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিল। সেটাও এখন আর নেই। চীন বিশ্বশক্তি হয়ে দাঁড়ানোর পথে। রাশিয়াও মাঠে রয়েছে। 

তবে অর্থনীতির উপযোগী রাজনৈতিক কাঠামো-ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিক থেকে আমরা রয়েছি পিছিয়ে। গণতান্ত্রিক চর্চা ও সংস্কৃতি এখনো হাঁটি-হাঁটি পা-পা করছে। ভোট-সংসদ নানা দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। রাজনীতি রাজনীতিকদের কাছ থেকে অনেকটাই চলে গেছে আমলা-ব্যবসায়ীদের হাতে। ‘কাউয়া’রা রাজনীতিতে ভিড় জমাচ্ছে, করায়ত্ত করতে উদ্যত হচ্ছে। অনৈতিকতা-অবৈধতা, লোভ-লালসা প্রভৃতি আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে চ্যলেঞ্জ করছে, রাজনৈতিক কাঠামো-ব্যবস্থাকে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। রাজনীতি-অর্থনীতি হাত ধরাধরি করে যুগপৎভাবে অগ্রসর হোক, এটাই আজকের কামনা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //