ঘরে ঘরে নারী নেতৃত্ব গড়ে তুলুন

সমতা অর্জনের লক্ষ্যে নারী নেতৃত্বকে প্রাধান্য দিয়ে এ বছর পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। 

গত কয়েক বছরে নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি বেসরকারি উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহনের ফলশ্রুতিতে দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক নারীর কাছেই আইডল। রাজনীতিসহ প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন দায়িত্বে  নারীদের অংশগ্রহন বেড়েছে অনেক। নারীদিবস এলেই আমরা শুনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের সাফল্যের জয়জয়কার, ইতিবাচক সব সংবাদ যা অনুপ্রেরনা জাগায় অন্য নারীদের। এরপরও প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যাসহ নেগেটিভ সব সংবাদ জানান দেয় সমতা অর্জনে আমরা এখনো সক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি। 

নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পুরাতন সামাজিক ধ্যানধারনা , কুসংস্কার , শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চার অভাব এখনও পিছিয়ে রেখেছে বাংলার নারীদের। আমরা আজ নারী নেতৃত্বকে ফোকাস করছি, নেতৃত্ব অর্জনের জন্য প্রয়োজন নারীর যথাযথ ক্ষমতায়ন। অথচ নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়টি এখনো অনেকের কাছে অস্পষ্টই রয়ে গিয়েছে। সাধারনভাবে অনেকে ভেবেই নিচ্ছেন যে দেশে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার , বিরোধীদলীয় নেত্রী নারী সে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন হয়ে গিয়েছে কিংবা নারীর ক্ষমতায়ন মানে কেবল কাজ করে আর্থিকভাবে সাবলম্বী হয়ে গেলেই যথেষ্ট। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন কেবল নারীর কর্মসংস্থানের এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।  সিদ্ধান্ত অংশগ্রহণ, বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দেওয়ার অধিকার, আত্মসম্মানবোধ, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, ক্ষমতা থাকার সাথে সাথে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার প্রভৃতি বিষয়গুলো নারীর ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ।

নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত অর্জনের অগ্রগতির বিচারে বুঝা যায় সে কতটা ক্ষমতার অধিকারী। নারীর ক্ষমতায়নের ৫টি স্তর নির্দেশ করা হয়েছে নিয়ন্ত্রন অংশগ্রহণ, নারী জাগরণ, সম্পদ আহরণ ও নিয়ন্ত্রনের অবাধ সুযোগ বা অধিকার ও কল্যান।

সমতা অর্জনে নারী নেতৃত্বকে জোরদার করতে হলে ঘর থেকে শুরু করতে হবে নেতৃত্বদানের চর্চা।

আবহমানকাল থেকে বাংলাদেশে ঘরোয়া কাজের দায়িত্বে থাকে নারী, গৃহিনী ঘরের সকল কাজের নেতৃত্ব দেন অথচ সংসার কিংবা পারিবারিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহনের সময় জানা হয় না গৃহকর্তীর মতামত। বলা হয় তুমি মেয়ে মানুষ চুপ থাকো। ২০২১ সালে এসেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পথে ঘাটে দেখা যায় মেয়েরা কোন প্রতিবাদ করলেও  মেয়ে মানুষের কথা বলতে নেই বলে চুপ করিয়ে দেওয়া হয়।

খর্ব করা হয় নারীর অধিকারকে। বর্তমানে অনেকের সাফল্যে বাহবা দিয়ে বলেন, মেয়ে মানুষ হয়ে এটা করেছে বাহ! এ ধরনের কথায় বুঝাই যায় আমাদের সমাজ আজও সেইসব ধ্যান ধারনায় পড়ে আছে যেখানে বিশ্বাস করা হয় কেবল নারী হবার কারনে নারীদের দিয়ে সব ধরনের কাজ করানো সম্ভব নয়। সমতা অর্জন করতে হলে সর্বত্র নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

ঘরে ঘরে নারী  নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে আগে, সন্তানরা যেন দেখতে পায় পরিবারে রান্নাবান্নার কাজ ছাড়াও সব বিষয়ে সমান গুরুত্ব পাচ্ছেন মা। জন্মের পর শিশুর লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে হবে। ছেলে মেয়ে শিশুর খেলনা আলাদা করিয়ে তার মাথায় ভবিষ্যত পেশার ভুল বীজ বপনের কোন মানে নেই। মেয়ে হলে সে প্লেন দিয়ে খেলতে পারবে না , সন্তান পালনের মত পুতুল পালন ও কিচেন সেট হাতে ধরিয়ে রান্নাবান্না খেলতে হবে এমন শিক্ষায় কন্যা সন্তানকে মানুষ করার প্রবনতা বাদ দিতে হবে। ভাই বোনের একই খাবারের মেনু এবং বেড়ে উঠায়  কোন বৈষম্য নয়।

কন্যা শিশুরা সাইকেল চালানো শিখতে পারে অংশগ্রহন করতে পারে সংস্কৃতিচর্চা সহ সৃজনশীল কর্মকান্ডে। জিমে শরীরচর্চা , ক্যারাটে শিক্ষা, গিটার বাজানো এসব কেবল পুত্র সন্তানের কাজ এমনটি নয়। পড়াশুনার পাশাপাশি কন্যাকে তার পছন্দঅনুযায়ী সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহন করতে দিতে হবে, দিতে হবে স্বাধীনতা , অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস। 

পারিবারিকভাবে বাড়ি থেকে কন্যাদের শেখানো হয় সবসময় মাথা নিচু করে, আস্তে কথা বলতে। এই মাথা নিচুই ভবিষ্যতে কন্যার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। অন্যায়ের কাছে কেউ মাথা নত করবে না, মুখ খুলবে প্রতবিাদ করবে সমস্যার সমাধান করবে। এমনভাবে নিজের জীবনকে গড়ে তুলবে যেন পরনির্ভরশীল হতে না হয়। মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হবে । আত্মবিশ^াসের সাথে আতনির্ভশীল জীবন যাপন করবে। মেয়েদের হতে হবে মানসিকভাবে শক্তিশালী। পাছে লোকে কিছু বলে এই ভয়ে থেমে থাকা চলবে না কিছুতে। কোন ক্রমে তার অধিকার লঙ্ঘন হলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। অভিভাবকরা সবসময় কন্যা সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকেন, চিন্তিত হবার পাশাপাশি তাদের উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিতে হবে। ঘরে ঘরে নৈতিক শিক্ষার চর্চা আবশ্যক। ছেলে মেয়ে উভয়কেই গড়ে তুলতে হবে সমতার শিক্ষায়, ইভটিজিং না করা মানবিক জীবন যাপন এসবের দায়িত্ব পরিবারের। বলা হয় পরিবার প্রথম স্কুল, আজকাল প্রচুর পড়াশুনার চাপে যেন হারিয়ে যাচ্ছে পারিবারিক শিক্ষা। সব কিছুর জন্য সময় হলেও যেন সময় দেওয়া হচ্ছে না শিশুদের। ভবিষ্যতে ছায়া পাওয়ার জন্য যেমন বীজ রোপন করে গাছের পরিচর্চা করা হয় ঠিক তেমনি আগামীর বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন ঘর থেকে শিশুর যতœ ও সমতার জ্ঞান। 

সাম্প্রতিক করোনাকালে লকডাউনে ঘরে থেকে অনেক পরিবর্তন এসেছে আমাদের চিন্তাধারায়। আমরা বিশ^াস করি পরিবর্তনের জন্য পরিবারে সময় দেওয়া এবং  পারিবারিক শিক্ষা আবশ্যক। এ সময়ে অনেক পরিবার কাজ হারিছেন আবার ঘর থেকেই উদ্যোক্তা হয়েছেন অনেকে। ডিজিটাল বাংলাদেশে অনলাইন ভিত্তিক সুযোগ সুবিধার ফলে নারীরা নিজ ঘরে থেকেও ব্যবসা করছেন। 

এ সময়ে একটা বড় শিক্ষনীয় বিষয় ছিল বাড়ির পুরুষের বাইরে কাজ না থাকলেও প্রয়োজন মাফিক পন্য নিয়ে ঘর থেকে নারীরা উদ্যোক্তা হয়েছেন, অবশ্যই পুরুষরা সহযোগিতা করেছেন।

ঘরে বাইরে পুরুষের পাশাপাশি নেতৃত্ব দিবে নারী আসবে সমতা।

নারী ও পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক, সমতার পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি আমরা। সেইদিনটির প্রতিক্ষা করি যেদিন নারীর অধিকার আদায় করতে আর নারী দিবস  উদযাপন করতে হবে না।

লেখক: সায়েমা রহমান তুলি, সাবেক পরামর্শক, পিপিএ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।



সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //