সোনালি আঁশের সোনালি অতীত ও দিশাহীন ভবিষ্যৎ

পাটকে সোনালি আঁশ বলা হয়ে থাকে। এটি একটি অর্থবহ বিশেষণ। পাটের আঁশের রঙ সোনালি হওয়ার কারণে ও অবিভক্ত ভারতের এ অংশে প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় একে সোনালি আঁশ বলা হয়। 

অতীতের জিডিপিগুলো পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। পাট বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে জন্মালেও বাংলাদেশ ও ভারতেই প্রায় মোট ৯৮ শতাংশ পাট উৎপাদিত হয়। এককভাবে বাংলাদেশে ৪০ শতাংশ ভাগ উৎপাদিত হয় এবং এগুলো শ্রেষ্ঠ মানের। এর প্রধান কারণ হচ্ছে জমির গুণাগুণ, ধরন ও আবহাওয়া।

পাটের আঁশ দিয়ে সব ধরনের কাপড় বোনানো যায়। বলতে গেলে ঘরের ব্যবহার্য প্রায় সব ধরনের জিনিস যেমন- পর্দা, বিছানার চাদর, টেবিল ক্লথ, ঢাকনি, ম্যাট, কার্পেট পাট দিয়ে তৈরি হয়। পাট দিয়ে দড়ি, রশি, ব্যাগ, চট, প্যাকেজিং কভার ও জুটেক্স (বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে পানি প্রবাহ রোধে ও কৃষিতে ব্যবহারযোগ্য) তৈরি করা ছাড়াও পাটের আঁশ দিয়ে ঘরের ফার্নিচার, দরজা, জানালা, গাড়ির বডি, বিমানের প্যানেল নির্মাণে ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে বিশ্ব উষ্ণতায় অ-জীবাণুবিয়োজ্য জিনিস ব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যয়ে যে হুমকি দেখা দিয়েছে পাট ও পাটজাত জিনিস ব্যবহারে তা থেকে মুক্তির বার্তা এক প্রশান্তির অনুরণন বয়ে এনেছে। গ্রিন প্রডাক্ট হিসেবে পাট ও পাটজাত জিনিস মানুষ লুফে নেবে নিঃসন্দেহে। 

পাটশাক মানবদেহের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর, উপাদেয় ও জনপ্রিয় খাদ্য। এশিয়াতে শাক হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পাটশাকের ভেষজ গুণের কারণে এর স্যুপ আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কিছু কিছু দেশে ওষুধ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রোটিন সমৃদ্ধ পাট শাকে রয়েছে- ভিটামিন-সি, বিটা-ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম ও লৌহ জাতীয় খনিজ। রোগ নিরাময়ে পাটশাক ভেষজ ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২২০০-১৯০০ খ্রিস্টপূর্ব সাল থেকে ভারতবর্ষে পাট চাষ হয়ে আসছে। পাট প্রধানত দুই প্রকার, যথা- সাদা পাট ও তোষা পাট। এ দুটো জাতের পাটের সংমিশ্রণে আরেকটি হাইব্রিড পাটের জাত তৈরি করা হয়েছে যেটি ‘মেসতা’ নামে পরিচিত। 

সাদা পাট

সাদা পাট প্রথম দিকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কালক্রমে বিভিন্ন ফ্যাব্রিক্স, ইয়ার্ন, বস্ত্র, ঘরের আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরিতে এর গুণাগুণ তোষা পাটের দ্বারা নির্মিত জিনিসের তুলনায় মানসম্মত না হয়ে ওঠার দরুণ পিছিয়ে পড়তে থাকলো। বর্তমানে এ জাতটি জনপ্রিয়তা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। 

ইতিহাস ঘাটলে এটা প্রতীয়মান হয় যে, সাদা পাট বাংলার এতদাঞ্চলের গণমানুষের পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরিতে এগিয়ে থাকার কথা ছিল। সাদা পাটের আঁশ অন্যান্য পাটের আঁশের চেয়ে শ্বেতকায়, তবে তুলনামূলকভাবে শক্ত কিংবা টেকসই নয়। এশিয়ার এ অঞ্চলে মালপত্র বাঁধতে দড়ি বা রশি, থলে, প্যাকিং ও ব্যাগ তৈরিতে এ পাটের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে।

তোষা পাট

হাল্কা মেরুন রঙের লম্বা আকৃতির তোষা পাট বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত এবং খুবই জনপ্রিয়। প্রকৃত অর্থে তোষা পাট অর্থ উপার্র্জনকারী ফসল হিসেবে চিহ্নিত ও অধিক সমাদৃত। তোষা পাট শুধু টেকসই ও মজবুতই নয়, এটি বেশ লম্বা আকৃতির বিধায়, সব ধরনের কাজেই একটি বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। 

তোষা পাটকে দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব উৎপাদিত ফসল হিসেবে গণ্য করা হয়। এটা শুধু বস্ত্র, দড়ি বা রশি, থলে, প্যাকিং ও ব্যাগ তৈরিতেই ব্যবহৃত হচ্ছে না, এসব দেশে পাট খড়ি হিসেবে রান্নার কাজেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ কারণে জ্বালানির উপকরণ হিসেবে বৃক্ষ নিধন ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে।

বাংলাদেশের সাদা পাট ও অন্যান্য জাতের পাটের চেয়ে তোষা পাট মসৃণ, দীর্ঘ, টেকসই ও মজবুত। এ ধরনের পাট বদ্বীপ এলাকায় বেশি জন্মায় বলে বিশ্বে উৎপাদিত তোষা পাটের সিংহভাগই বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। তবে পশ্চিম বাংলার কিছু কিছু এলাকায়ও এ পাট জন্মায়। গুণগত মান বিবেচনায় তোষা পাট শ্রেয়তর। 

মেসতা পাট

এটি একটি হাইব্রিড জাতের পাট। এটি সাদা পাট ও তোষা পাটের সংমিশ্রণে উৎপাদন করা হয়েছে। দুই বাংলায়ই এটি চাষ হতো। এ জাতের পাট কখনো জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কালে উপমহাদেশে রাজনৈতিক ডামাডোলের সময় এ বাংলা থেকে ও বাংলায় পাট চলাচলে বিপত্তি হওয়ায় এ জাতের পাট স্বল্প সময়ের জন্য ভারতের মিলগুলোতে ব্যবহৃত হওয়ার কারণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। 

ভালো মানের পাট উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন পলল জমি, যেখানে পানি স্থির বা একেবারে স্বল্প স্রোতে বাহিত হয়। উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া পাট চাষে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পাট ভালো জন্মানোর জন্য তাপমাত্রা ২০০ থেকে ৪০০ সেলসিয়াস এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাট জন্মানোর সময় ৫ থেকে ৮ সেন্টিমিটার বৃষ্টি ভালো মানের পাট প্রাপ্তিতে বেশ উপযোগী। পাটের গুণগত বৈশিষ্ট্য অর্জনে মিঠা পানি একটি প্রয়োজনীয় বিষয়।

পাটের ভঙ্গুরতা, নমনীয়তা, শক্ত আঁটুনী, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে সারাবিশ্বে মালামাল পরিবহন, স্থানান্তর, প্যাকেজিংসহ মালামাল গুদামজাত করতে এর প্রয়োজনীতা অনস্বীকার্য; কিন্তু অল্প কয়েকটি দেশে বিশেষ করে আমাদের মতো বিদেশ-নির্ভর দেশগুলোর ওপর পাটের উৎপাদন-সক্ষমতা পুঁজিবাদী ও ধনী দেশগুলোর কাছে একটা বিড়ম্বনা ও অসহনীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। 

এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে এখানকার প্রতিটি সরকারই জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কে অসচেতন এবং পাট উৎপাদন এবং এর বহুমুখী ব্যবহার সম্পর্কে উদাসীন থাকায় দেশে পাট উৎপাদন হ্রাস পায়। সেই সুযোগে ধনী দেশগুলো পাটের বিকল্প বের করতে জোর প্রচেষ্টা চালায়। ফলশ্রুতিতে পাটের বিকল্প হিসেবে পলিথিন ও প্লাস্টিকের থলে, নাইলনের দড়ি তথা পরিবেশবিনাশী, অদ্রবীভূত, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসকারী এসব জিনিসের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। পাশাপাশি আমাদের দেশে সোনালি আঁশ হিসেবে ভূষিত হলেও বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর অদূরদর্শিতা, পরিকল্পনাহীনতা এবং গণবিরোধী নীতির ফলে পাটের ওপর বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করার কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি। 

পাট আঁশ থেকে উন্নত পদ্ধতি প্রয়োগ করে বুনন, বয়ন ও উন্নত যন্ত্রপাতির উদ্ভাবনের চিন্তা তিমিরেই থেকে গেছে। উন্নত মানের সুতা, বস্ত্র, আসবাবপত্র ও নানাধরনের নিত্য ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র তৈরিতে প্রশিক্ষিত কারিগর গড়ে তোলা এবং উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আধুনিক পাটকল স্থাপনে কোনো রকমের উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি।

বিশ্বব্যাপী তুলার পরেই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আঁশ হিসেবে পাট সমাদৃত। সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে পাট শিল্প বাংলাদেশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এক সময়ে এতদাঞ্চলে পাটকে কেন্দ্র করে বৃহৎ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল। যদিও পরবর্তীতে যথাযথ প্রকল্প ও পরিকল্পনার অভাবে ক্রমশ এ শিল্প ম্রিয়মান হতে থাকে।

পাট ও পাট শিল্প প্রস্তুতকৃত দ্রব্যাদি ১৯৭০ পর্যন্ত এদেশের বৃহত্তর বিদেশি মুদ্রা অর্জনকারী সম্পদ ছিল। স্বাধীনতা ও তৎপরবর্তী সময় থেকে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের অভাবে পাটের বিকল্প হিসেবে পরিবেশ দূষণকারী প্লাস্টিকসহ উৎপাদন শুরু হয়। কয়েকটি দেশ পাট উৎপাদনে এগিয়ে আসার কারণেও বাংলাদেশে পাটের বাজার মন্দা হতে শুরু করে। 

ঐতিহাসিকভাবে বাংলায় পাট থেকে দড়ি, ব্যাগ ও কাপড় তৈরিতে এর ব্যবহার ছিল। ইউরোপে নেপোলিয়ানের শাসনামলে ১৮০৩-১৮১৫ সাল অব্দি, রাশিয়া স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে বস্ত্র বুননের জন্য তিসি বা শন গাছের ফ্লাস্ক সরবরাহ করত। ইংরেজরা একটি নতুন উৎসের সন্ধানে ব্যস্ত ছিল। পাট পেয়ে তাদের এ আকাক্ষা পূরণ হলো; কিন্তু পাট অনেক মোটা ও শক্ত থাকায় প্রচলিত বুননের যন্ত্রপাতিতে এটি ব্যবহার করা দুঃসাধ্য ছিল। সে কারণে যুক্তরাজ্যের বালফোর ও মেলভিল মিল কর্তৃপক্ষ পাটের মোটা আঁশকে তিমির চর্বি, পানি দিয়ে নরম ও চিকন করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ব্যবহার করা শুরু করলো। ১৮৩০ সনে ডান্ডির মিল কর্তৃপক্ষ ডাচ নিয়ন্ত্রিত ইন্দোনেশিয়ার জাভাতে আখ চাষের জন্য পাটের বস্তা সরবরাহের কার্যাদেশ পেলো। তারা বালফোর ও মেলভিলের পদ্ধতি অনুসরণ করে পাটের বস্তা সরবরাহ করতে শুরু করলো।

সামগ্রিকভাবে পশ্চিম বাংলা ও পূর্ববাংলায় পাট চাষ ও শিল্প কারখানার অবস্থার বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে ১৮৭৩ সনে ব্রিটিশ সরকার এইচ সি কারের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। পাট চাষের অবস্থা ও পাটের ব্যবসা সম্পর্কিত কমিশনের প্রতিবেদনটি ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত হয়। এ প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, পাটের ব্যাপক চাষাবাদ ১৮৪০ সাল থেকে শুরু হয়। ১৮৫৫ সালে শ্যামসুন্দর সেন নামে একজন বাঙালি ব্যবসায়ীর সঙ্গে যৌথভাবে একজন ইংরেজ বেনিয়া জর্জ অকল্যান্ড হুগলী নদীর তীরে রীসরা নামক স্থানে প্রথম জুট মিল স্থাপন করেন। আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলাকালে তন্তুর কোনো ভালো বিকল্প বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা খুব তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। আমেরিকানদের কাছে সাশ্রয়ী ও একটি ব্রিটিশ পদানত উপনিবেশিক দেশে উৎপাদনকৃত ফসল হিসেবে পাটই সবচেয়ে ভালো বিকল্প হিসেবে নির্ধারিত হলো। ফলে কলকাতায় ব্যাপক পাট মিল গড়ে উঠল। 

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে যার সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেল। ১৮৮২ সালে যেখানে ১০টি পাটকল ছিল, তা ১৯০১ সালের দিকে এসে বৃদ্ধি পেয়ে ৫১তে দাঁড়াল। এসব কারখানাতে ১৯০১ সাল অব্দি প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরির সুযোগ হলো। এসব পাটকলে প্রস্তুতকৃত পাট দ্রব্যাদির অধিকাংশ অংশই তখন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হতো। এ সব কারণে ক্রমশ বস্ত্রশিল্পের পরে পাট শিল্প ব্রিটিশ শাসিত উপনিবেশিক ভারতে দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো এবং কলকাতা পাট সংক্রান্ত ব্যবসার মূলকেন্দ্র হয়ে উঠল। অধিকাংশ পাট কারখানাই কলকাতার আশপাশে গড়ে উঠল। এসব কারখানার অধিকাংশ মালিকই ছিলেন মূলত ইংরেজ বেনিয়ারা। 

১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে পাক-ভারত কথিত স্বাধীনতার নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। তখন পাট উৎপাদন বেশি হচ্ছে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলায়; কিন্তু পাটকলগুলো গড়ে উঠছিল ভারতের পশ্চিম বাংলায়। পাক-ভারত আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার ফলে ব্যাপক পাট উৎপাদন এলাকা পূর্ব-বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলার পাটকলে পাট সরবরাহের সংকট দেখা দিল। যদিও ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় ব্যবসা বাণিজ্য অনকেটাই অবাধ ও মুক্ত ছিল। ফলে এই দুই বছর পাট সরবরাহে তেমন কোন অসুবিধা না হলেও, পরবর্তীতে ভারত যখন পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আলাদা রাষ্ট্র ঘোষণা করে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বিধি চালু করল, তখন পূর্ব বাংলার পাটের ব্যবসা এক মহাসংকটে নিপতিত হলো। সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় নতুন নতুন পাটকল স্থাপনের কাজ শুরু করল। দেশ বিভক্তির আগে সমগ্র বাংলা অঞ্চলে সর্বমোট ১০৮টি পাটকল ছিল, যার সবকটিই ভারতের পশ্চিম বাংলায় অবস্থিত ছিল। বিপুল পরিমাণে উন্নত জাতের পাট উৎপাদিত হলেও, পাকিস্তানের অংশ হওয়ার কারণে পূর্ব বাংলা কোনো পাটকলই পেল না। 

পূর্ব বাংলার পাট উৎপাদনের ওপর ভরসা করে পাকিস্তান এবং পশ্চিম বাংলার পাটের ব্যবসার ওপর নির্ভর করে ভারত- উভয় দেশ অর্থনৈতিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সে অনুযায়ী ভারত পাট উৎপাদনে এবং পাকিস্তান পাটকল স্থাপনে মনোযোগী হয়ে উঠল। 

১৯৫১ সালের দিকে পূর্ব বাংলায় সর্বপ্রথম বাওয়ানী জুট মিল্স, আদমজী জুট মিল্স এবং ভিক্টরি জুট প্রডাক্টস লিমিটেড নামে পাটকলগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পাটকলগুলো স্থাপনে পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা (Pakistan Industrial Development Corporation- PIDC) নামে একটি সরকারি সংস্থা অর্থায়ন করে। ১৯৬০ সাল অবধি বাংলাদেশে প্রায় ১৪টি মিল গড়ে ওঠে, যার ১২টিই উক্ত প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে হয়। এসব মিলের অধিকাংশেই মালিকই ছিলেন অবাঙালি; কিন্তু অধিকাংশ শ্রমিক-কর্মচারী ছিল বাঙালি। বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব বাংলায় অবাঙালি মালিক নিয়ন্ত্রিত পাটকলে বাঙালি শ্রমিকদের আচার-আচরণ নিয়ে সরকার উদ্বেগ ও আশঙ্কা অনুভব করতো। তাই তারা এ সংকট নিরসনে বাঙালি ধনী ব্যবসায়ীদের কারখানা স্থাপনে প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে। এরই কৌশল হিসেবে পাকিস্তানের তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী জনাব আবুল কাশেম খান ‘পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা’ ভেঙ্গে দু’ভাগ করার পরিকল্পনা করেন। একটিকে ‘পশ্চিম পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা’ নাম দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ও আরেকটিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা’ নাম দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করেন। যা পরবর্তীতে পূর্ব-বাংলায় অনেক বড় বড় পাট কারখানা স্থাপনে এক বিরাট প্রণোদনা হিসাবে কাজ করে।

‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন সংস্থা’ পূর্ব-বাংলায় পাটকল স্থাপনে প্রয়োজনীয় তাঁতকলের সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে পাট কারখানা স্থাপনকারী উদ্যোক্তাদের আরও প্রণোদনা দিল। তাতে বাংলাদেশে পাটকলের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো। ১৯৭০ সাল অবদি পূর্ব পাকিস্তানে পাট কারখানার সংখ্যা দাঁড়াল ৭৭টি, যাতে প্রায় ১৭০ হাজার শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান হলো। পাকিস্তান পাট রপ্তানি করে ১৯৭০ সালে ৭৭ মিলিয়ন রুপি আয় করে এবং বিশ্বে পাট রপ্তানিতে শীর্ষস্থান অধিকার করে। বিদেশি মুদ্রা অর্জনে পাকিস্তানের জিডিপিতে পাটের অংশ যেখানে শতকরা ছিলো ২ শতাংশ, তা ১৯৭০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ শতাংশে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলে পাট কারখানার পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকরা বাংলাদেশে স্থাপিত পাটকলগুলো পরিত্যক্ত করে এদেশ ছেড়ে চলে যায়।

বাংলাদেশে ১৯৭১ স্বাধীনতা যুদ্ধ অবধি ৭৭টি পাটকল স্থাপিত হয়েছিল। এর মধ্যে এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজী জুটমিল অন্যতম। এর মধ্যে ৫২টি পাটকলের মালিকই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালি শিল্পপতি।

যুদ্ধের পর পাটকলগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার ‘বাংলাদেশ জুট বোর্ড’ গঠন করে। বাংলাদেশ সরকার নবগঠিত জুট বোর্ডকে পরিত্যক্ত মিলগুলোকে অধিগ্রহণ করতে আদেশ দেয়। জুট বোর্ড মিলগুলোর জন্য প্রশাসক নিয়োগ দেয়। রাজনৈতিক যোগাযোগ ও দলীয় আনুগত্যের যোগ্যতায় এদের নিয়োগ দেয়া হলেও এরা ছিলেন মূলত অযোগ্য ও অকর্মণ্য। শিল্পজাত কল-কারখানা চালানোর কোনো যোগ্যতা তাদের ছিল না।

এক নৈরাজ্যকর অবস্থায় ১৯৭২ সালে সংবিধানে সমাজতন্ত্রের ধারা সন্নিবেশিত হলে সরকার অন্যান্য সব শিল্প কল-কারখানার ন্যায় পাটকলগুলো অধিগ্রহণপূর্বক জাতীয়করণ করে। জাতীয়করণকৃত পাটকলগুলোকে নবগঠিত বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে ন্যস্ত করা হয়। বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন দেশের অভ্যন্তরে পাট ক্রয়, বিক্রয় ও দর নির্ধারণের দায়িত্ব পায়। ১৯৭০ সালে পাটের উচ্চমূল্য, টাকার অবমূল্যায়ন ও পাটকলগুলোতে প্রচণ্ড দুর্নীতির ফলে বাংলাদেশ জুটমিল করপোরেশন বিপুল লোকসান দিয়ে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৭৩ সালে সরকার ‘পাট বিভাগ’ খোলে ও উক্ত বিভাগকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে। 

সম্পর্কহীন একটি বিভাগকে ভিন্নধর্মী একটি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার পদক্ষেপ সরকারের অপরিপক্বতা ও অপরিণামদর্শিতার পরিচয় বহন করে। পরবর্তীতে সরকার তার ভুল বুঝতে পেরে ১৯৭৬ সালে পাট বিভাগকে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে এনে পাট মন্ত্রণালয়ে উন্নীত করে। পাশাপাশি সরকার পাটবিষয়ক একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করে। সেই কমিটি ১৯৭৯ সালে জাতীয়করণকৃত পাটকলগুলোকে ব্যক্তি খাতে দিয়ে দেয়ার সুপারিশ করে। এর মধ্য দিয়ে সরকারি ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নব্য ধনিক শ্রেণি তাদের অভিলাষ পূরণের আরো একটি সুযোগ পেয়ে যায়। 

অথচ এই কমিটি জাতীয়করণকৃত পাটকলগুলোর সমস্যা ও সংকট তুলে ধরে জাতীয়করণের সংকট সমাধানের সুপারিশ গ্রহণ করতে পারত! সরকারও যেন এ ধরনের সুপারিশ হাতে পাওয়ার জন্য বসেই ছিল। এরপর পরেই ১৯৭৯ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে তিনটি পাটকল মূল মালিকদের ফেরত দিয়ে দেয়া হয়  ও দুইটি পাটকলকে ব্যক্তি খাতে দিয়ে দেয়া হয়। 

১৯৮০ সালে সরকার পাটকলগুলোকে একটি বিশেষ সহায়ক তহবিল ও রফতানি বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিশেষ প্রণোদনা তহবিল প্রদান করে। অব্যাহত ক্ষতির চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে বিশেষ রফতানি প্রণোদনাও ঘোষণা করা হয়। একইভাবে ১৯৮২ সালে সরকার আরো ৩৫টি পাটকল এগুলোর মূল মালিকদের ফেরত দেয়।

পাটের সঠিক অবস্থা, বাজার দর, পাটশিল্পের অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরতে বিশ্বব্যাংক ১৯৯০ সালে একটি খ্যাতিসম্পন্ন আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের অনুমোদন দেয়। বিস্তারিত পর্যালোচনা করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান যে তথ্য দেয়, তাতে দেখা যায় যে, স্থানীয় ব্যাংকের নিকট পাটকলগুলোর মোট ২০.৭৫ বিলিয়ন টাকার দায়বদ্ধতা আছে। এছাড়াও প্রায় ১৩ বিলিয়ন টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর কাছে ও বাকি টাকা ব্যক্তিখাতের পাটকলগুলোর কাছে দায়বদ্ধতা ছিল। বিশ্ব ব্যাংকের এ প্রতিবেদনে পাটকলগুলোর উৎপাদন কমানো ও রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলকে ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেবার সুপারিশ করা হয়। উপরোক্ত সুপারিশসহ আরো কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ২৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার ঋণের প্রস্তাব দেয়। এ যেন গাধার নাকের ডগায় মূলো ঝুলিয়ে দেয়া! 

বাংলাদেশ সরকার যথারীতি চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধ করে দেয় এবং বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোকে তাদের শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা প্রদান করে। 

এ পদক্ষেপে পাটকলগুলোর আর্থিক ক্ষতি যেমন হ্রাস পায়নি, তেমনি এগুলোকে লাভজনক করে গড়ে তুলতেও পারা যায়নি। ব্যক্তিখাতের পাটকলগুলোও লাভ করে উঠতে পারছিল না বরং এর মধ্যে ব্যক্তি খাতের দুইটি পাটকল বন্ধও হয়ে গেল। সংকট সমাধান না করে কীভাবে উঠতি ধনিক শ্রেণির সুবিধা করে দেয়া যাবে, এ নিয়েই যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল কর্তৃপক্ষ। ২০০২ সালে সরকার এতদাঞ্চলের বৃহত্তম পাটকল আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেয়। তা সত্ত্বেও বাকি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোতে ক্ষতি না কমে বরং বেড়েই চলল। এতে সরকার বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ২০০২ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর ৭৮ শতাংশ ভাগ শেয়ার ও মাত্র ২৯টি পাটকল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি শেয়ার ও পাটকল ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেয়। 

২০১০ সালে সরকার চিনি, গম, সার ও চালের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের তাদের দ্রব্য/মালামাল গুদামজাত, সরবরাহ, বিক্রয়, বিতরণ ও প্যাকেটজাতকরণে পাটের বস্তা, চটের ব্যাগ অর্থাৎ পাটজাতীয় বস্তু ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করে। ২০১৮ সালে এ আদেশের পরিধি আরো বাড়িয়ে এসব মালামালের সাথে পশুখাদ্যকেও প্যাকেটজাতকরণে পাটের বস্তা, চটের ব্যাগ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। 

পাটশিল্পের উন্নয়ন ও স্বল্প ব্যয়ের ঋণ প্রদানের জন্য ‘পাট খাত উন্নয়ন তহবিল’ নামে ১০০ বিলিয়ন টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠনের জন্য ২০১৮ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ে একটি সুপারিশ প্রেরণ করে। পাটশিল্পজাত দ্রব্যের বার্ষিক বিক্রয় মূল্য প্রায় হাজার ইউএস বিলিয়ন। সরকার ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে স্থানীয় পাটশিল্পে পাটের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে কাঁচা পাট ও অপ্রক্রিয়াজাত পাট রফতানি নিষিদ্ধ করে; কিন্তু পাট ব্যবসায়ী সংগঠন বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (ইঔঅ) দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের জুন মাসেই এ আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। 

২০১০ থেকে ২০১৯ সাল অবধি এই ১০ বছরে বিজেএমসি পাট খাতকে লাভের ঘরে আনতে পারেনি। ২০১০-১১ সাল বাদে (বিজেএমসি) প্রতি বছর বিরাট অঙ্কের ঘাটতি নিয়েই এগিয়েছে। ২০১৭ সালে ভারত বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানিকৃত চটের ব্যাগ, বয়নসুতা ও হেসিয়ান বস্ত্রের ওপর অন্যায্য অশুল্ক কর আরোপ করে। পরে ২০১৯ সালে এ পাটের বস্তার ওপর অশুল্ক করের পরিমাণ বাড়িয়ে ইউএস ডলার ১২৫.৩১/টন করা হয়। 

বাংলাদেশের পাটশিল্পের বিরুদ্ধে গৃহীত এ ধরনের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় বিজেএমসি শুধু তার উদ্বেগ প্রকাশ করেই ক্ষান্ত থেকেছে। শুধু এটুকুই বলে যে, ভারত যেহেতু পাট ও পাটসংক্রান্ত দ্রব্যাদির প্রধান ভোক্তা সুতরাং ভারতের এ পদক্ষেপ বাংলাদেশের পাটশিল্পকে ধ্বংস করারই শামিল। সরকার এর পাল্টা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বর্তমানে জনতা জুট মিল ও আফিল জুট মিল হলো ব্যক্তিখাতের বড় জুট মিল।

জিডিপির হিসাব অনুযায়ী কথিত ‘সবচেয়ে বড় ব্যক্তি খাত হলো বাংলাদেশের বহুল আলোচিত তৈরি পোশাক শিল্প; কিন্তু যে পোশাক শিল্প নিয়ে এত হৈ-চৈ প্রকৃত জিডিপিতে তার মূল্য সংযোজন কত? এসব প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণ করলে যেকোনো দেশপ্রেমিক লোকই এ শিল্পকে আজই তাড়িয়ে দিতে উদগ্রীব হয়ে উঠবেন। বিদেশি ক্রেতা ও আমাদের পোশাক শিল্পের মালিকরা যৌথভাবে এদেশের শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য শুধু নিষ্ঠুরভাবে লুণ্ঠনই করছে না, শর্তানুযায়ী বিদেশি ফ্যাব্রিক্সসহ আরো অনেক মালামাল যা মোট রফতানি মূল্যের ন্যূনতম ৭৫ শতাংশ, বিদেশ থেকে আনার ফলে আমাদের ওইসব মৌলিক শিল্প ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। 

শেষ অর্থবছরে তৈরি পোশাকের রফতানি মূল্য ছিল ২ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা (৩৪ বিলিয়ন ডলার), কিন্তু এর মালামাল আমদানি বাবদ, প্রধানত বস্ত্র আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। জিডিপিতে প্রকৃত সংযোজন মাত্র ৭২ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। অথচ জিডিপিতে যা দেখানো হয়েছে শতকরা ১৬.৩৭ ভাগ। আসলে জিডিপিতে প্রকৃত সংযোজন হবে ৪.১০ শতাংশ! 

পোশাক শিল্পের নামে এই হলো ব্যক্তিখাতের অভিলাষ, যা দেশের মৌলিক বস্ত্র খাতকে ধ্বংস করে দিয়েছে ও তা নিষ্ঠুরভাবে চলমান রয়েছে। শ্রমিক শোষণ আর দেশের মৌলিক বস্ত্রখাত ধ্বংস করে তৈরি পোশাক শিল্পের নব্য ধনী ব্যবসায়ীরা বিত্ত বৈভবের সায়রে সাঁতার কাটছে।

১ জুলাই ২০২০ সাল থেকে বন্ধ হয়ে গেল সরকার পরিচালিত সর্বশেষ পাটকলগুলো। এমন একটি সময়ে পাটকলগুলো বন্ধ করা হলো যখন পৃথিবীব্যাপী পরিবেশবাদীরা পরিবেশ রক্ষার তাগিদে পলিথিন ও সিনথেটিকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করছে; ইউরোপের ২৮টি দেশে একযোগে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছে; পৃথিবীর অনেক দেশ ইতিমধ্যে পলিথিনের ব্যবহার সীমিত করেছে। অবধারিতভাবে এতে পাট পণ্যের বিশাল বাজার তৈরির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের উচিত ছিল আমদানিকারকদের পছন্দ অনুযায়ী পাটপণ্য উৎপাদনের জন্য সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা। সাথে সাথে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় চাহিদা মোতাবেক সব ধরনের পণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা ও বৈচিত্র্য আনা। 

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশ, যেখানে শ্রম শক্তির প্রায় ৪৫% কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছে ও কৃষিতে অব্যবস্থাপনা, উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ না হওয়া, নিম্নমানের সার, বীজের ঘাটতি, উৎপাদিত ফসল দিয়ে নবোদ্ভাবিত দ্রব্য প্রস্তুতে পদক্ষেপের অভাবজনিত নানা কারণে পাটজাত দ্রব্যাদিসহ সবধরনের ফসল থেকে জিডিপির অংশগ্রহণ অনেক হ্রাস পেয়ে বতর্মানে প্রায় ১৮% ভাগে দাঁড়িয়েছে। এটা স্বীকৃত যে পাটই বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল। 

যদিও বিংশ শতাব্দীর ৫০ ও ৬০ দশকে প্লাস্টিক, নাইলন, সিনথেটিক ও অন্যান্য পরিবেশ বিনাশী দ্রব্যাদির ব্যবহার তেমনটা ছিল না ও অন্যান্য দেশে তেমন পাট চাষ না হওয়ার দরুণ পাট উৎপাদন, বিতরণ ও বাজারজাতকরণে বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) একক আধিপত্য বজায় রেখে চলছিল। কিন্তু এর মধ্যে কিছু কিছু দেশ যেমন ভারত, চীন, উজবেকিস্তান ও নেপাল পাট উৎপাদনে এগিয়ে আসায় বাংলাদেশ বিশ্বে পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদির রফতানিতে ৪০ শতাংশ অংশ নিয়েও শীর্ষে ও সমগ্র বিশ্বে ৩০ শতাংশ পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। দুর্ভাগ্য সেখানেই, বাংলাদেশ হচ্ছে এমন একটি অবিবেচক ও দুর্নীতিসম্পৃক্ত নেতৃত্বের দেশ, যাদের কাছে দেশ-জনগণের স্বার্থ গুরুত্ব পায় না। দেশের উন্নয়নে পলিসি গ্রহণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শুধু ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতায় থাকার জন্য এরা সাম্র্রাজ্যবাদীদের স্বার্থে দেশের নীতি নির্ধারণ করে থাকে। বিদেশি রাষ্ট্র ও এদেশের লুটেরা পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখতে গিয়ে পাটে কোনো মূল্য সংযোজন না করে, হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি না করে শুধু কাঁচা পাট রফতানি করেই শীর্ষ স্থান পেয়ে যাচ্ছে। 

আজ বিশ্বের সচেতন মানুষ প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ বিনাশী পলিথিন ব্যবহার পরিহার করে জীবাণুবিয়োজ্য পরিবেশবান্ধব, প্রকৃতিবান্ধব, আঁশ বা বস্ত্র তথা পাট ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দেশ পরিবেশবান্ধব তন্তু দিয়ে কি করে বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি করা হয় তা হন্যে হয়ে খুঁজছে, গবেষণা করছে, পাটকে আমলে নিয়ে নানারকম চিন্তা-ভাবনা করছে। অথচ আমাদের দেশে, দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে পাটকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া তো দূরে থাক, বরং নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এর উৎপাদন বৃদ্ধির যথাযথ কৌশল বাস্তবায়নের কোনো নীতিশুদ্ধ গবেষণা নেই, নেই উন্নত, লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে এর ব্যবহার বিস্তৃত করার কোনো পরিকল্পনা। পাট ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিস্তার ঘটিয়ে বিপর্যয় নয়, অর্থনীতিকে উন্নত স্তরে নিয়ে যাবার কোনো সোপান কি কোথাও দৃশ্যমান? এদেশ যেখানে সবচেয়ে উন্নতমানের ও সর্বোচ্চ পরিমাণের পাট উৎপাদনের গর্বিত মালিক হওয়ার কথা, সেখানে দীর্ঘদিন ধরে এখানকার সরকার ও নীতিনির্ধারকরা পাটের আরো উৎপাদন, পাটজাত দ্রব্যাদির বহুমুখী ব্যবহারের বিস্তৃতকরণ ও প্রসার ঘটানোর পদক্ষেপ হিসেবে পাটকে কৃষি পণ্য হিসেবে ঘোষণা দিতেও কার্পণ্য করেছেন। সম্প্রতি অবশ্য পাটকে কৃষিপণ্য বলে ঘোষণা দেওয়ার ফলে পাটচাষি ও শিল্প কারখানার মালিকরা উৎপাদন প্রণোদনা পেতে শুরু করেছেন।

পাটে মূল্য সংযোজন অনেক বেশি। শতকরা প্রায় ১০০ ভাগ। এতে কৃষকরা উপকৃত হওয়ার কথা। ব্যাপকসংখ্যক পাট, গাছ থেকে মাটিতে পড়ার ফলে এবং পাটগাছের শেকড় মাটির গভীরে ও চারদিকে বিস্তার লাভ করার ফলে জমির উর্বরতাশক্তি অনেক বৃদ্ধি পায়। বিগত দুই দশক আগে মনে হয়েছিলো সিনথেটিক বা নাইলন জাতীয় পরিবেশবিনাশী দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাটের উপযোগিতা হয়তো হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। অথচ চূড়ান্ত পর্যায়ে দেখা গেল সাশ্রয়ী, সহজপ্রাপ্যতা, নিম্ন-ঘনত্ব, জীবাণুবিয়োজ্য, নবায়নযোগ্য, পরিবেশ-বান্ধব, বহুমুখী ব্যবহারগুণসম্পন্ন হওয়ার কাণে পরিবেশসচেতন মানুষ জল-জমি-জনবান্ধব পাটের দিকে আরও বেশী করে ঝুঁকে পড়েছেন। ইত্যেমধ্যেই বিশ্বের উন্নত কিছু দেশ পাটের আঁশ দিয়ে নানান ধরনের বস্ত্র, আসবাবপত্র, ফ্যাশন দ্রব্যাদি, গাড়ির বডির অংশসহ অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বানানো শুরু করেছেন এবং তা বাজারজাতকরণও শুরু হয়েছে। 

অদূর ভবিষ্যতে বিশ্বে আরো বিপ্লবাত্মক নতুন উদ্ভাবনী কৌশলে যে সব দ্রব্য আসছে তা হলো অন্য দ্রব্য বা তন্তুর সংমিশ্রণে পাটের ব্যাপক ব্যবহার ও গণমানুষের ব্যবহার্য নিত্য নৈমিত্তিক সামগ্রী বানানোর নতুন নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করে পাটের ব্যবহারের বিস্তৃতি ঘটানো। এতে লাগসই প্রযুক্তি প্রয়োগ ও কৌশল নির্ধারণে গবেষণার বিস্তৃতি ঘটানো, প্রশিক্ষণ ও উৎসাহ প্রদান, উৎপাদন সহায়ক সরকারি নীতি, দেশ ও মানবপ্রেমী দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন কৌশল প্রয়োগে বুদ্ধি-জ্ঞান ও দেশপ্রেমের চেতনা সম্পৃক্ততার সমন্বয়ে একটি সৎ, নিষ্ঠাবান জনবান্ধব উদ্যোগ প্রয়োজন। 

এমন পদক্ষেপ ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে, যাতে পাট শিল্পের মাধ্যমে আমরা তৈরি পোশাক শিল্প কিংবা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের চেয়েও অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। এবং এটা সম্ভব। বর্তমান বিশ্বে পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে এবং জীবাণুবিয়োজ্য তন্তু ও পাট দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রায় তাবৎ জিনিস বানানো যায় বিধায় বাংলাদেশের জন্য এ ফসল প্রকৃত অর্থেই সোনালি ফসল। এটাই হলো একমাত্র উৎপাদিত প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব জৈবপণ্য; যা সরাসরি গাছের বাকল থেকে সংগ্রহ করে সর্র্বপ্রকার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করা যায়। আমাদের নতুন প্রজন্মকে এর অতীত ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়ের পুনরায় আগমনের কথা জানান দিতে হবে যে, পাট সত্যিকার অর্থেই সোনালি আঁশ। এবং এ সোনালি আঁশের প্রধান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে এক সম্পদশালী ও গর্বিত দেশের মালিক আমরা।

পাটের আঁশ প্রায় শতভাগ জীবাণু বিয়োজ্য ও পুনঃব্যবহার উপযোগী হয়ে থাকে। পাট চাষে একেবারে ন্যূনতম কীটনাশক ও সারের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ অধিক পাট উৎপাদনে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া প্রয়োজন তাও এক অতি স্বাভাবিক পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ। পাট এমন একটি ফসল যা চাল, ডাল বা মাছ জাতীয় খাদ্যপণ্য বা ভোগ্যপণ্য নয়। এটি মূলত রফতানিমুখী ফসল। আর স্থানীয়ভাবে যদি পাটকলগুলো জাতীয়করণ হয়, তাহলে পাটচাষিদের ব্যক্তিখাতের পাটকলের লুটেরা মালিকদের কাছে যেতে হবে না বিধায় কৃষক পাটের যথার্থ মূল্য পাবেন। সার্বিক বিবেচনায় এমন অবস্থায় পাট সময়মতো বিক্রি করতে পারলে কৃষক লাভবান হবেন। কাজেই দেশের সকল পাটকল জাতীয়করণ এবং একই সাথে চাষ আরও বাড়িয়ে রফতানি করাই হলো পাটের বাজারমূল্য ধরে রাখার সর্বোত্তম উপায়। 

এর পাশাপাশি নানা ধরনের পাটজাত দ্রব্যাদি বানাবার লক্ষ্যে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে হবে, পাটকলগুলোকে উন্নতমানের ও আধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে। পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটকে আরও উন্নত ও কার্যকর করে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটকে বিশ্বের একটি মানসম্মত শিক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। পাটবীজ ও পাট চাষে সবধরনের বাধা বিপত্তি অপসারণ করে নানারকম প্রণোদনা প্রদান করে সাশ্রয়ীমূল্যে কৃষি উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। পাটকে কেন অর্থকরী ফসল বলা হয়, নীতি নির্ধারকেরা কি তা জানেন? সারা বিশ্বের আশঙ্কাজনক পরিবেশ বিপর্যয়ের এ অবস্থায় পাট ও পাটজাতদ্রব্যাদি যে মানুষের কাছে দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য হিসেবে আবির্ভূত হয়ে উঠছে, নীতি নির্ধারকরা সে খবরও রাখেন কিনা সন্দেহ আছে।

আমাদের পরম সৌভাগ্য যে প্রাকৃতিকভাবেই আমরা এমন একটি উন্নতমানের অর্থকরী ফসলের উৎপাদনকারী গর্বিত দেশ। এ পাট দিয়ে শুধু স্বয়ম্ভর অথর্নীতি নয়, অর্থ আয়কারী একটি অন্যতম ধনী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে পারে। তখন কি এটা বিশ্বাস করা যায় যে রফতানি ও ব্যক্তিখাতের পাটকলের মালিকরা এ পাট কিনে কৃষককে তার প্রাপ্য ন্যায্যমূল্য দেবেন! শুধু অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে নয় বরং পাটশিল্পবিষয়ক যে কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমাদের বিবেচনা করতে হবে আমাদের কৃষির সার্বিক চাষ পদ্ধতি এবং উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ। কৃষিচাষে জমির উর্বরতা টিকিয়ে রাখার একটি কৌশল হলো শস্যক্রম (Grain Order)। কৃষক যখন পাট চাষ বন্ধ করে দেবেন তখন মাটির উপর নেমে আসবে ভয়ংকর নির্যাতন। এখন পর্যন্ত পাটের জমিতে যে শস্যক্রমগুলো অনুসরণ করা হয়, তাহলো- আগাম তোষা পাট-রোপা আমন-গম শস্যক্রম; দেশি পাট-রোপা আমন-গম শস্যক্রম; পাট-মুলা-লাল শাক-আলু-মিষ্টি কুমড়া শস্যক্রম; পাট-রোপা আমন-আলু-ডাটা শস্যক্রম। নীতিনির্ধারকরা না মানলেও কৃষক এবং কৃষিবিদরা জানেন শস্যক্রম চাইলেই ইচ্ছেমতো সৃষ্টি করা যায় না। শস্যক্রম নষ্ট হলে পাট চাষের আওতায় থাকা জমিগুলোর ঊর্বরা শক্তি কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে অন্য ফসল উৎপাদনের ওপর। ক্ষেত্র বিশেষে বেড়ে যাবে ফসল উৎপাদন খরচ। কমে যেতে পারে পাটচাষের আওতাভুক্ত লাখ লাখ হেক্টর জমির মোট ফসল উৎপাদন। 

আবার জমির উৎপাদনশীলতা বজায় রাখতে আমাদের শস্য আবর্তন (Crop Rotation) মানাটাও জরুরি। শস্য আবর্তন হলো একটি জমিতে রবি (১৬ অক্টোবর-১৫ মার্চ), খরিফ-১ (১৬ মার্চ-১৫ জুলাই), খরিফ-২ (১৬ জুলাই-১৫ অক্টোবর) এই তিন মৌসুমে একই ফসল বা একই গোত্রের ফসল চাষাবাদ না করে ভিন্ন ভিন্ন মৌসুমে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের ফসল চাষ করা। এর ফলে মাটিতে বিদ্যমান এবং প্রয়োগকৃত সকল স্তরের পুষ্টি উপাদানের সঠিক ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি ফসলের মাটিবাহিত রোগ, বীজবাহিত রোগ, পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হয়; মাটির গঠন উন্নত হয় সর্বোপরি কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসে।

এমনিতেই আমাদের মাটিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ কাক্ষিত মাত্রার চেয়ে বহুগুণে কম। যে কোনো ফসলের চেয়ে পাট গাছ থেকে অনেক বেশি পরিমাণ পাতা তৈরি হয় যা মাটিতে পুষ্টিউপাদান যুক্ত করে। অন্যদিকে এখনো প্রতি বছর লাখ লাখ টন পাটকাঠি জ্বালানি হিসেবে, ঘরের বেড়া তৈরিতে এবং চারকোল তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বছরে যে পরিমাণ পাটকাঠি কম উৎপাদন হবে সেই পরিমাণ বন ধ্বংস হবে জ্বালানি সরবরাহ করতে গিয়ে। 

পাট ও ছত্রাকের সাতটি জিনের পেটেন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী এই উদ্ভাবন থেকে কোনো আয় হলে তার একটি অংশ বা রয়্যালটি বাংলাদেশ পাবে বলে স্বীকৃত আইন আছে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, হংকং ও ইউরোপের ২৮ টি দেশ এই পেটেন্টকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এ প্রতিষ্ঠান কর্তৃক উদ্ভাবিত ৩৭টি প্রযুক্তির নাম, গুণাগুণ বৈশিষ্ট্য, শিল্পপর্যায়ে এসবের প্রতিফলনের তালিকার তথ্য দেওয়া আছে। 

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি হয় যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানা, রাশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ভারত, ব্রাজিল, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর প্রায় ১১৮টি দেশে। সার্বিক বিশ্লেষণ-বিবেচনায় এটি অনুমিত যে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে ‘তৈরি পোশাক শিল্প’র আয়কে পেছনে ফেলে আবারও দেশের প্রধান এবং বৃহত্তম খাত হিসেবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে দেশের পাটশিল্প। (চলবে)

লেখক: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //