৭ মার্চের ভাষণ একটি প্রতিজ্ঞার নাম

মার্চ বাঙালির জীবনে এক অবিস্মরণীয় মাসের নাম। একাত্তরের মার্চের ২৬ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। 

মার্চ মানেই বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার দুর্দমনীয় প্রতিজ্ঞার নাম। সেই একাত্তরের মার্চের বালকবেলার দিনগুলো মনে করলেই আমি দেখি গ্রামের পথে অগণিত মানুষের ঢল। শহরের মানুষগুলো প্রাণভয়ে ছুটে পালাচ্ছে শহর ছেড়ে গ্রামে। শহর ছেড়ে আসা একটি পরিবার সাময়িক যাত্রাবিরতি করেছিলেন আমাদের বাড়িতে সেই একাত্তর সালে। তাদের কাছেই শুনেছি ২৫ মার্চের কালরাত্রির কথা। ঘুমন্ত শহরের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্যাংক চালিয়েছিল। কামান, মর্টার, মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল অগুনতি মানুষের বুক। শহরটিকে পাকিস্তানিরা বধ্যভূমি বানিয়েছিল। 

সেই সময় শহর ছেড়ে আসা মৃত্যুভয়ে ভীত মানুষগুলোকে কত আপন মনে হয়েছিল। তাদের স্বজন বলে গ্রহণ করেছিল গ্রামের মানুষরা। তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। আমি রেডিওতে ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছিলাম ৮ মার্চের সকালে। আমার বালক মনে তখন বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ নিজের মতো করে স্বাধীনতাকে ভাবতে শিখিয়েছিল। আমরা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বন্দুক বানিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা খেলেছি। আর মার্চেই শুরু করেছিলেন আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সত্যিকারের যুদ্ধ। মার্চেই আমি প্রথম মুক্তিযুদ্ধের উত্তাপ অনুভব করেছিলাম। যে উত্তাপ ছড়িয়েছিল মার্চের ১ তারিখ থেকে। আমরা খেলার মাঠে, স্কুলে, বাজারে শুনতাম শেখ সাহেব এই দেশটিকে এবার নিশ্চিত স্বাধীন করবেন। তখনও বাঙালি কল্পনা করেনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভয়াল পঁচিশে মার্চের গণহত্যা ঘটাবে বাংলাদেশে। স্বাধীনতা নিয়ে বড়দের আলোচনা আমরা শুনতাম গভীর আগ্রহে। তাদের আলোচনা আমাদের মনে এই বিশ্বাস এনে দিয়েছিল যে, খুব শিগগির বাংলাদেশ নামের একটা স্বাধীন দেশ আমরা পাব এবং সেই প্রত্যাশিত স্বাধীনতা এনে দেবেন বাঙালি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

সেই সময়ে আমরা বড় ক্লাসের ছাত্রদের সঙ্গে মিছিল করেছি। ইতিহাসের কোনো জ্ঞান ছিল না; কিন্তু ছিল প্রবল আবেগ ও উৎসাহ। ওপরের ক্লাসের ছাত্রদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগান দিয়েছি, ‘ঢাকা না পিণ্ডি, ঢাকা ঢাকা’; ‘ইয়াহিয়ার বুকে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘পাকিস্তানি হানাদার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ ইত্যাদি। রাজনীতি বুঝতাম না; কিন্তু বুঝতাম সবাইকে এক হতে হবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। গ্রামের মুরব্বিরা বলতেন, ‘সাহস আছে শেখ সাহেবের।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শোনার আগে এভাবেই আমাদের মনে শেখ মুজিবুর রহমান মুদ্রিত হয়েছিলেন। 

লেখক: ড. আফসার আহমদ

সেই সময়ে শোনা ভাষণ আজও তেমন করেই জাগিয়ে তোলে, প্রাণিত করে বাঙালিকে। এখন বুঝি যে, একটি জাতির আশা-আকাক্ষা, আবেগ ও দ্রোহের প্রকাশ বলেই আজও বাঙালিকে সমানভাবে উদ্দীপ্ত করে ৭ মার্চের ভাষণ। বড় হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন কালের জননেতা কিংবা রাষ্ট্রনায়কদের যুগান্তকারী ভাষণ পাঠ করে এটা বুঝেছি যে, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল আধুনিক কবিতার মতো আবেগের সুতীব্র প্রকাশ এবং যে আবেগ মহান নেতার দীর্ঘকালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার পরিণত রূপ। জাতীয় জীবনের বেদনা, প্রেম ও দ্রোহ নিয়ে ৭ মার্চের ভাষণ তাই কবিতার মতোই। সহস্র বছরের ইতিহাসে পৃথিবীতে এমন ভাষণ, তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া সম্ভাবত খুব কম আছে। ধ্রুপদী গ্রিক কালের ইতিহাস ও সাহিত্য পড়তে গিয়ে এমন উদ্দীপক একটি ভাষণের কথা জেনেছি। এই ভাষণ দিয়েছিলেন প্রাচীন এথেন্সের রাষ্ট্রনায়ক পেরিক্লিস। তার হাতেই পরিপূর্ণতা পেয়েছিল প্রাচীন এথেন্সের গণতন্ত্র। প্রতিপক্ষ স্পার্টার বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ সৈন্যদের স্মৃতিতর্পণ উপলক্ষে ৪৩১ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে পেরিক্লিস জাতির উদ্দেশে তাৎক্ষণিকভাবে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। পেরিক্লিস খুব সহজেই জনগণের মন জয় করে নিতে পারতেন। কাব্যকলা, ভাস্কর্য ও দর্শন অর্থাৎ সুকুমার শিল্পের প্রতি তাঁর অপরিসীম আগ্রহ ছিল। তিনি মনে করতেন, জাতির সমৃদ্ধি শুধু সম্পদ নয়, সংস্কৃতিও বটে। বঙ্গবন্ধুর জীবনেও আমরা বাঙালি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব দেখি। বাঙালি জাতির কাছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে ৭ মার্চের ভাষণের মর্মবাণী পৌঁছে দিতে হবে। স্কুলে ও কলেজের পাঠ্য বইয়ে ভাষণকে অন্তর্ভুক্ত করা খুব জরুরি। কারণ বাঙালি জাতির প্রতি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক-নির্দেশনার দলিল এই ভাষণ। তিনি বাঙালির দীপ্তচেতনাকে প্রতিটি শব্দে ধারণ করেছিলেন বলেই ৭ মার্চের ভাষণ শুধু বাঙালির নয়, সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল।

এই প্রজন্মকে একাত্তরের মার্চকে জানতে হবে। তাদের জানা দরকার মুক্তিযুদ্ধের ৯টি মাস বাংলাদেশের মানুষ কি অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। মুক্তিযুদ্ধের, বঙ্গবন্ধুর ও মুক্তিযোদ্ধাদের কথা এবং পাকিস্তানিদের অত্যাচারের কথা নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মূল অবলম্বন করে সাংস্কৃতিক জাগরণ আনতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাঙালির সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে হবে। বিশ্বায়নের নামে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিনাশী কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। বিশ্বায়নের নামে বাংলাদেশের সামাজিক ও পারিবারিক এমনকি ব্যক্তিগত সম্পর্কও যে কলুষিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাঙালির সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে। তাই আমাদেরও একটি উদার ও নিরপেক্ষ; কিন্তু স্বদেশঘনিষ্ট সাংস্কৃতিক চেতনা বিকাশের মাধ্যমে পরিবর্তিত বিশ্বকে গ্রহণ করতে হবে। নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও বাঙালির সংস্কৃতিকে যত বেশি জানবে, তত বেশি সোচ্চার হয়ে উঠবে স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে। মার্চের দীপ্ত উচ্চারণ বাঙালির বুকের ভেতরে তৈরি করবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এক অভেদ্য দেয়াল। তাহলে আর কখনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটবে না আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে। কেউ কখনো সাহস পাবে না বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙতে। এ জন্য প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। বারবার, বহুবার বলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের কথা। বলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা। 

রবীন্দ্রনাথের ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার বেদনার পঙ্‌ক্তিমালা খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়– 

সংশয়ে তাকে আমরা অস্বীকার করেছি,

প্রেমে এখন আমরা তাকে গ্রহণ করব,

কেননা, মৃত্যুর দ্বারা সে আমাদের সকলের জীবনের মধ্যে সঞ্জীবিত।

সেই মহামৃত্যুঞ্জয়।

এই মহামৃত্যুঞ্জয় মানুষটি কোটি বাঙালিকে একাত্তরের মার্চের উত্তাল আবেগকে বুকের ভেতরে স্থান দিতে শিখিয়েছিলেন। আর এ জন্যই বিশ্বমানচিত্রে রচিত হয়েছিল বাংলাদেশ নামের এক অমর কবিতার। যে কবিতার রচয়িতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান স্বাধীনতা দিবসকে তাই আমি বঙ্গবন্ধুর সমার্থক দেখি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //