মুশতাকের মৃত্যু এবং অজানা ভয়

মৃত্যু শুধু বিক্ষোভ বা বেদনা তৈরি করে না, ভাবনারও জন্ম দেয়। মুশতাকের মৃত্যুও যেন তেমনি। এক অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠছে কি সবাই? ভয় পাচ্ছে সবাই। রাজা ও প্রজা, সবল ও দুর্বল উভয় প্রতিপক্ষই। 

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- সবল ভয় পায় বাঁধা পাবে বলে, দুর্বল ভয় পায় ব্যথা পাবে বলে; কিন্তু সবলের আঘাত করার ক্ষমতা আছে, দুর্বলের তা থাকে না। আঘাত সহ্য করতে করতে প্রবলের আঘাতের বিরুদ্ধে কখনো কখনো দুর্বল যে ঘুরে দাঁড়ায় বা প্রতিরোধ করে সে দৃষ্টান্ত কিন্তু কম নয়। আর এ ধরনের আঘাত সহ্য করেও যে দুর্বলেরা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাদের শক্তি কিন্তু শুধু দৈহিক বা সাংগঠনিক নয়, প্রধানত নৈতিক। যুক্তির ওপর ভর করে যে নৈতিক শক্তি গড়ে ওঠে, তা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে যে কোনো প্রবল শক্তিকে। এরা কখনো একা অথবা কখনো একত্রিত হয়ে যখন প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তখন যে কোনো প্রবল শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিতে পারে। যুগে যুগে এ রকম দৃষ্টান্ত আছে অনেক। প্রতিবাদ যেন প্রতিরোধে রূপ নিতে না পারে, সে ব্যাপারে শাসক সব সময় যে সতর্ক থাকে, তাই নয়- সন্ত্রস্তও থাকে। 

যেকোনো প্রতিবাদের শুরুতেই শেষ করে দাও বা অঙ্কুরে বিনষ্ট করে ফেল– এই নীতি অনুসরণ করে তারা একজনকে মারে আর বহুজনকে আতঙ্কিত করে। শাসন ক্ষমতাকে নিরাপদ রাখতে এই কৌশল চলে আসছে বহু দেশে, বহু দিন ধরে। 

কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে মুশতাক আহমেদের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে অনেকের মানসিক স্থিরতাকে। তার মৃত্যুকে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে হত্যা বলে মনে করছেন অনেকে। কারাগারে কোনো মৃত্যুই জবাবদিহিতার বাইরে নয়। ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কারাগারে মুশতাকের মৃত্যু কি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা? এক কথায় উত্তর হচ্ছে, না। কারাগারে প্রেরণ করা অর্থ কাউকে স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে শাস্তি দেয়া ও তাকে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে রাখা। মুশতাক ছিল রাষ্ট্রীয় হেফাজতে। তার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কোনো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে, চিকিৎসা করানো কারা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। নয় মাস ধরে মুশতাক কারাগারে। এই সময়কালে তেমন কোনো স্বাস্থ্য সমস্যার কথা কি কারাগার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন বা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছিলেন? উত্তর জানা নেই। এরপর আকস্মিকভাবে জানা গেল, মুশতাকের মৃত্যু সংবাদ। 

তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে; কিন্তু তার কথা বা লেখা রাষ্ট্রের কাছে কেন এত বিপজ্জনক মনে হলো, তা কিন্তু জানা গেল না। এর আগে ফেসবুক ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে কুমিল্লার নাসিরনগর, কক্সবাজারের রামু, পাবনার সাঁথিয়া, রংপুরে যে দাঙ্গা পরিস্থিতি ঘটানো হয়েছিল, তার হোতাদের বিচার আর শাস্তি কি হয়েছে? মুশতাকের লেখার ফলে তেমন কোনো পরিস্থিতি কি তৈরি হয়েছিল? সমাজের কোন অংশে অসন্তোষ ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, এটা জানার কৌতূহল মিটবে কীভাবে? 

কী লিখেছিলেন মুশতাক? কেন তার জামিনের আবেদন ছয়বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল? জামিন পাওয়ার অধিকার সবার– এ কথা আইন ও বিচার ব্যবস্থার সাথে যারা যুক্ত তারা সবাই জানেন ও হরহামেশা বলেন। মুশতাক জামিন পেলে রাষ্ট্র বা সমাজের কী বিপদ হতে পারতো বলে তার জামিন হয়নি, এসব জানার কৌতূহল সাধারণ মানুষের যেমন আছে, তেমনি এখন সরকার সমর্থক অনেকেই বলছেন মুশতাক কোনো লেখকই নন। বরং কয়েক দিন ধরে টেলিভিশন টক শোতে অনেকেই বলছেন, তিনি লেখক ছিলেন না। তার পরিচয় তিনি একজন ব্যবসায়ী। তাহলে তো বিষয়টি আরো গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল কেন তাহলে? চিরকুট লেখা, ফেসবুকে লেখা, কোনো ব্লগে লেখা, বক্তৃতা করা, তথ্য প্রকাশ করা ইত্যাদি রাষ্ট্রের কাছে বিপজ্জনক মনে হলেই কারও বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। বিপজ্জনক কিনা বা কতটুকু বিপজ্জনক তা নির্ধারণ করবে কে, আর শাস্তিই বা দেবে কে? কী লেখা ছিল তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগপত্রে? কিছুই জানা হলো না, শুধু জানা গেল মুশতাকের জামিনের আর প্রয়োজন নেই; কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মুশতাকের মৃত্যু প্রশ্ন করে যাবে বহুদিন। 

আইন নিজস্ব গতিতে চলে, আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এই কথাগুলো এখন কাউকে স্বস্তি দেয় না; কারণ কথাগুলো এখন আর সত্যকে প্রতিফলিত করে না। আইনের গতি কখনো রকেটের মতো দ্রুত আবার কখনো মনে করিয়ে দেয়, সেই পুরনো গরুর গাড়ির কথা। কার ওপর প্রয়োগ হবে, কে প্রয়োগ করবে তা দ্বারাই নির্ধারিত হয় আইনের গতি। আর ক্ষমতা সেটি টাকার বা রাজনৈতিক হোক তা দ্বারা নির্ধারিত হয় কতটা সমান বা অসমান হবে আইনের দৃষ্টি। 

মনে পড়ে জর্জ অরওয়েলের সেই ব্যঙ্গোক্তি– সবাই সমান, তবে কেউ কেউ একটু বেশি সমান; কিন্তু এই ভাবনা বিরাজ করলে সমাজে শুধু ভয়ের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় তাই নয়, সমাজের ভারসাম্যও বিনষ্ট হয়। আর ভারসাম্যহীন সমাজ মানে টলটলায়মান সমাজ। সেটি কি কারও কাম্য হতে পারে? চিরস্থায়ী ক্ষমতার স্বপ্ন দেখলে হয়তো অনেকেই এই পরিস্থিতির পক্ষে সাফাই গাইতে পারেন; কিন্তু তা কাউকে স্বস্তি দেবে না। 

মানুষের হাত, চোখ ও পা বাঁধা যায়; কিন্তু মন বাধা যায় না। চিন্তাকে আটকানো যায় না। সংবিধানে চিন্তার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ আরোপের নামে তা দেখা গেলেও যুক্তিটি সবসময় খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা এখন ভয় পাওয়া ও ভয় দেখানোর যুক্তিতে পরিণত হয়েছে। চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, সম্মতি উৎপাদন করার প্রক্রিয়া চলছেই সবসময়। তারপরও যদি চিন্তা কখনো শাসকদের বিব্রত করে, বিরক্ত করে বা প্রতিবাদের মনন তৈরি করে, তাহলে তা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আইনি বাধা তৈরি করার উদ্দেশ্যেই দমনমূলক আইন তৈরি করা হয়। আর যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেন, তারা সবসময় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার কথা বলেন। যে কারণে ব্রিটিশ পরাধীনতার আমলে ইন্ডিয়ান সেফটি অ্যাক্ট, পাকিস্তান আমলে ডিফেন্স রুল অফ পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা আন্দোলনের ৯ দফায় বলা হয়েছিল– ‘জরুরি আইন প্রত্যাহার, নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্য নিবর্তনমূলক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে।‘কিন্তু তা তো প্রত্যাহার হলোই না বরং স্বাধীনতার পর বিশেষ ক্ষমতা আইন, প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন অ্যাক্ট, সন্ত্রাস দমন আইনের প্রয়োগ আমরা দেখেছি। এখন দেখা যাচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ। 

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করার সময় থেকেই আশঙ্কা ছিল যে, এর প্রয়োগের নামে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হবে। কত আশ্বাস, সান্তনা আর প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে তখন; কিন্তু সংশোধনের আগে ৫৭ ধারা বলি আর সংশোধনের পরে ৩২ ধারা যেটাই বলি না কেন, খড়গ যে একটা ঝুলছে ঘাড়ের ওপর, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রবীর, কাজল, কিশোর শুধু আর নাম বা ব্যক্তি নয়, এ হলো সতর্কবার্তা। 

বলা হচ্ছে, আইনের প্রয়োগ আপেক্ষিক। সমাজে যে আপেক্ষিকতার চর্চা হয় তার উদাহরণের অভাব নেই। ঢিল ছুড়তে থাকা বালকদের কাছে যা খেলা, ব্যাঙের কাছে তা মৃত্যু যন্ত্রণা এত আমরা ছোটবেলায় পড়েছি। পড়েছি ছোটবেলায় আর তার বাস্তব প্রতিফলন দেখছি সারাজীবন! মুশতাকের মৃত্যুতে এর শেষ হবে না তা বলা যায়; কিন্তু কতজন আরো এর খড়গের নিচে পড়বেন তা ভেবে আশঙ্কা তো থাকছেই!

লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //