একাত্তর সালের দুঃসহ স্মৃতি

১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে জায়গা থেকে সারাঢাকা শহর উত্তাল হয়, সেখানে আমার থাকার কথা ছিল না; কিন্তু ঘটনাক্রমে আমি সেখানেই ছিলাম। ক্লাস নাইনের পরীক্ষা শেষ, দশম শ্রেণির ক্লাস সবে শুরু হয়েছে- এরকম একটা সময় ছিল আমার জীবনের একাত্তর সালের ১ মার্চ। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে যাওয়ার জন্য, বাসা থেকে কিছুটা হেঁটে এসে, রামপুরা সদরঘাট রুটে একটি ভাঙাচোরা বাসে উঠতে হতো। 

সেদিনও সেই বাসে উঠেই আমি কলেজিয়েট স্কুলের দিকে যাচ্ছিলাম। যাত্রাপথে তখনকার ঢাকার একমাত্র স্টেডিয়ামে কোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হচ্ছিল, তার সাজসজ্জা বাইরে। খেলা দেখার আমার কোনো পূর্ব পরিকল্পনাও ছিল না; কিন্তু মনে হয় স্কুলে যাবার চাইতে এটিই বেশি টানল আমাকে। আমি স্কুলে না গিয়ে বাস থেকে নেমে স্টেডিয়ামে ঢুকলাম খেলা দেখার জন্য। 

পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট খেলা ছিল। আমি যখন গ্যালারিতে বসলাম, তখন খেলা চলছে। পাকিস্তানের হানিফ মোহাম্মদ নামে একজন খুবই জনপ্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন। ছয়, চার পেটানোর জন্য তার খুব খ্যাতি ছিল। আরও ছিলেন ইন্তেখাব আলম। সম্ভবত হানিফ মোহাম্মদ বা ইন্তেখাব আলম তখন ব্যাটিং করছেন। ছয় হচ্ছে, চার হচ্ছে। সারামাঠে উল্লাস, পাকিস্তান টিমের পক্ষে। খুবই উৎসবমুখর একটা পরিবেশ ছিল। আমার ঠিক পেছনে এক লোকের কাছে রেডিও বাজছে। খেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে রেডিওতে খেলার ধারাবিবরণী শুনছেন। খুবই সিরিয়াস দর্শক। সেই রেডিও ধারাবিবরণীতে ১২টার খবরের বিরতি। তখনই মোড় ঘুরে গেল।

সেই খবরেই জানানো হলো যে, ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এই খবরের সময় ঢাকার সব চাইতে বেশিসংখ্যক মানুষের সমাবেশ ওই স্টেডিয়ামেই ছিল। শুনলাম; কিন্তু এর কী পরিণতি, কী তার তাৎপর্য- সেসব তখন আমার মাথায় ছিল না; কিন্তু ১০/১৫ মিনিটের মাথায় প্যান্ডেলের উল্টোদিকে দেখলাম আগুন। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুন আরও ছড়াল। সবার মধ্যে সাংঘাতিক অস্থিরতা। কিছুক্ষণ আগে যে টিমের জন্য স্টেডিয়ামের সব মানুষ উল্লসিত ছিলেন কিংবা তাদের সমর্থনে স্লোগান, হৈ চৈ নানা কিছু করছিলেন- সেই টিমের খেলোয়াড়দের দেখলাম তারা তাড়া করছেন। খেলোয়াড়রা দৌড়াচ্ছে, পেছনে দর্শকরা দৌড়াচ্ছে, ভালোবেসে নয় মার দেবার জন্য। 

ক্ষণিকের মধ্যেই পুরো স্টোডিয়ামের দৃশ্য বদলে গেল। কিসের খেলা, কিসের পাকিস্তান? তখন সরাসরি স্লোগান হচ্ছে- ‘বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। প্যান্ডেল ছিঁড়ে, বাঁশ-টাশ খুলে, আগুন লাগিয়ে ওইখান থেকেই মিছিল শুরু হয়ে গেল। স্টেডিয়ামে যারা এতক্ষণ ছিলেন ক্রিকেট খেলার দর্শক, তারাই হয়ে গেলেন মিছিলের প্রধান শক্তি। যেহেতু এতলোক ওইখানেই ছিল সুতরাং বড় মিছিল শুরু হলো ওখান থেকেই। জনতার মিছিল ঢাকা শহরে ঢুকল, ছুটতে থাকল। তারপরে হয়তো যোগ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আমিও যাচ্ছিলাম মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। এখন আর বলতে পারব না মিছিল কোথায় কোথায় গিয়েছিল। সারাদিন কাঁধে একটা বাঁশ নিয়ে কোথায় কোথায় গেলাম সেটি আর মনে নেই। যখন ফিরেছি বাসায় তখন সন্ধ্যা, কাঁধে সেই বাঁশ। বাসায় রাশভারী বাবার মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ। সারা ঢাকা শহর সেদিন ছিল মিছিলের শহর। প্রতিবাদের শহর। কারণ সংসদ অধিবেশনের তারিখ পেছাতে পেছাতে, সর্বশেষ এই পেছানোর মধ্য দিয়ে, জেনারেল ইয়াহিয়া সরকার একটি অবস্থান পরিষ্কার করেছেন যে, তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় না। 

১ মার্চ, ২ মার্চ এবং তার পর ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি এমন হলো যে, আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমান তখন সব তৎপরতার কেন্দ্রে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন একক নেতা হিসেবে আবির্ভূত। নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে এটা তার সাংবিধানিক এখতিয়ারও বটে। পাশাপাশি অন্যান্য নেতা ও দলও স্বাধীনতার সমর্থনে দাঁড়ালেন। যেমন- মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, সেই সময় সিরাজ সিকদারও পরিচিত হচ্ছেন বিশেষত বামপন্থীদের মধ্যে। তাঁরা সবাই ১ মার্চের পর সমর্থন দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগকে। সিরাজ সিকদার সে সময় লিফলেট দিয়ে আহবান জানিয়েছেন, সর্বদলীয় কমিটি গঠন করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামই হচ্ছে এখন প্রধান কাজ। 

৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন এরকমই আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম। সেই ঘোষণার জন্য ৭ মার্চের জনসভার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। আমিও তখন ৭ মার্চের জনসভায় যোগ দেওয়ার জন্য মনস্থির করেছি; কিন্তু সেরকম আগ্রহ প্রকাশের পর আব্বাসহ বড় যারা ছিলেন, তাঁরা মোটেই যেতে দিতে রাজি হলেন না এবং যেতে যাতে না পারি সেটি নিশ্চিত করলেন। যেতে পারলাম না। কথা ছিল রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ। শেষ মুহূর্তে রেডিও ঘোষণা করল যে, এটি সম্প্রচার করা হবে না। তারপর রেডিওতে বা অন্যান্য জায়গায় সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, আমরা পরে জেনেছি। রেডিও পরে রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করেছে সম্ভবত ৭ মার্চ রাতে বা ৮ মার্চ সকালে। আমাদের বাসায় একটি ফিতা ঘুরানো টেপ রেকর্ডার ছিল। মনে আছে আমি এবং আমার ভাইয়েরা মিলে ওই টেপ রেকর্ডারে বক্তৃতাটি রেকর্ড করেছিলাম। সেপ্টেম্বরের দিকে সামরিক বাহিনী যখন পাড়ায় বিভিন্ন বাসায় হামলা করছে, সেসময় আমার বড় বোন ওই ফিতা নষ্ট করে ফেলেন। সেই পর্যন্ত ছিল পুরো ভাষণটি। 

মার্চের প্রথম থেকেই পাড়ায় পাড়ায় লড়াইয়ের নানারকম প্রস্তুতি চলছিল। আমাদের পাড়ায় পল্লীমা সংসদ তখন দুই বছর বয়সী ছোট সংগঠন, সেখানেও এগুলো নিয়ে কথাবার্তা হতো। শেখ মুজিবুর রহমান বারবার বলেছেন অহিংস পথে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তর্ক-বিতর্ক ছিল অহিংস পথে; কিন্তু স্বাধীনতা আদৌ সম্ভব কি না, সশস্ত্র পথে হবে কি-না, সশস্ত্র পথে হলে কীভাবে লড়াই হবে, আওয়ামী লীগ আদৌ প্রস্তুত কী না- এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। আমার বা আমার মতো আরও অনেকের এগুলো নিয়ে জানা-বোঝা খুবই কম, তা সত্ত্বেও পরিস্থিতির কারণেই আগ্রহ ক্রমাগত বাড়ছে, জানা-বোঝার চেষ্টাও।

২৫ মার্চ রাতে যে ভয়ংকর পর্ব শুরু হলো তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা এই অঞ্চলের মানুষের ছিল না। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই পাড়ায় আমাদের বয়সীদের মধ্যে কিংবা আমাদের সিনিয়রদের মধ্যে রাতের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে উত্তেজনা ছিল, এবং আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, এই হামলা মোকাবেলা করতে হবে। সুতরাং প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রস্তুতিতো শত্রু সম্পর্কে ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। শত্রু পক্ষ কোন মাত্রায় আক্রমণ করবে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমাদের। 

আমাদের যারা সিনিয়র ভাই ছিল, যারা আমাদের গাইড করছেন, তারা তখন বলছেন যে, ব্যারিকেড দিতে হবে, যার যা অস্ত্র আছে তা নিয়েই রেডি থাকতে হবে। মনে আছে সন্ধ্যা ৬/৭টার সময় আমাদের ব্যারিকেড দেওয়া শুরু হলো। ব্যারিকেড মানে- আমাদের দৌড় আর কতদূর তখন? বাঁশ-টাশ আমাদের যা আছে তার সঙ্গে ইট, পাইপ ইত্যাদি জড়ো করে রাস্তার মধ্যে দাঁড় করানো হলো, সেই রাস্তার নাম এখন শহীদ বাকী সড়ক। এই বাকী আমাদের পাড়ারই বড় ভাই- যিনি ১৯৭১ সালে শহীদ হয়েছিলেন। এই রাস্তাটার ওপরেই আমরা ব্যারিকেড দিলাম। রাতে যদি অ্যাটাক হয় কে কী করবে- সে নিয়ে আমাদের আগাম চিন্তা ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছিল। কার কী ভূমিকা থাকবে, সেটিও ঠিক করা ছিল। কেউ ছাদ থেকে ঢিল মারবে, কেউ গরম পানি ফেলবে, কেউ এদিক থেকে হুইসেল দেবে। আমার ও আমার বড় ভাইয়ের উপর প্রথম দায়িত্ব ছিল, আনসার হেড কোয়ার্টার থেকে জোগাড় করা ছোট সাইরেন মেশিন দিয়ে ঘুরে ঘুরে সবাইকে জানাতে হবে যে, আক্রমণ শুরু হয়েছে। রাত সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার পরে যখন গোলাগুলি বেড়ে গেল, তখন বোঝাই যাচ্ছিল সামরিক বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। কাজেই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাইরেন মেশিন নিয়ে আমরা দু’জনে বের হলাম সবাইকে জানানোর জন্য যে, আক্রমণ শুরু হয়েছে। 

আসলে সাইরেন বাজানোটা অর্থহীন ছিল, কারণ ততক্ষণে প্রচণ্ড আওয়াজ শুরু হয়েছে। সাইরেন দিয়ে কাউকে জানানোর দরকার ছিল না যে, আক্রমণ হচ্ছে। এই মাত্রার ভয়াবহ আক্রমণ আসলে আমাদের কারও হিসেবের মধ্যেই ছিল না। কিছুক্ষণ যেতে যেতে সাইরেন দেওয়ার পর বুঝলাম আমরা আর অগ্রসর হতে পারছি না। ফিরে আসার চেষ্টা করছি, ফিরেও আসা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছিল, পাশেই যেন ভয়ংকর মাত্রায় গুলি হচ্ছে বা বোমা ফুটছে। আমরা কেউই জীবনে কোনো দিন এরকম আওয়াজ শুনিনি। সেই রাস্তার মধ্যেই আমরা দেখলাম ছাত্রনেতা দেলোয়ার হোসেন পারভেজ (তিনি স্বাধীনতার পরে মারা গিয়েছিলেন) অন্ধকারে ফেরত আসছেন। তাঁর হাতে একটি রাইফেল। তিনি রাইফেল নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রতিরোধ করবার চেষ্টায়। এসবই তখন অসম্ভব একটা ব্যাপার, তবুও এসব চিন্তা ও চেষ্টার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়, এগুলোই পুরো দেশকে লড়াইয়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত করেছিল। 

দেয়াল টপকে, বিভিন্ন বাড়ির ভেতর দিয়ে ঘরে ফিরলাম। আতঙ্কিত সবাই। ২৫ মার্চ সেই রাতে ঢাকা শহরে কেউ ঘুমাতে পারেনি। সবার মতো আমরাও একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে সেই রাত পার করলাম। ২৬ মার্চও তাই, দিবারাত্রি কারফিউ চলছিল। ২৭ মার্চ সকাল বেলা যখন কারফিউ একটু সময়ের জন্য শিথিল হলো, সেই সময় আমরা দেখলাম ঢাকা শহরের মানুষের দলে দলে আতংকিত যাত্রা। শুনলাম রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বস্তিতে ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড হয়েছে। সেই দিন আমরা রাস্তায় দেখছি মানুষ যাচ্ছে স্রোতের মত, সেই মানুষজনদের মুখেই শুনলাম যে, ‘খবর আসছে আর কোন অসুবিধা নেই, বাঙালি আর্মিরাও আমাদের সঙ্গে জয়েন করছে। যুদ্ধ শুরু হইছে।’

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //