বিরোধী দলের শূন্যস্থান ও হেফাজতীয় দুর্বলতা

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০১৪ সাল থেকে দৃশ্যত কোনো বিরোধী দল নেই বললেই চলে। আমরা বিরোধী দল বলতে বুঝেছি নয়াপল্টন থেকে মাঝে মাঝে রিজভী সাহেবের সংবাদ সম্মেলন, কখনো কখনো লন্ডন প্রবাসী তারেক রহমানের বক্তব্যের ভিডিও। বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা-তারেক পর্ব যখন ঝিমিয়ে আসছে, তখন বিভিন্ন ইস্যুতে কিছু নাম উঠে আসে। ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না, আ স ম আব্দুর রব থেকে শুরু করে জাফরউল্লাহ চৌধুরী, জোনায়েদ সাকি, ভিপি নূর—এরা প্রত্যেকেই রাজনীতির শূন্যস্থান পূরণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রেসক্লাবের সামনের মানববন্ধন থেকে শুরু করে টেলিভিশন টকশোতে তারা সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। কিন্তু কেউই সত্যিকার অর্থে জনসম্পৃক্ততা অর্জন করতে পারেননি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরোধী দলের চাহিদা ছিল ও আছে। কিন্তু বিরোধী দল হওয়ার দৌড়ে অনেকে থাকলেও পাবলিকের পালস বুঝে সত্যিকারের বিরোধী রাজনীতিটা করে উঠতে পারেনি কেউই। 

বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিরোধী দলে থাকার অভিজ্ঞতা অনেক। বিরোধী দলের জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের যে পারফরম্যান্স, তা কি অন্য কোনো দল আজ পর্যন্ত করতে পেরেছে? আপনারা যারা সরকার সমর্থক নন, তারা বলবেন সরকারের দমন-নিপীড়নের কারণে এখন কেউই বিরোধী দলের ভূমিকায় সফলতা দেখাতে পারছে না। উপমহাদেশের রাজনীতিতে সরকারি দল বিরোধী দলকে দমন করতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ কি দমন-নিপীড়নের শিকার হয়নি? শুধুমাত্র আশির দশকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছে। শত শত নেতাকর্মী এখনো পঙ্গুত্ব বহন করে আছে। কই, আওয়ামী লীগ তো মাঠ ছেড়ে যায়নি।

২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে কী করা হয়েছে, সারাদেশে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের উপর দিয়ে কী গেছে—তা সবারই কম বেশি জানা। দলটির প্রধান শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে উনিশবার হামলা করা হয়েছে। পৃথিবীতে এমন কয়জন নেতা আছেন, যাদের উনিশবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে? এরপরও শেখ হাসিনা মাঠ ছাড়েননি। ঠিক এ জায়গাতে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের সাফল্যের কাছে অন্য দলগুলো ম্লান।

মাহমুদুর রহমান মান্না থেকে জোনায়েদ সাকি পর্যন্ত যারা আছেন, তারা মূলত ‘শৌখিন রাজনীতিবিদ’। প্রত্যেকে রাজনৈতিক দলের নামে একেকটা ব্যানারের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এই দলগুলোর কয়েকটি বড় শহরের বাইরে কোনো অস্তিত্ব নেই, খেটে খাওয়া মানুষদের মধ্যে কোনো পরিচিতি নেই। এসব দলের প্রধানরা শুধু আলোচনায় থাকার জন্য কর্মসূচি দেয় কিন্তু তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে বলে মনে হয় না। এই জায়গা থেকে হেফাজতকে খানিকটা সফল মনে হয়েছিল। এই সফলতার একমাত্র পুঁজি ‘ধর্ম’। তাদের নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলোর বাইরে তাদের কোনো কর্মী না থাকলেও সরকারবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে তারা সমর্থন পেয়ে এসেছে।

হেফাজত আসলে কতোটুকু রাজনৈতিক দল, তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী, কাঠামো কী—এসব নিয়ে বিতর্ক আছে। তাদের নেতারা ওয়াজের মাইককে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করছে। এর ফলে রাজনীতি ও ধর্ম দুটোই বিতর্কিত হচ্ছে। ২০১৩ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রয়াত ও বর্তমান নেতারা বিভিন্ন ইস্যুতে এমন ফতোয়া দিয়েছে, যা সভ্যরাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়। অনেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন, হেফাজত কখনো না কখনো রাজনৈতিক দৌড়ে বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধী দলগুলোর তালিকায় নাম লিখাবে; কিন্তু কয়েকটি বিষয় প্রমাণ করে দিচ্ছে তা সম্ভব নয়।

হেফাজত কর্মীদের প্রধান রাজনৈতিক অযোগ্যতা—তারা অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ। সব রাজনৈতিক কর্মী কিছুটা আবেগ অন্তরে রাখে। কিন্তু হেফাজত কর্মীরা কোনো যুক্তির ধার ধারেনা। তারা যখনই কোনো কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়, তখন তারা প্রতিপক্ষকে ‘জারজ সন্তান’ বলে গালি দেয়। তাদের আরো কিছু গালির ধরন হলো—নাস্তিকের বাচ্চা, অবৈধ পিতার সন্তান, ছেঁড়া কনডমের ফসল, কনডম দুর্ঘটনায় জন্ম, পতিতালয়ে জন্ম। এরা কথায় কথায় ‘আল্লাহর কসম’, ‘খোদার কসম’ উচ্চারণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। এসব আচরণ তাদের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতারই পরিচায়ক।

তাদের আরেকটি বড় দুর্বলতা হলো—নেতাদের অন্ধ সমর্থন করা। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, দ্বিমত হলেই নেতাদের তীব্র সমালোচনা করে কর্মীরা। কখনো কখনো নেতারা কর্মীদের উপহাস থেকেও রেহাই পায় না। কিন্তু হেফাজতসহ বেশিরভাগ মৌলবাদী সংগঠনের কর্মীরা নেতা-সংগঠন-ধর্মকে এক করে ফেলেন। সামাজিক মাধ্যমে মামুনুল হকের সমর্থকদের মন্তব্য তেমনি ইঙ্গিত দেয়। তারা মনে করে, মামুনুল হক বেহেশতে যাওয়ার টিকেট দিতে পারেন। মামুনুল হকের বিরোধিতা করলে বেহেশতে যাওয়া যাবে না। এই অন্ধ আনুকূল্যই সংগঠনটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।

এমন অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার এবং সে দলকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক হতে হবে। আওয়ামী লীগের সাথে খেলতে হলে তাদের মতোই হতে হবে। রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার মতো বিচক্ষণ হতে হবে। মৌলবাদিতা, অন্ধত্ব ও বর্বরতাকে পুঁজি করে রাজনীতির মাঠে সাময়িক অস্থিরতা সৃষ্টি করা যায় কিন্তু সুদূরপ্রসারী কোনো লক্ষ্য অর্জন করা যায় না।


লেখক: আলী আদনান
অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //