করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে রাজনীতির জ্বলন্ত প্রশ্ন!

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সর্বনাশা রূপ নিয়ে দেখা দিচ্ছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। রোগী বাড়ছে, হাসপাতালগুলোতে, স্থান সংকুলান হচ্ছে না। মৃত্যু বেড়েছে। আবারও লকডাউনে চলে যেতে হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলাবলি করছিলেন, শীতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসবে। তা হয়নি, কমেই আসছিল। টিকা আসার পর মনে হয়েছিল, করোনা দুর্যোগ কাটিয়ে উঠছি আমরা; কিন্তু করোনা কোনো হিসাব মানে না। আবারও আমরা পড়ে গেলাম ভয় ও শঙ্কার মাঝে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর পর দুই বছর পাশাপাশি জাতির সামনে সমুপস্থিত হওয়াটাও জাতির জন্য বহু তাৎপর্যপূর্ণ। লক্ষাভিমুখী অগ্রসর হতে শপথ নেবে জাতি- এটাই তো ছিল কামনা; কিন্তু করোনা তাতে বাদ সাধলো; কিন্তু কেবল কি তাই! করোনারূপী সর্বনাশা ভাইরাস যে আছে আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতেও। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের শুরুতে ওই ভাইরাস জাতির ললাটে এঁকে দিয়েছে কলঙ্কের কালিমা। করোনাভাইরাস আর উগ্রতা দুই শত্রু  আজ জাতিকে ছোবল দিতে উদ্যত হয়েছে।

এপ্রিল মাস শুরু হয়েছে। মাসটি গৌরব ও তাৎপর্যের দিক থেকে বাঙালি জাতির কাছে নানা দিক থেকে অনন্য। আজ থেকে ৫০ বছর আগে বাংলা নতুন বছরের শুরুর এই মাসেই মুজিবনগরে প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৪ এপ্রিল কাকতালীয়ভাবে ঘটল দুটি ঘটনা। দিল্লিতে তাজউদ্দীন-ইন্দিরা বৈঠক আর সিলেট তেলিয়াপাড়ায় বাঙালি সেনাদের বৈঠক। দুটিরই লক্ষ্য বিজয় অর্জন পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে মুক্তিযুদ্ধ।

ওই দুই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় ১৭ এপ্রিল শপথ গ্রহণের ভেতর দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী; কর্নেল ওসমানী প্রধান সেনাপতি। ১০ এপ্রিল শিলিগুড়ি বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে এলো স্বাধীনতার ঘোষণা। এই দিনটি আরও একদিক থেকে অনন্য, যা স্বাধীনতার রাজনৈতিক ও সামরিক ভিত্তির সঙ্গে আইনি ভিত্তি রচনা করে। আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ, ১৯৭১ জারি করা হয়। এই আদেশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রজ্ঞা ও দুরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানেও তার সুযোগ্য সহকর্মীরা নানা ঝড়ঝাপটা বাধাবিঘ্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যে সব একসূত্রে গ্রথিত করে মুক্তিযুদ্ধকে ইস্পিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেয়।

সূচনালগ্নে রাজনৈতিক নেতৃত্বে জাতি যখন মুক্তিযুদ্ধ সফল করার কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত, তখন স্বাধীনতার শত্রুরা কিন্তু বসে ছিল না। ৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলায় অতিবাম নকশালপন্থীরা বৈঠক করে শেখ মুজিবকে ‘আমেরিকার দালাল ও সোভিয়েত সংস্কারবাদীদের ক্রীড়ানক’ বলে ‘দুই কুকুরের লড়াই’ তত্ত্ব সামনে রেখে স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতায় শামিল হয়। ৭ এপ্রিল বিমানে দুই ডিভিশন সৈন্য নিয়ে আসে হানাদার সরকার। ১৩ এপ্রিল ‘বহিরাক্রমণ থেকে পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষায়’ শামিল হয় চীন। ১৪ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় শান্তি কমিটির উগ্র মিছিল। যার পুরভাগে থাকে গোলাম আজম প্রমুখ। ভিত্তি জোগায় রাজাকার-আলবদর-আল শামস বাহিনী গঠন করার। আর ওই সময় দুর্ভাগ্যজনকভাবে ‘ধূর্ত’ মোশতাক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বসেন।

তখনকার বিশ্ব ও উপমহাদেশের পরিস্থিতি ছিল আজকের চাইতেও সম্পূর্ণ বিপরীত; শান্তি-মুক্তি-স্বাধীনতা- সমাজতন্ত্রমুখী। তবুও শত্রুরা যার যার অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে। পরাজিত হয়েছে ডিসেম্বরে, দেশ স্বাধীন হয়েছে; কিন্তু যেমন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদানকারি জাতীয় চার নেতা, তেমনি বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুও রেখে দিলেন ‘ধূর্ত শত্রু’ মোশতাককে মন্ত্রিসভায়। কেন? স্বাধীনতার পর ওই খুনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হয়ে হলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। ভাবা গেল বাঁচা গেছে; কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্য সংকটের মধ্যে বাণিজ্য দিয়েই এলো আঘাত। উগ্রবাম-প্রতিক্রিয়াশীল ডান তখন ছিল প্রকাশ্যে গোপনে, দুই চরম প্রান্ত যেমন একসঙ্গে থাকে তেমনি থাকে জড়াজড়ি করে। রসুনের গোড়াসম ওই গোষ্ঠীর পাকিস্তানি কানেকশন আজ ইতিহাসে প্রমাণিত।

স্বাধীনতার পর রাজনীতি-কূটনীতি ও বাস্তবতার নানা টানাপড়েনে সবুর খানরা পর্যন্ত মুক্ত হয়েছিল। তখনকার রাজনৈতিক দৃশ্যপট আর এখানকার বাস্তবতায় আছে বড় রকমের এক পার্থক্য। বিশ^ উপমহাদেশ দেশ-সর্বত্র গণমনস্তত্ত্বের দক্ষিণমুখী অধোগতি। আমাদের দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা যতটা গণসম্পৃক্ত, তৃণমূলে যতটা নিজেদের দিকে সাধারণ মানুষকে টানতে পারছে; সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দল-সংগঠন কি ততটুকু গণসম্পৃক্ত, মানুষকে কি ততটুকু টানতে পারে? হেফাজত যখন রাস্তায় নামে, সব লণ্ডভণ্ড করে দিতে থাকে; তখন কি এর প্রতিরোধ করতে গণমানুষ নামে! পুলিশের ছত্রছায়ায় জনগণকে না নিয়ে দলীয় কর্মীরা নামলে তো হবে না। হিতে বিপরীত ফল হবে।

পারতো কি এমন ষাটের দশকে উগ্রবাদীরা! এটা আবারও প্রমাণিত, রাজনৈতিক সমস্যা রাষ্ট্রীয় শক্তির জোর দিয়ে সমাধান করা যায় না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন প্রবাস থেকে ফিরে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন, তখন কথাটি জোর দিয়ে বলতেন। স্বাধীনতার আগে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমাদের জাতীয় নেতারা তেমনটাই বলে জনগণকে লক্ষ্য অর্জনে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু ‘কুলে বসে কত গণিব ঢেউ/দেখিয়াছি শত দেখিব এও/নিঠুর বিধির লীলা কতই/কই রে আগের মানুষ কই?’

তবুও বলব রক্ষা! ২০০১-২০০৬ এর মতো বিএনপি-জামায়াত-ইসলামী ঐক্যজোট-বিজেপি জোট সরকার ক্ষমতায় নেই। ঘাতক-দালালদের গাড়িতে বাড়িতে এখন জাতীয় পতাকা ওড়ে না। বঙ্গবন্ধুর হত্যা- দিবসে ঘটা করে জন্মদিনের বয়সভিত্তিক ওজনের কেক কাটা হয় না। কথায় কথায় মুরতাদ ঘোষণা নেই।

কিন্তু নতুন রূপে গজিয়ে উঠেছে হেফাজত। শাপলা চত্বরের সেই তা-বের পর আবারও মাঠে নেমেছে। মাঝে নিজেরা দুইভাগ হয়ে গাছেরটা খেয়েছে, এখন তলায় কাঁটা বিছাচ্ছে। থানা থেকে লাইব্রেরি প্রভৃতি সব ধ্বংস করতে নেমেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙছে, মুর্যাল ক্ষত-বিক্ষত করছে। নেতার চরিত্র স্খলনের ঘটনায় ওদের কিছু আসে যায় না। নেতা তরুণীসহ রিসোর্টে জনতা কর্তৃক ধরা পড়ার পরও প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। অনৈতিক কাজে নেতা আটক হয়েছে শুনে সুনামগঞ্জের ছাতক থানা আক্রমণ করে ৭জন পুলিশ সদস্যকে আহত পর্যন্ত করেছে। এখন এটা আবারও সত্য বলে প্রমাণিত হলো, দুধ-কলা দিয়ে সাপ পুষলেই তার বিষাক্ত ছোবল একটুও কমে না। বরং তেজ আরও বাড়ে।

এটি তো বাস্তব সত্য যে, দেশ আজ রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নের মহাসড়কে। ৩ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ‘বাজেট ২০২০-২০২১ : দ্বিতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সমষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ’ সংক্রান্ত প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন, ‘মাথাপিছু জাতীয় আয় বাড়ছে, প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক, মূদ্রা বিনিময়ের হারে স্থিতিশীলতা ও মূদ্রাস্ফীতির নিম্নমুখী প্রবণতা নির্দেশ করছে- আমরা করোনাকালীন অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠে সমৃদ্ধির ধারায় ফিরে আসতে সক্ষম হবো।’ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলোও সেই কথাই বলে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আবার কি অবস্থায় বিশ্বকে ফেলে, তা বোধকরি ত্রিকালদর্শী ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাও বলতে পারবেন না। প্রসঙ্গত অর্থনৈতিক ক্ষেত্র অগ্রগতি-সমৃদ্ধি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকতেই পারে। তবে এটা ঠিক, এক্ষেত্রে ভরসার জায়গা অবশ্যই রয়েছে। 

দেশের সমস্যার মূল হচ্ছে রাজনৈতিক। জমায়েতের শক্তি-সামর্থ নিয়ে হেফাজত রাষ্ট্রশক্তিকে, সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। ক্রমেই রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠছে। বিএনপি-জামায়াতের জায়গাটা পূরণ করছে। আওয়ামী লীগের ডানে হেফাজত নেতাদের উগ্রতার কারণে প্রচণ্ড ধ্বংসাত্মক শক্তি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর পরিণতি কি তা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এর মতোই বলা কঠিন। সরকারবিরোধী বামশক্তি গণশক্তি বিবেচনায় অতি দুর্বল বটে। প্রায় নিঃশেষিত। এই শক্তি হেফাজতের বিরোধীতা করছে এটাও সত্য।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকার যখন পুলিশি অ্যাকশন নিচ্ছে, তখন অতিবাম ও উগ্রডান নির্যাতনে এক হয়ে প্রতিবাদ করছে। এটি কি রোমান প্রবাদ বাক্য ও বহুল ব্যবহৃত দুই চরমপ্রান্ত এক হওয়ার কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে না? 

 এদিকে করোনার ঢেউ যত বাড়বে, ততই প্রথম ঢেউ কীভাবে কত উঠতি-পড়তি প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে কাটানো হয়েছিল, একটি লোকও যে না খেয়ে মরলো না, টিকা যে আমরা কতক উন্নত দেশের চাইতেও আগে পেলাম; তা ছাপিয়ে সমালোচনা বাড়তে থাকবে। ইতোমধ্যে এই লক্ষণ সুস্পষ্ট। তাই নানা দিক থেকে চাপে থাকবে সরকার ও সরকারি দল।

এদিকে সাংগঠনিক দিক থেকে আওয়ামী লীগ তৃণমূলে কতটা সমস্যায় রয়েছে, তা সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাপ্রবাহ থেকে সুস্পষ্ট। ক্ষমতায় স্বাদ পেয়ে ভেতরে ভেতরে যে ঘুণে ধরেছে, তা প্রকাশিত ঘটনাপ্রবাহ থেকে অনেকটা সত্য বলেই প্রতিভাত হচ্ছে। দেখতে দেখতে সরকার মেয়াদকালের অর্ধেক সময় পার হতে চলেছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে জাতীয় চার মূলনীতি সম্মুন্নত রেখে গণতন্ত্রকে সুরক্ষা ও অগ্রসর করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, সেটিই করোনা দ্বিতীয় ঢেউ ও মুজিববর্ষ-স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী পালনের দিনগুলোতে জলন্ত প্রশ্ন!

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //