রাতারগুল বন কি টিকে থাকবে?

বাংলাদেশে একমাত্র টিকে থাকা জলাবন রাতারগুল নিয়ে আবারো তর্ক উঠেছে। এই জলাবনে যাওয়ার তিনটি রাস্তার একটি রাতারগুল গ্রামের পাশে। 

পর্যটন উন্নয়ন করপোরেশনের অর্থায়নে স্থানীয় প্রশাসন এখানে পাকা সড়ক নির্মাণ করছে। পাকা সড়ক যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকে বনবিভাগের সংরক্ষিত এলাকা শুরু। যানবাহন পার্কিংয়ের জন্য এখন সংরক্ষিত বনের জায়গায় নির্মাণ চলছে ইট-কংক্রিটের স্থাপনা। 

২০২১ সনের ১২ জানুয়ারি রাতারগুল গ্রামের মানুষ এই পার্কিং স্থাপনার বিরোধিতা করে নির্মাণ বন্ধের দাবি তোলেন। গ্রামবাসীর প্রতিবাদের মুখে নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে ফেললেও মাটি খোঁড়ার কাজ বন্ধ করেনি শ্রমিকরা। 

এবারই প্রথম নয়, এর আগেও এই সংবেদনশীল বনে ওয়াচটাওয়ারসহ বেমানান স্থাপনা নিয়ে তর্ক তৈরি হয়। পরিবেশপ্রেমীদের প্রতিবাদের মুখে পরবর্তীতে এমন স্থাপনা নির্মাণ থেকে সরে আসে কর্তৃপক্ষ। এর আগে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের বালিশিরা পাহাড় বাঁচাতে জীবন দিয়েছিলেন সালিক ও গণি। মৌলভীবাজারের জুরীতে ফুলতলা টিলা রক্ষায় জীবন দেন অবিনাশ মুড়া। মাধবকুণ্ড ও মুরইছড়া ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনের কথা আমরা জানি। হাওরাঞ্চলে ভাসান পানির আন্দোলন জলাবনের সুরক্ষার রাজনৈতিক প্রশ্ন তুলেছিল। সিলেটের জকিগঞ্জে বরহল ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ বাঁধপ্রকল্পের বিরোধিতা করে জীবনবাজি রেখে আন্দোলন শুরু করেন।

১৯৯৩ সনের ২৬ জুলাই কুশিয়ারা নদী রক্ষায় জীবন দেন চারজন গ্রামবাসী। এর আগেও রাতারগুলের মানুষেরা এই বনে স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করেছেন। এছাড়া প্রাকৃতিক বনের ভেতর রাস্তা ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে গ্রামবাসী ও বনবিভাগও দেশের নানা জায়গায় বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। কক্সবাজারের দক্ষিণ বনবিভাগের আওতাধীন টেকনাফ উপজেলার জাহাজপুরা সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৩৬টি প্রবীণ গর্জন বৃক্ষের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিল স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদফতর। এলজিইডি ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে টেকনাফের সদর উপজেলা থেকে বাহারছড়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ কি.মি. দীর্ঘ এক সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল। বনবিভাগ ও স্থানীয় গ্রামবাসীর বাধার মুখে এই রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প পরবর্তীতে বদলাতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।

লেখক: পাভেল পার্থ

বনের মানুষ, বননির্ভর মানুষ সবসময় বন চায়। কোনো উন্নয়নপ্রকল্প কি বাণিজ্যিক মুনাফায় বনের কোনো ক্ষতি হোক তা মানুষ চায় না। আর তাই রাতারগুল গ্রামবাসী এই নিদারুণ করোনাকালে দেশের একমাত্র জলাবনকে বুকে আগলে দাঁড়ালেন। রাষ্ট্রকে রাতারগুল গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে, বনের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও মমতাকে বুঝতে হবে। অবিলম্বে পার্কিংসহ রাতারগুলে সবধরণের বেমানান স্থাপনা বাতিল করতে হবে। 

কেবল বাংলাদেশ নয়, মিষ্টিপানির জলাবনের বিস্তার দুনিয়ায় খুবই কম। টিকে আছে প্রায় ২৩টির মতো মিষ্টিপানির জলাবন। ভূগোল ও বাস্তুসংস্থানের অবস্থান সাপেক্ষে দুনিয়ার সকল মিষ্টিপানির জলাবনগুলো চারটি প্রধান প্রতিবেশ অঞ্চলে বিন্যস্ত। আফ্রোট্রপিক, অষ্ট্রালাশিয়া, নিওট্রপিক ও ইন্দোমালয়া। বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ভারত, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার জলাবনগুলো ইন্দোমালয়া প্রতিবেশ অঞ্চলের। বনবিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী রাতারগুল এক চিরসবুজ মিষ্টিপানির জলাবন। সিলেট বনবিভাগের উত্তর সিলেট রেঞ্জ-২ এর অধীন এই বনটির আয়তন প্রায় ৩,৩২৫.৬১ একর। এর ভেতর মাটিতে জন্মানো উদ্ভিদবৈচিত্র্যসহ বনের ৫০৪ একর জায়গাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি অংশটুকু জলাভূমি ও কিছু উঁচু অঞ্চল। প্রশাসনিকভাবে বনটি সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নে পড়েছে।

রাতারগুল বনের বৈশিষ্ট্যময় অবস্থানই এর বাস্তুতন্ত্রকে সংবেদনশীল ও জটিল করে তুলেছে। কারণ এই বনটি পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপ্রবণ অঞ্চল উত্তর-পূর্ব ভারতের চেরাপুঞ্জির কাছাকাছি। বনের একদিকে মেঘালয় পাহাড়। যে পাহাড় থেকে নেমে আসা শতসহস্র জলধারা গড়িয়ে গেছে এই বনের তল দিয়ে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বিন্দু বিন্দু জলকণা জমেই তৈরি হয়েছে নানা পাহাড়ি ছড়া, ঝর্ণা ও নদী। মনতডু, লামু ও উমসরিয়াং এমনি সব পাহাড়ি নদী। আর এসব নদীই ভাটিতে নেমে বাংলাদেশের রাতারগুল বনের কাছে সারী-গোয়াইন নামে প্রবাহিত হয়েছে। এছাড়াও রাতারগুলের দক্ষিণে নেওয়া হাওর ও শিমুল হাওরের অবস্থান। 

বর্ষার বৃষ্টি, হাওর জলাভূমি আর উজানের পাহাড়ি নদী এসবই রাতারগুল বনকে জলাবনের বৈশিষ্ট্য দিয়েছে। বিকাশ করে চলেছে এর বৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান। বর্ষাকালে এই বনের প্রায়টাই জলমগ্ন হয়ে পড়ে, কোথাও কোথাও ২০ থেকে ৩০ ফুট পানি। আবার শীতকালে সবই শুষ্ক ও ক্ষীণ পানিপ্রবাহ। জল কাদাময় এক অন্যরকম প্রতিবেশ। বর্ষা আর হেমন্তে রাতারগুলের দুই ভিন্ন রূপ প্রবলভাবে প্রকাশিত হয়। উদ্ভিদ ও প্রাণিকুলের অবস্থানগত, সংখ্যা ঘনত্ব ও বিচরণও তখন ভিন্নতা তৈরি করে। 

রাতারগুলে আগের দুটি জলাধার আছে। পরবর্তীতে ২০১০-২০১১ সনে ৩.৬ বর্গ কি.মি. খাল খনন করা হয়। এসব জলাধার ও খালে পানির সঞ্চারণ শীতকালেও থাকে। আর তখনি রাতারগুল হয়ে ওঠে পরিযায়ী পাখিদের এক প্রিয় আবাসস্থল।

মোটাদাগে রাতারগুল তিন স্তরের বন। বৃক্ষ প্রজাতি, মূর্তা ও বনতলের লতাগুল্ম। রাতারগুলের বৃক্ষ চাঁদোয়া খুব উঁচু নয়। দেখা গেছে তা প্রায় সর্বোচ্চ ৪৯ ফুট। রাতারগুলের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো জলমগ্ন জলাভূমির নানান স্তর। কারণ সবচে’ উঁচু বৃক্ষের পাতা কি ফল জলে পড়ার পর তা মাছ, পতঙ্গ ও অণুজীবেরা গ্রহণ করে। পানি থেকে মাটি ও মাটি থেকে বৃক্ষ এই বনে প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদক এবং সরবরাহকারীদের বৈচিত্র্য অনেক। বানর, পাখি, কাঠবিড়ালি এরা উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। আবার সাপ, বেজি, গুইসাপ, ভোঁদড়, মেছোবাঘ, শিয়াল এই বনের বাস্তুসংস্থানের উঁচু সারির খাদক। একটি সময় এই বন জুড়ে ছিল চিল ও শকুন। শকুনহীনতা এই বনের খাদ্যশৃঙ্খলাকে আঘাত করেছে। তারপরও বন টিকিয়ে রেখেছে নানামাত্রার খাদ্যশৃংখলের ভেতর দিয়ে এক জটিল খাদ্যজাল। 

দেখা গেছে রাতারগুল বনে প্রায় ৮০ প্রজাতির উদ্ভিদ টিকে আছে। করচ ও মূর্তা প্রধান হলেও হিজল, কদম, বরুণ, পিঠালি, ছাতিম, জারুল, গুটিজাম, বট, নানা জাতের ফার্ণ, ছত্রাক, শৈবাল, লাইকেন, অর্কিড ও লতাগুল্ম মিলেই এই বনের উদ্ভিদবৈচিত্র্য। রাতারগুল মাছ ও পাখিদের এক বিস্ময়কর সংসার। একটি সময় রাতারগুল আইড় ও কালবাউশের জন্য খ্যাত ছিল। পাবদা, টেংরা, খলিশা, রিঠা, মায়া, রুই, পুঁটি, কাংলা, বাইম, গুতুম, ভেদা, বাচা, পটকা মাছেদের অস্তিত্বও আজ সংকটময়।

নানা জাতের বক, ঘুঘু, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, টিয়া পাখিদের এখনো কিছুটা দেখা যায়। ঢোঁড়া, দাঁড়াশ, শংখিনী, কালঢোঁড়া সাপগুলো এখনো কিছু টিকে আছে। তবে ভোঁদড় ও অজগর একেবারেই নিখোঁজ। প্রজাপতি ও পতঙ্গের বৈচিত্র্য এতটা না হলেও জলবাসী পতঙ্গ ও জোঁক এখানে অনেক। কাঁকড়া, ব্যাঙ, গিরগিটি, শামুক, কেঁচো এখনো লড়াই করেই টিকে আছে; কিন্তু নিদারুণভাবে নিরুদ্দেশ হয়েছে নানা জাতের কাছিম ও কচ্ছপ। 

রাতারগুল বন বিষয়ে রাষ্ট্র প্রশ্নহীন কায়দায় উদাসীন। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (নিরাপত্তা ও সংরক্ষণ) আইনেও এই জলাবন সুরক্ষায় কোনো সুস্পষ্ট ধারা নেই। স্থানীয়, রাষ্ট্রীয় আর আন্তঃরাষ্ট্রিক নানান আঘাতে বনের সংবেদনশীলতা আজ চুরমার। রাতারগুলসহ প্রায় সব ‘গুল’ অঞ্চলের সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে সিলেটের আদিবাসী লালেংদের। লালেংদের নাফাং লারাম পূজাসহ বাৎসরিক শিকারের জন্য রাতারগুল তাদের কাছে এক পবিত্র বনস্থল; কিন্তু আজ লালেংরা তাদের আপন টিলাভূমির মতো এই বনভূমি থেকেও উচ্ছেদ হয়েছে; কিন্তু রাতারগুল নিয়ে এর চারধারের বাঙালি, লালেং, খাসি, জৈন্তিয়া ও চাবাগানের আদিবাসীদের লোকায়ত বিজ্ঞান এই বন সুরক্ষায় রাখতে পারে জোরদার ভূমিকা। 

রাতারগুলের গ্রামবাসীদের অরণ্যপ্রেম জাগ্রত থাকুক, ছড়িয়ে পড়ুক দেশময়। আর এভাবেই সহস্র দ্রোহ আর মমতার মুকুলে রাতারগুল বিকশিত হোক এক অনন্য জলাবন হিসেবে।

লেখক : প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ক গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //