নববর্ষ আবহমান বাংলার প্রাচীন উৎসব

বাংলা নববর্ষের শেকড় এ দেশের মাটির গভীরে পোতা। এটি সর্বজনীন ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী, পেশা নির্বিশেষে সবার। ধর্মীয় উৎসবের বাইরে দিনে দিনে নববর্ষ যাপনের দিনই বড় হয়ে উঠেছে আমাদের সামাজিক জীবনে। 

বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বাকিটা ধর্ম নিরপেক্ষ। বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো বেশ শুদ্ধচারী ও রক্ষণশীল বিধায় সেগুলোকে অবলম্বন করে সর্বজনীন সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রশ্রয় পায়নি। গ্রামে ঈদে একটি মেলা বসলেও তার স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। বাঙালি প্রগতিশীল মুসলমান হয়তো তারই ক্ষতিপূরণ করছে সেক্যুলার উৎসবগুলোতে নতুন মাত্রা যোগ করে। 

‘গ্রহণ, বর্জন, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে সর্ব সাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, নববর্ষ পালনের এই গড়ে ওঠা কাঠামোর সংস্কৃতি বলতে গেলে একাধিপত্য।’ (জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী; নববর্ষের চেতনা)। 

জেমস জর্জ ফ্রেজার ‘দ্য গোল্ডেন বাউ’ গ্রন্থে ধর্মীয় ও লৌকিক ক্রিয়ানুষ্ঠানকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন- একটি অনুকরণমূলক এবং অপরটি সংক্রামক। পহেলা বৈশাখ এখন অনুকরণ ছাপিয়ে বলতে গেলে হয়ে উঠেছে সংক্রামক। 

বাংলা নববর্ষ পালনের বর্তমান কাঠামো সে অর্থে সনাতন নয়। সনাতন শুধু মেলা অংশটুকু। এটা বাদ দিলে বাকি সবটাই নতুন। এই নতুন অংশটিও এক জায়গায় বাধা পড়ে নেই। পূর্ব নির্ধারিত আঙ্গিকে নেই। এর মধ্যে অনবরত গ্রহণ বর্জন প্রক্রিয়া অব্যহত আছে। ঠিক যেমন সামগ্রিক ও পরিবর্তনশীল আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে আছে এই প্রক্রিয়া। 

শহরের শিক্ষিত মানুষ, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মানুষ পুনরায় আবিষ্কার করেছে নববর্ষকে। কারণ শহরের খেটে খাওয়া মানুষের কাছেও গ্রামের প্রান্তিক মানুষের মতো একটি দিনের সঙ্গে আরেকটি দিনের পার্থক্য খুব কম। শহরের মধ্যবিত্তরা নববর্ষকে পুনরাবিষ্কার করেছে তাদের প্রয়োজনে। এই পুনরাবিষ্কার বিষয়টি মোটেই নেতিবাচক নয়। এর একটি গঠনমূলক ও ইতিবাচক অভিগাত রয়েছে যা প্রভাবিত করেছে আমাদের জাতীয় চিন্তাকে এবং আমাদের সংস্কৃতি ভাবনাকে। কিন্তু মধ্যবিত্ত যেহেতু পুনরাবিষ্কার করেছে দিনটিকে সুতরাং এর মালিকানাও সে দাবি করেছে। এবং মধ্যবিত্তের মালিকানাধীন সম্পত্তি যেহেতু এক সময় এলিট শ্রেণির হাতে চলে যায়, বাঙালির নববর্ষও এলিটের হাতে পড়ে রূপান্তরিত হয়েছে। নিম্নবর্গীয়দের নববর্ষ এখন খোলনলচে পাল্টে এলিটের নববর্ষে রূপ নিয়েছে।

পহেলা বৈশাখ এখন মূলত একটি বাণিজ্যিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। পুঁজি বাজারের পালে পহেলা বৈশাখ এনে দিয়েছে নতুন হাওয়া, যা মূলত পোশাক ও খাদ্যকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। পহেলা বৈশাখে মেলার একটি প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। যেখানে দেশীয় কামার কুমারের পণ্য, শিশু খেলনা এবং খাবারের সওদাই প্রাধান্য পেত। নব্য ধনিক শ্রেণির হাতে পড়ে পণ্য পশারের বিশাল ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই দিনটি।

গ্রামের চরিত্র হারিয়ে গেল পলকে। চড়ক মেলা আর বসে না। চৈত্রসংক্রান্তির আগে মুড়ি ভাজা কিংবা ছাতু কোটার উৎসব এখন আর হয় না। আর যে মানুষটি অষ্টকের দল নিয়ে ঘুরত বাড়ি বাড়ি সে হারিয়েছে তার পেশা। আর যেহেতু পুঁজি বাজারের হাতে পড়েছে, দিনটি তাই নব্য ধনিক শ্রেণি পেশার মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে যেতে বেগ পেতে হয়নি। 

তবে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব, আমরা বাঙালি কিন্তু মধ্যবিত্ত চরিত্রের। আমরা যতটা না ভেতরে তার চেয়ে বেশি বাইরে প্রমাণ করতে চাই, তাই আমরা অনুকরণ করি নির্লজ্জের মতো। মুক্তবাজার অর্থনীতি আমাদের সর্বনাশ করেছে। সমাজে তৈরি হয়েছে এক নতুন মধ্যবিত্তের- ব্যাংক ডাকাত, ঋণ খেলাপি কিংবা মধ্যস্বত্বভোগী, ফলে এ সমাজ রূপান্তরিত হচ্ছে ভোক্তার সমাজে, উৎপাদন এখানে হবে না।

পোশাকে, খাদ্যাভ্যাসে আমরা এখন এক মাল্টিকালচারাল জাতি। আমাদের নিজস্বতা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। হারাতে বসেছে নিজেদের ক্ষুদ্রশিল্প, বৃহৎ শিল্প, আমদানি নির্ভরতা বিশেষ করে প্রভুত্বকারী দেশগুলোকে খুশি করার প্রবণতায় আমরা আমাদের স্বকিয়তা হারাচ্ছি। মানুষ একদল গরিব থেকে গরিবতর হচ্ছে, একদল হয়ে উঠছে ধনী। 

বাঙালি উৎসব প্রিয় জাতি। উৎসবেই তার আনন্দ, উৎসবে সেসব ভুলে যায়। এজন্য ইংরেজরা নাট মণ্ডলে উৎসব করত ধান ওঠার পর। কারণ ছিল কৃষকের খাজনার নামে নিংড়ে নেওয়ার ক্ষোভকে তারা অবদমিত করতে পারত উৎসবের বাতাবরণে। উৎসবে আমরা ভেদাভেদ ভুলে যাই। পৃথিবীর সব দেশেই আধিপত্যকারী শ্রেণির সংস্কৃতিই জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে পরিগণিত হয়, এবং উৎসব পাগল আমজনতা সেই মেওয়া লুফে নেয়। জমিদার মহাজনদের ভাড়াটে লাঠিয়ালের লাঠিখেলা, কুস্তিগিরের কুস্তি কসরত আর বায়না করা কবিয়ালের কবিগান ছিল উৎপাদক শ্রেণির কৃষক-প্রজাদের নিংড়ে নেওয়ার মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতিপূরণ। আমরা এখনো দেখি আমাদের জাতীয় উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অথচ সবচেয়ে অবহেলিত সম্প্রদায় হলো কৃষক শ্রেণি। যদিও আমরা এখন আর আক্ষরিক অর্থেই একটি কৃষিপ্রধান অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরে নেই। অথচ এই পুঁজিবাদী সমাজে থেকে এমন প্রহসনের ভেতর দিয়ে কি আমরা যাচ্ছি না? 

আমাদের নিত্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ানো হয়, আমরা তার কোনো প্রতিবাদ করি না। আমাদের সামনে উন্নয়নের একটি মুলা ঝোলানো হয়। কাঠমোগত উন্নয়ন যে প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন না, সে কথা আমরা মুখ ফুটে বলি না। কারণ আমাদের বলার স্বাধীনতা নেই। ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা নেই। আমরাও উৎসবে বুঁদ হয়ে থাকি। উৎসবপ্রবণ জাতি মূলত আত্মকেন্দ্রিক হয়। সামগ্রিকতায় তাদের উৎসাহ কম। তারা বিপ্লবে অনীহা। তাই করপোরেট জগৎ আমাদের সামনে নানা উৎসবের মুলো ঝুলিয়ে রাখে। আমাদের জাতীয় শোক, জাতীয় গৌরব সবকিছু উৎসবের চাদরে ঢাকা আজ। অন্যদিকে নববর্ষ তার উৎসব মূর্তিতে আমাদের বৃহত্তর সংস্কৃতিরই অঙ্গ। 

তাই বলতে হয়, আমরা যে শুধু উৎসব পরায়ণ তাই নয়। আমাদের আছে পরস্পর মিলে মিশে থাকার এক সৌহার্দ্যপূর্ণ সংস্কৃতি। নতুন বছরে আমাদের ভেতরকার সব গ্লানি দূর হয়ে যাক। সব জ¦রা দূর হয়ে যাক। দেশের জনগণ বা জনসমষ্টির মানসিক জাগরণই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে কৃষ্টি সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। মন ও মানসিকতার পূর্ণতাই প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //