এক বোতল ফেনসিডিল এবং দড়িতে বাঁধা শিক্ষক

লাল কাপড়ে ঢাকা গোল টেবিলে এক বোতল ফেনসিডিল আর তার সামনে হাতে দড়ি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এক যুবককে। ভারী অস্ত্র নিয়ে তার পাহারায় বিজিবির তিন সদস্য। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হবে, ওই যুবক দুর্ধর্ষ অপরাধী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বহুদিন ধরে তাকে খুঁজছিল। সীমান্ত থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে ধরতে না পারলে দেশের বিরাট ক্ষতি হয়ে যেত। 

সঙ্গে এক বোতল ফেনসিডিল পাওয়া গেছে- এই অপরাধে বা অভিযোগে কাউকে এ রকমভাবে হাতে দড়ি বেঁধে ভারী অস্ত্র নিয়ে পাহারা দেয়ার ছবি এর আগে গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে কি-না- জানা নেই।

তবে যে ‘দুর্ধর্ষ’ ব্যক্তিকে এভাবে আটক করা হয়েছে, তার নাম জাহাঙ্গীর আলম শাহীন। লালমনিরহাটের আদিতমারী মহিষখোঁচা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক। তিনি দৈনিক জনকণ্ঠ ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার লালমনিরহাট প্রতিনিধি। শুধু তাই নয়, তিনি জেলা ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিরও সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ১৫ এপ্রিল মধ্যরাতে কুলাঘাট থেকে তাকে আটক করেন বিজিবি। 

এর আগে সাধারণত মাদক ব্যবসায়ী বা পাচারকারীদের আটকের পরে যেসব ছবি গণমাধ্যমে এসেছে, সেখানে দেখা গেছে, কয়েকশ’ বোতল ফেনসিডিল বা হাজার হাজার ইয়াবা অথবা অন্য যেকোনো ধরনের মাদকই হোক না কেন, তার পরিমাণ অনেক এবং তার পেছনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় আটককৃতদের; কিন্তু মাত্র এক বোতল ফেনসিডিল টেবিলে রেখে তার পেছনে একজন যুবককে, যিনি একইসঙ্গে একজন শিক্ষক ও সাংবাদিক- তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে বিজিবির সশস্ত্র পাহারার এরকম ছবি দুর্লভ। 

বাস্তবতা হলো, কেউ যদি মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তার পকেটে এক বোতল ফেনসিডিল থাকার কথা নয়। আবার তিনি যদি মাদকসেবী হয়ে থাকেন, তাহলে এক বোতল ফেনসিডিল আনতে তার সীমান্তে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তার যে সামাজিক অবস্থান তাতে তিনি যেখানে বলবেন, সেখানেই এরকম দুই-চার বোতল ফেনসিডিল পৌঁছে দেয়ার লোকের অভাব থাকার কথা নয়। সুতরাং তিনি বিজিবির কোনো কর্মকর্তার রোষানলের শিকার হয়েছেন এবং তারাই টেবিলে এক বোতল ফেনসিডিল রেখে তাকে মাদক পাচারকারী বা সেবনকারী হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন কি-না- সেই প্রশ্ন উড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এরই মধ্যে সেই অভিযোগই উঠেছে। সুষ্ঠু তদন্ত হলে রহস্য বেরিয়ে আসবে। তবে সুষ্ঠু তদন্ত যে হবে না, এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত থাকা যায়।

একজন শিক্ষক ও সাংবাদিক তো দূরে থাক, একজন অতি সাধারণ মানুষকেও কি এভাবে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা যায়? টেবিলে এক বোতল ফেনসিডিল রেখে তাকে মাদকসেবী বা ব্যবসায়ী হিসেবে প্রচার করা যায়? এটি যে মানবাধিকারের লঙ্ঘন- সেই খবর কি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর কাছে থাকবে না?

তিনি এমন কী করেছিলেন বা বিজিবির সঙ্গে তার কী এমন হয়েছিল, যে তাকে এমন নির্মম অপমানের শিকার হতে হলো? একজন বিজিবির কর্মকর্তা এতই ক্ষমতাবান যে, তিনি চাইলেই একজন শিক্ষক ও সাংবাদিককে এভাবে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারেন? আটকের পরে শাহীনকে মারধরেরও অভিযোগ উঠেছে। শাহীন কি এখন এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে আদালতে যাবেন? গেলেও তিনি কি ন্যায় বিচার পাবেন? সংশয়টি এ কারণে যে, বিচারবিভাগীয় তদন্ত ছাড়া এসব ঘটনায় অপরাধ প্রমাণ করা যায় না। 

শাহীনের পরিবারের দাবি, ১৫ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের রতনাই বেইলি ব্রিজ এলাকায় তার সঙ্গে বিজিবির টহল দলের তর্ক হয়। এরপরই তাকে এক বোতল ফেনসিডিল দিয়ে আটক করা হয়।

পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে মাদক ব্যবসায়ী বা মাদকসেবী হিসেবে আটক এবং তারপর কোর্টে চালান করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে নতুন নয়। মাদকবিরোধী অভিযানের নামে আসলে কাদের ধরা হয় আর কাদের আড়াল করা হয়; অভিযান চালিয়ে জব্দকৃত মাদকের কত শতাংশ ধ্বংস করা হয় আর কত শতাংশ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছেই বিক্রি করে দেওয়া হয়- তা নিয়েও জনমনে প্রশ্নের শেষ নেই। মূলত এসব কারণে অনেক সময় মাদকবিরোধী অভিযান এবং কাউকে মাদকসহ আটকের খবর নিয়ে মানুষ সন্দেহ পোষণ করেন।

লালমনিরহাটের শিক্ষক ও সাংবাদিক শাহীন যে বিজিবির কোনো কর্মকর্তার ব্যক্তিগত আক্রোশের শিকার হয়েছেন, তা বোঝার জন্য গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না; কিন্তু মুশকিল হলো, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং ন্যায় বিচারের সম্ভাবনা কম। কারণ আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নাগরিকদের এরকম নাজেহাল হওয়ার ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটে। তদন্ত ও বিচার করতে গেলে সেই তালিকা দীর্ঘ হয়ে যাবে। 

আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগের সুরাহা বা এসব ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় অস্বীকার তথা সংশ্লিষ্টদের সুরক্ষার প্রবণতা। 

যখনই এরকম ঘটনা ঘটে, সংশ্লিষ্ট বাহিনীর তরফে বলা হয়, ব্যক্তির অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না। প্রশ্ন হলো, কেন নেবে না? অপরাধ করা এবং মানুষকে হয়রানি করার সব উপাদান যদি ওই বাহিনীর ভেতরে বিদ্যমান থাকে; বাহিনীর সদস্যরা যদি মনে করেন যে, অপরাধ করলেও তাদের সুরক্ষার যাবতীয় উপায় রয়েছে; সদস্যরা যদি মনে করেন যে, রাষ্ট্রই তাদের সুরক্ষা দেবে; তাদের নিয়োগ ও বদলির প্রক্রিয়া যদি রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত হয় এবং সেখানে মোটা অংকের লেনদেন থাকে- তাহলে অপরাধ করলে সেই লেনদেন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরাই তো তাদের সুরক্ষা দেবেন। 

সুতরাং নাগরিকের সুরক্ষার কোনো সুযোগ নেই। যে নাগরিকের ট্যাক্সের পয়সায় বাহিনীর সদস্যদের বেতন হয়, তারাই সেই জনগণকে হয়রানি করবে; পকেটে ফেনসিডিল বা ইয়াবা দিয়ে আটক করে মাদক পাচারকারী হিসেবে সমাজে অপদস্থ করবে; জেল খাটাবে; আদালতের বারান্দায় ঘোরাবে; কিন্তু ভুক্তভোগীদের কিছু করার থাকবে না। 

কালেভদ্রে শাহীনের মতো দু-একজন লোককে আটক করলে সোশ্যাল মিডিয়ায় এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হয়তো কিছুটা চাপে পড়বেন; কিন্তু প্রতিদিন যে সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আরও অসংখ্য মানুষ এরকম নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হতে থাকবেন, তা নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য হবে না। কারণ অধিকাংশ ঘটনা আড়ালেই থাকবে। কেউ ভয়েও মুখ খুলতে চাইবেন না।

অথচ এসব বাহিনীর প্রধান কাজ হলো- নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া। যে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় তাদের বেতন হয়, সেই মানুষদের সুরক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করা। জনগণের ভাবনায় আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে বন্ধু ভাবার দিন কি সুদূর পরাহতই থেকে যাবে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //