করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট, উদ্বেগ ও প্রত্যাশা

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ক্রমান্বয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস, যা SARS CoV-2 (Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2) বা কোভিড-১৯ নামে পরিচিত। শুধু মানুষের জীবন নয়, করোনার প্রকোপে ধ্বংস হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, চিকিৎসা, শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা; সর্বোপরি বাড়ছে দারিদ্র। এরই মধ্যে করোনার শক্তিশালী কয়েকটি ভ্যারিয়েন্ট গবেষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এ পর্যন্ত কোভিড-১৯-এর আলোচিত ভ্যারিয়েন্টগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের UK বা Kent ভ্যারিয়েন্ট (B.1.1.7); ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (B.1.1.28); দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট (B.1.351) এবং ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট (B.1.617) অন্যতম।

গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ভিন্ন ভিন্ন পোষক দেহে অভিযোজনের প্রয়োজনে ভাইরাসের জিনের (DNA/RNA) মিথষ্ক্রিয়তায় সৃষ্ট নতুন বংশগতির পরিবর্তন (Mutation) সমৃদ্ধ ভাইরাসের (ভ্যারিয়েন্ট) উৎপত্তি ভাইরাসের জীবনচক্রে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বংশগতিতে এই পরিবর্তন সর্বক্ষেত্রে যে ভাইরাসকে দুর্বল (পোষক প্রাণীর জন্য কম ক্ষতিকর) করে তা কিন্তু নয়, অনেক ক্ষেত্রেই ভাইরাস হয়ে উঠে শক্তিশালী। ভাইরাস DNA/RNA সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে সৃষ্ট জেনেটিক পরিবর্তন সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। মিউটেশনের ফলে সৃষ্ট দুর্বল ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট সাধারণত আলোচনায় না এলেও, শক্তিশালী হয়ে ওঠা ভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে গবেষণার অন্ত থাকে না। যেমনটি হচ্ছে বর্তমানে করোনাভাইরাসের শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্টগুলো নিয়ে।

যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টটি (B.1.1.7) আলোচনায় আসে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে হঠাৎ সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়। পরবর্তীতে যা ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অন্তত ৫০টি দেশে। গবেষণায় দেখা যায়, করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্টটি অন্য ভ্যারিয়েন্ট থকে ৫৬ শতাংশ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। জেনেটিক বিশ্লেষণে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টটিতে (B.1.1.7) মোট ১৭টি মিউটেশন দৃশ্যমান; যার মধ্যে ৮ টি মিউটেশন পাওয়া যায় স্পাইক প্রোটিন (S) উৎপাদনকারী জিনে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন, ভাইরাসের উপরিভাগে অবস্থিত স্পাইক প্রোটিন (প্রোটিন-এস) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রোটিনটির সাহায্যে ভাইরাস পোষক (মানুষ বা প্রাণী) কোষের উপরিভাগে অবস্থিত নির্দিষ্ট রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয় এবং পরবর্তীতে ভাইরাসটি কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশে সমর্থ হয়।

করোনার দক্ষিণ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটিও (B.1.351 বা 20H/501.V2) অধিক সংখ্যক মিউটেশন বিশিষ্ট এবং দেশটিতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য দায়ী ধরা হয়; যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় ৪৮টি দেশে শনাক্ত হয়। যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের মতো সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটিও অধিক সংক্রামক এবং দেশটিতে করোনার প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি মৃত্যু ঘটায়। সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টটি ৪৮ শতাংশ ক্ষেত্রে মানবদেহে করোনা সংক্রমণের ফলে সৃষ্ট এন্টিবডিকে (ন্যাচারাল ইমিউনিটি) ফাঁকি দিয়ে দ্বিতীয় সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম হয়।

তারপরেও গবেষকরা আশার বাণী শোনান। পরবর্তী ক্লিনিক্যাল গবেষণায় উঠে আসা তথ্যে দেখা যায়, নভোভ্যাক্স উৎপাদিত ভ্যাকসিন যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ৮৯ শতাংশ এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ কার্যকর। অপরদিকে জনসন অ্যান্ড জনসনের উৎপাদিত ভ্যাকসিন প্রয়োগের ২৮ দিন পর যুক্তরাষ্ট্রে ৭২ শতাংশ, ল্যাতিন আমেরিকাতে ৬৬ শতাংশ এবং সাউথ আফ্রিকাতে ৫৭ শতাংশ (অন্য একটি গবেষণায় ৮৫ শতাংশ ) কার্যকারিতা দেখায়। এছাড়া অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড উৎপাদিত ভ্যাকসিনটিও (বাংলাদেশ, ভারত, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক দেশে ব্যবহৃত) এসব সংক্রামক ভ্যারিয়েন্টের বিপরীতে কার্যকর, এমনকি প্রথম ডোজে গ্রহণের ১৪ দিন পরও ৩৩.৫ শতাংশ কার্যকারিতা প্রদর্শন করে।

এ মুহূর্তে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে করোনাভাইরাস ভ্যারিয়েন্ট B.1.617 বা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ ও নেপালসহ এ পর্যন্ত বিশ্বের ৪৪টি দেশ ভারতীয় এ ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়েছে এবং ভারতে মোট শনাক্তের ৬৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ভ্যারিয়েন্টটি দায়ী। চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের ধারণা, ভ্যারিয়েন্টটি যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট (B.1.1.7) থেকেও অধিক সংক্রামক। 

এ পর্যন্ত B.1.617 ভ্যারিয়েন্টটির তিনটি সাব-ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে (B.1.617.1, B.1.617.2 ও B.1.617.3)। এর মধ্যে B.1.617.2 সাব-ভ্যারিয়েন্টটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জেনেটিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, B.1.617.1 সাব-ভ্যারিয়েন্টটির মোট ১৫টি মিউটেশন রয়েছে; যার মধ্যে ২টি রয়েছে স্পাইক প্রোটিনে। এ কারণে B.1.617.1 সাব-ভ্যারিয়েন্টটি “ডাবল মিউট্যান্ট” ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হওয়ার পর মার্চের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সংক্রমণের হারে B.1.617.1 ভ্যারিয়েন্টটি এগিয়ে থাকলেও চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতে B.1.617.2 সাব-ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণের উচ্চহার পরিলক্ষিত হয়।

নিচের ছকে উল্লিখিত তিনটি সাব-ভ্যরিয়েন্টে মিউটেশনের ফলে স্পাইক প্রোটিনে সৃষ্ট এমিনো এসিডে পরিবর্তন দেখানো হলো-
  
মিউটেশনের ফলে স্পাইক প্রোটিনে সৃষ্ট এ পরিবর্তনই কি ভারতীয় ভ্যরিয়েন্টেকে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে? এ প্রশ্নের উত্তরে গবেষকরা জানাচ্ছেন, L452R– শুধু সংক্রমণ ছড়াতে নয়, প্লাজমা ও নির্দিষ্ট এন্টিবডিকে ফাঁকি দিতে সাহায্য করে; E484Q– সিরাম এন্টিবডিকে পাশ কাটিয়ে কোষের অভ্যন্তরে প্রবেশে সাহায্য করে; P681R– কোষের অভ্যন্তরে  প্রবেশ ও সংক্রমণে সহায়তা করে এবং D614G– অধিক সক্রিয় রেখে সংক্রমণ ছড়াতে সহায়তা করে। অর্থাৎ, মিউটেশনের ফলে সৃষ্ট পরিবর্তন ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টটিকে পুরনো ভ্যারিয়েন্ট থেকে অধিক সংক্রামক হিসেবে শুধু প্রতিষ্ঠিত করেনি, ন্যাচারাল ইমিউনিটিকে পাশ কাটিয়ে পোষক দেহে সংক্রমণের অনন্য বৈশিষ্ট্যও যুক্ত করেছে।

তাহলে কি এই ভয়ংকর হয়ে ওঠা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টকে ঠেকানো বা নিষ্ক্রিয় করার কোনো অস্ত্র আপাতত আমাদের হাতে নেই? ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা প্রাণান্ত পরিশ্রম করছেন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। যদিও খুবই প্রাথমিক, তবু কিছু তথ্য গত সপ্তাহেই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে আর সেখানেই মিলছে আশার বাণী। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিদ ড. রবীন্দ্র কে গুপ্তা ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইজারের টিকা গ্রহণের পর মানবদেহে যে এন্টিবডি উৎপন্ন হয়; তা করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টকে (B.1.617) রুখতে অন্য মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টের মতো সমান কার্যকরী। 

ঠিক একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের এমরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. মেহুল এস সুথার ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা জানাচ্ছেন, ফাইজার ও মডার্নার উৎপাদিত টিকাতে মানবদেহে উৎপাদিত এন্টিবডি করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের (B.1.617) বিরুদ্ধে কার্যকারিতা প্রদর্শন করে; যদিও তা পুরনো ভ্যারিয়েন্ট থেকে কম।

ভারতের হায়দ্রাবাদের সেন্টার ফর সেলুলার অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির উপদেষ্টা ড. রাকেশ মিশ্র ও তাঁর সহযোগীরা একই গবেষণা শুরু করেছেন। তবে তাঁরা এক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড। ড.রাকেশ মিশ্র জানাচ্ছেন, তাঁরা ফাইজার ও মডার্নার টিকার মতো একই ফলাফল পেয়েছেন কোভিশিল্ডের ক্ষেত্রেও (যদিও তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়নি)। 

এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, করোনার এই নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ন্ত্রণে আমরা অসহায় নই। এ মুহূর্তে জরুরি হচ্ছে সবার জন্য টিকা নিশ্চিত করা। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, দ্রুত সংক্রমণ রোধে মাস্ক ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। গবেষকরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন- সবার সচেতনতা, প্রচেষ্টা আর গবেষণা আগামী দিনে করোনা মাহামারি থেকে উত্তরণের পথ দেখাবে বিশ্ববাসীকে। 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
স্কুল অব মেডিসিন, জুজিয়াং ইউনিভার্সিটি, চীন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //