গ্লোবাল মানে কী

গ্লোবাল শব্দটি ইংরেজি- যার বাংলা অনেকে করেন বৈশ্বিক, যদিও বেশি স্পষ্ট বাংলা হবে সম্ভবত দুনিয়াজুড়ে। তবে আমরা এখানে ‘গ্লোবাল’ শব্দটিই ব্যবহার করব। কারণ এই সময়ের রাজনীতি, অর্থনীতি বা ক্ষমতার ধারণা পেতে আপনাকে এই শব্দটির ভেতর দিয়ে তা স্পষ্ট করে বুঝে যেতে হবে।

যেমন ইদানীং আরেকটি শব্দের অনেক ব্যবহার দেখা যাচ্ছে ‘ভূরাজনীতি’ বলে; কিন্তু যারা এটি ব্যবহার করছেন তারা খুব স্বস্তিতে করতে পারছেন না, তা বোঝা যায়। কারণ ভূরাজনীতি শব্দটির অর্থের সীমা-পরিসীমা কেউ নিশ্চিত নয়। যদিও রাজনীতি, ভূগোল আর জনমিতির (জনসংখ্যার পরিসংখ্যানগত স্টাডি) পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে স্টাডি বা পড়াশোনার নাম হল ভূরাজনীতি। ফলে দেখা যাচ্ছে, যিনি ভূরাজনীতি শব্দটি ব্যবহার করেছেন তিনি আর নিশ্চিত হতে পারছেন না, যা বোঝাতে চেয়েছিলেন তাই হয়েছে কিনা।

আরেকটি কথা। যারা ভূরাজনীতি শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তারা শব্দটি একটি অর্থনীতিগত ধারণা হিসেবেও ব্যবহার করতে চেয়ে থাকলে এবার এর বিপদ টের পাচ্ছেন। কারণ আসলে তো ভূরাজনীতি শব্দের মধ্যে অর্থনীতিক কোনো ধারণাই নাই। এটি ১৯৪৫ সালের আগের ধারণা, তাই এতে রাজনীতি, ভুগোল আর জনমিতি হয়তো আছে। এদের জন্য তুলনীয় বিকল্প শব্দ হবে ‘গ্লোবাল অর্থনীতি’ বা ‘গ্লোবাল রাজনীতি’ ইত্যাদি; কিন্তু এতেও আরেক নতুন সমস্যা হলো, এখানে গ্লোবাল শব্দটির সঠিক অর্থ কী?

এক কথায় জবাব হলো, এটি দুনিয়াজুড়ে সম্পর্কবিষয়ক এক ধারণা। যেখানে গ্লোবাল শব্দের আক্ষরিক অর্থ যদিও দুনিয়াজুড়ে বা জগৎজুড়ে এবং এই সম্পর্ক বলতে তা মানুষে-মানুষে সম্পর্ক এবং সবধরনের সম্পর্ক বোঝায়।

এবার আরেকটু এগোনো যাক। সব ধরনের সম্পর্ক বলতে সেটিই বা কিসের ভিত্তিতে? সেটি বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, সম্পর্ক মানেই তা দাঁড়িয়ে থাকে মানুষে-মানুষে লেনদেন-বিনিময়ের ওপরে। তাই সম্পর্ক মানেই এক্সচেঞ্জ বা লেনদেন-বিনিময় এবং এই বিনিময় মানে ভাষা থেকে শুরু করে পণ্য বা বিনিয়োগ, এমনকি আবেগ-ভালোবাসা ইত্যাদি সবকিছুই।

তাহলে এবার ফ্রেশ করি। গ্লোবাল মানে আসলে দুনিয়াজুড়ে এক লেনদেন-বিনিময়ের সম্পর্কের কথা বলতে চাচ্ছি আমরা। তাই গ্লোবাল অর্থনীতি মানে দুনিয়াজুড়ে অর্থনীতিবিষয়ক লেনদেন-বিনিময়ের সম্পর্ক। একইভাবে গ্লোবাল রাজনীতি মানেও দুনিয়াজুড়ে রাজনীতিবিষয়ক এক্সচেঞ্জ রিলেশন।

১৯৪৫ সালের আগে পর্যন্ত যে ব্যবহারিক দুনিয়া তাতে গ্লোবাল সম্পর্ক ব্যপারটি একেবারেই বিকশিত হয়নি। কারণ এর আগে তা কলোনি দখলদারদের আধিপত্যের ছিল। তাই তাদের স্বার্থ দিয়েই ঠিক হতো মানুষে-মানুষে বিনিময় সম্পর্ক কোন লাইনে হবে। সেটি হলো কেবল কলোনি মাস্টার বা মালিকের দেশের সঙ্গে কলোনিকৃত দেশের, এতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তাও সেটি মূলত একদিকে ভারি করে; একমুখী। মানে মূলত কেবল তা লুট করে কলোনিকৃত দেশের থেকে সম্পদ নিয়ে যাবে এমন ধরনের। তাই তখনো গ্লোবাল সম্পর্ক বিকশিত হয়ে ওঠার সময়ই হয়নি বলা হয়। 

কিন্তু ১৯৪৫ সালের পরে বিশ্বযুদ্ধ শেষে যখন কলোনি ছেড়ে চলে যাবার কালপর্ব এলো, তখন কলোনিমুক্ত অর্থে দেশগুলো স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যায়। এরপরেই কেবল এসব স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি লেনদেন-বিনিময় সম্পর্ক অবারিত হতে শুরু করেছিল। আগেই বলেছি গ্লোবাল সম্পর্কের মধ্যকার মুখ্য চালিকাশক্তি হলো বাণিজ্য সম্পর্ক; সেটি গড়া ও বিকাশ করা। অতএব, এখন গ্লোবাল সম্পর্ক মানে মুখ্যত গ্লোবাল বাণিজ্যিক সম্পর্ক।  বলা যায় গ্লোবাল অর্থনীতি সেই প্রথম বিকশিত বা আত্মপ্রকাশ করেছিল। আর গ্লোবাল রাজনীতি ছিল এরই অনুষঙ্গ।

তবে আসল কথাটি যেন না ভুলে যাই, সম্পর্কের গোড়ায় আছে লেনদেন-বিনিময়। কিসের লেনদেন-বিনিময়? সবকিছুর। 

গ্লোবাল বাণিজ্য

গ্লোবাল বাণিজ্য কথাটি বাস্তবে এত সহজে শুরু হয়নি। আরেকটি বড় শর্তপূরণ করতে হয়েছিল। সেটি বুঝব যদি আমরা দেশের ভেতরে এবং আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের দিকে তাকাই। আগেই বলেছি মানুষে-মানুষে সম্পর্কের কেন্দ্রে আছে লেনদেন-বিনিময় যা সবকিছুর বিনিময় সম্পর্ক। কাজেই দেশের ভিতরেও ব্যাপারটি একই। আর সেই সম্পর্ক সহজেই ঘটতে দিতে এক প্রধান ভূমিকা পালন করে মুদ্রা বা কারেন্সি সিস্টেম। আভ্যন্তরীণ মুদ্রা ব্যবস্থা হলো লেনদেন-বিনিময়ের সম্পর্কের জন্য এক মুখ্য পূর্বশর্ত। তাই একই কারণে, গ্লোবাল সম্পর্ক বা গ্লোবাল এক বাণিজ্য ব্যবস্থা থাকার মুখ্য পূর্বশর্ত হলো এক গ্লোবাল মুদ্রা ব্যবস্থা।

এই গ্লোবাল মুদ্রা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক নাম হলো আইএমএফ বিশ্বব্যাংক, এটিই সেই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। এটি যেহেতু আমেরিকান নেতৃত্বে এক পশ্চিমা ব্যবস্থা, ফলে এর ব্যবস্থাদিতে অংশ নিলে আমরা গ্লোবাল বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় যুক্ত হবার সুযোগ নিতে পারি। আর যদি না নিতে চাই তাহলে সেটি আরও খারাপ। অনেকটি একঘরে হয়ে থাকার মতো, না খেয়ে শুকিয়ে মরা হবে। ইরানের ওপর ১৯৭৯ সালের পর থেকেই অবরোধের ভয়াবহতা দেখে এর কিছুটা আমরা আন্দাজ করতে পারি।

এর উলটা কাগুজে ধারণা একটি আছে, যেমন স্বদেশীপনা। এটি বলতে চায়, আমার দেশের লোক যাকিছু ভোগ-ব্যবহার করবে এর সবকিছু দেশের ভূখ-ের ভেতরের উৎপাদিত ও বিনিময় হতেই হবে, যা বাস্তবায়ন খুবই কঠিন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একেবারেই অসম্ভব। তবে কাগুজে স্লোগান হিসেবে এটি পাবলিকের মধ্যে সুড়সুড়ি তুলতে খুবই কার্যকর। আরএসএস বা মোদির ‘স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ’ বলে এক প্রপাগান্ডা সংগঠন আছে। বছর খানেক আগে এটি চীনবিরোধী প্রপাগান্ডা তুলেছিল; কিন্তু কেবল এক স্মার্টফোনের ব্যবহারের দিক থেকেই যদি ভারতে দেখি তবে এখানে নব্বই ভাগের ওপরে চীনা স্মার্টফোন। আমাদের প্রসঙ্গ ঠিক এদিকে আর যাওয়া নয়।

আমাদের মূল প্রসঙ্গ গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যাপারটির দিকে প্রগতিশীল বা একশ্রেণির রাজনীতির দ্বিধাগ্রস্ততা দেখা যায়। এর পেছনের মূল কারণ উগ্র জাতিরাষ্ট্রবাদীরা তো বটেই অনেক কমিউনিস্টও স্বদেশীপনা ধরনের অর্থনীতির এক কাল্পনিক ধারণা ধারণ করে চলে। সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে না যাওয়ার আগে পর্যন্ত কমিউনিস্টরাও বাস্তবের গ্লোবাল বাণিজ্যের সঙ্গে গ্লোবাল মুদ্রা ব্যবস্থার সম্পর্কটি আমল করতে পারেনি। ফলে গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থাটি যে অনিবার্য এদিকটি তারা উপেক্ষা করে চলতে পেরেছিল; কিন্তু সোভিয়েত ভেঙে যাবার পর ১৬ টুকরার রাষ্ট্রগুলোর কেউই গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থার সদস্য হতে আর দেরি করেনি। কিন্তু পুরনো একই অবস্থায় বেখবর থেকে গেছে আমাদের এদিকের কমিউনিস্ট প্রগতির রাজনীতিকরা। যেহেতু বাস্তব তৎপরতার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। তাই গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থাটির ইতি-নেতি দিক নিয়ে তাদের জানা নাই, আগ্রহও নাই এমন এক অবস্থায় তারা।

এদিকে আশির দশকের পরে গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থাটি স্পষ্টভাবে তৎপর হয়, দেখা যায় গ্লোবাল উৎপাদন ও এর এক গ্লোবাল অর্ডার হয়ে জেঁকে বসাটি আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। অনেকে বাইরে থেকে কেবল একেই ‘গ্লোবালাইজেশন’ বলে আমল করে থাকে। এদিকে একালে চলতি শতকে এসে এই গ্লোবাল অর্থনীতি ও রাজনীতিক অর্ডারের নেতৃত্বের পালাবদলের আলামত শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকার বদলে তা চীনের দিকে ছুটে চলেছে।

আর এতেই দেখা দেয় সমস্যাটি- তাহলো আগে থেকেই গ্লোবাল অর্ডার, গ্লোবাল বাণিজ্য বলে ফেনোমেনা আছে, আর সেখানে গ্লোবাল লিডার বলে আমেরিকা ছিল তা আমল করতে হয় এই বাধ্যবাধকতা দেখা দিয়েছে। এ কারণে গ্লোবাল কথাটির ব্যবহার এখন বুঝতেই হচ্ছে। যদিও অনেকে এখনো গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা আর ‘পরাশক্তি’ বলে ধারণা দিয়ে বুঝতে চেয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ছে। কিন্তু এসবের একমাত্র সহজ সমাধান, গ্লোবাল ধারণাটিকে ‘এক্সচেঞ্জ’ মানে বিনিময়ের সম্পর্কের জায়গা থেকে পাঠ করে সব বিভ্রান্তির অবসান করা। তবেই কেবল গ্লোবাল শব্দটির ব্যবহার সহজ হতে পারে।

- লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //