ফিলিস্তিন : দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ আর সাময়িক বিরতি

এক হাতে পতাকা আর এক হাতে পুতুল নিয়ে হাসিমুখে বসে থাকা শিশুটিকে দেখে মুখে হাসি আর মনে আদর করার ইচ্ছা জাগবে না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন। আবার রাইফেল উঁচিয়ে থাকা সৈন্যকে দেখে মায়ের পেছনে লুকিয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকা দুই ভাই-বোনকে দেখে বেদনা জাগার অনুভূতি হবে না, এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। দুই সৈন্যকে নিজের বাড়ির সীমানায় অস্ত্র বাগিয়ে থাকতে দেখে যে কিশোরী ক্রোধে ফেটে পড়ছে, নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে সৈন্যদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে এই ছবি দেখে, কি হবে মেয়েটার- এ কথা ভেবে আতঙ্কিত হবেন না এমন মানুষ পাওয়া কঠিন।

মৃত্যুকে উপেক্ষা করে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার কী অপরিসীম সাহস! ঘটনাগুলো আলাদা; কিন্তু এলাকাটা একই। মানুষগুলোর পরিচয় তারা ফিলিস্তিনি আর সেনারা ইসরায়েলের সৈন্য। 

যুদ্ধবিরতি মানে যুদ্ধের সমাপ্তি নয়, একথা প্যালেস্টাইনিদের চেয়ে ভালো আর কে জানে? অতীতের মতো গত ২১ মে থেকে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনি হত্যাযজ্ঞের আপাত বিরতি হয়েছে। প্রতিবারের মতো প্রায় একতরফা যুদ্ধে এবার কমপক্ষে ২৩২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, এর মধ্যে ৬৫ জন শিশু। আর গাজা থেকে নিক্ষেপ করা কথিত শত শত রকেট বা মিসাইলে ইসরায়েলি নিহত হয়েছেন ১২ জন, তাদের মধ্যে শিশু আছে দু’জন। 

ছোট্ট শহর গাজা। আয়তনে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের তুলনায় ছোট, ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার মাত্র। চারটি শহর, ১১টি গ্রাম, আটটি ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির, লোকসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এটুকু জায়গায় আবাদি জমি, কলকারখানা, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, আবাসিক এলাকা। এর মধ্যেই আবার ১৭ হাজার ইসরায়েলির জন্য নতুন বসতি তৈরি করতে হবে তাই জায়গা দখল করতে সেনা নেমেছে; কিন্তু গাজাবাসী যাবে কোথায়? ১৯৪৮ সাল থেকে চোখের সামনে ক্রমাগত দখল হতে দেখছে ফলের বাগান, বাড়ির আঙ্গিনা। তাই মরিয়া হয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে; কিন্তু প্রবল শক্তির সামনে রুখে দাঁড়ানো যে কত কঠিন তা জীবন দিয়ে অনুধাবন করছে গাজাবাসী। প্রতিরোধ করতে গেলে বোমা, গুলি, বিমান হামলায় গুঁড়িয়ে দিচ্ছে সব। 

১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা আন্দোলন বা ইন্তিফাদা ঘোষণার পর এ ধরণের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৪ হাজারের বেশি মানুষ। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিদের বসবাস করতে হচ্ছে আগুন, গুলি, বোমা, কান্না আর রক্তের মধ্যে।  

১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর জারি করা বেলফোর ঘোষণাপত্র, মাত্র ৬৭ শব্দের এই ঘোষণা; কিন্তু এ কারণে যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে, তা বিশ্বে নিষ্ঠুরতম হিসেবেই বিবেচিত। বেলফোর ঘোষণা ছিল ফিলিস্তিনে ‘ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাজ্যের করা একটি প্রতিশ্রুতি। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর এক চিঠিতে ব্রিটিশ ইহুদি নেতা লিওনেল ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে এই প্রতিশ্রুতি দেন। ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ও ইহুদিরা ছিল জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) চলাকালীন এই ঘোষণা অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর বাস্তবায়ন হবে বলে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া পরাজিত হওয়ার পর এই ম্যান্ডেটের বলে বিভিন্ন অঞ্চল মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণে আসে। 

ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি ‘জাতীয় আবাস’ প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্য বাস্তবায়ন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকার ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইহুদিদের ওই এলাকায় গিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিতে থাকে। ১৯২২ সাল থেকে ১৯৩৫ সালের মধ্যবর্তী সময়ে সেখানে ইহুদি জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ২৭ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। 

প্রয়াত ফিলিস্তিনি-আমেরিকান শিক্ষাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদের মতে, ইউরোপের বাইরের একটি এলাকার বিষয়ে ইউরোপীয় একটি শক্তি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীর উপস্থিতি ও ইচ্ছা বড় আকারে উপেক্ষিত হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন বেলফোর ঘোষণার আগে ব্রিটিশরা ১৯১৫ সালে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আরবদের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেয়; কিন্তু বেলফোর ঘোষণার অর্থ ছিল, ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসবে ও ফিলিস্তিনি আরবরা কখনোই স্বাধীনতা পাবে না। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিনের ওপর যুক্তরাজ্যের পক্ষে শাসনের লাগাম ধরে রাখা কঠিন হয়ে উঠতে থাকে। এর আগে ১৯২২ সালে লিগ অব নেশনসের কাছ থেকে অখণ্ড ফিলিস্তিনের ওপর ম্যান্ডেট লাভ করেছিল ব্রিটিশরা; কিন্তু ইহুদি নিধনযজ্ঞ, বিভিন্ন ইহুদি গুপ্ত গোষ্ঠীর চাপ, আরব লিগের প্রতিষ্ঠা ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি পালটে যেতে থাকে। 

পরে ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারিতে ফিলিস্তিনের ওপর থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেয় ব্রিটিশরা এবং জাতিসংঘের কাছে এর দায়িত্ব অর্পণ করে। ২৯ নভেম্বর, ১৯৪৭ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের তথাকথিত ‘ঐতিহাসিক’ প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘের যে প্রস্তাব অনুসারে আজকের ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা, সেই একই প্রস্তাব অনুযায়ী একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরও প্রতিষ্ঠার কথা; কিন্তু ৭৩ বছর পরও অধরাই রয়ে গেছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা। 

১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করা নিয়ে বিতর্কিত ‘প্রস্তাব ১৮১’ গ্রহণ করে। প্রস্তাবটি তিন মিনিটের কম সময়ের এক ভোটাভুটিতে পাস হয়। প্রস্তাব পাসের সময় ফিলিস্তিন ছিল ১৩ লাখ ফিলিস্তিনি আরবের বসতি; বিপরীতে সেখানে ছিল ৬ লাখ ইহুদির বাস। এই বিভক্তির প্রস্তাব অনুসারে পরের বছরের ১ আগস্টের মধ্যে স্বাধীন ইহুদি ও আরব রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল।

প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রের জন্য বরাদ্দ হয় ১৪ হাজার বর্গকিলোমিটার (৫ হাজার ৪০০ বর্গমাইল) স্থান। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনি আরবদের জন্য বরাদ্দ হয় সাড়ে ১১ হাজার বর্গকিলোমিটারের (৪ হাজার ৪০০ বর্গমাইল) তিনটি এলাকা। আর জেরুজালেম ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে গঠন করা হয় এক বিশেষ আন্তর্জাতিক অঞ্চল।

জনসংখ্যার মাত্র ৩০ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী হয়েও ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল ফিলিস্তিনের ৫৪ শতাংশ ভূখণ্ডের মালিক হয়। ক্ষুব্ধ আরব দেশগুলো পুরো ফিলিস্তিনকে নিয়ে একটি একক, গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের ডাক দেয়। ১৯৪৮-এ ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হলে প্রতিবেশী চারটি আরব দেশ একযোগে ইসরায়েল আক্রমণ করে; কিন্তু নিজেদের অনৈক্য আর একেকজনের একেক উদ্দেশ্য থাকায় এই যুদ্ধে আরব দেশগুলো বারবার পরাজিত হয়। সেইসঙ্গে নিজেদের ভূমির ৫০ শতাংশ হারায় ফিলিস্তিন। 

পায়ের নিচে এক খণ্ড মাটির জন্য জীবন বাজি রেখে লড়ছে ফিলিস্তিনিরা। কোনো বিবেচনাতেই তারা ইসরায়েলের সমকক্ষ নয়। ইসরাইলের সেনা সদস্য ১ লাখ ৭০ হাজার নিয়মিত, ৩০ হাজার অনিয়মিত। প্রতিটি সক্ষম নাগরিকের সামরিক প্রশিক্ষণ আছে। এর বিপরীতে ফিলিস্তিনি হামাস সদস্যদের সংখ্যা ৩০ হাজারের বেশি নয়। ইসরাইলের বিমান সেনা ৩৪ হাজার আর আছে ৭০০ যুদ্ধ বিমান। বিপরীতে ফিলিস্তিনিদের কোনো বিমান নেই। ১০ হাজার সৈন্য, আটটি মিসাইল বোট, ৫টি সাবমেরিন আর ৪৫টি পেট্রোল বোট নিয়ে ইসরায়েলের নৌ-ব্রিগেড। ফিলিস্তিনিদের গাজায় কিছু মাছ ধরার নৌকা ছাড়া আর কিছুই নেই। অর্থনৈতিক দিক থেকে তো তুলনাই হয় না। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী ফিলিস্তিনের জিডিপি মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলার, যেখানে ইসরায়েলের জিডিপি ৪৪০ বিলিয়ন ডলার। ইসরায়েলের পাশে আছে ইউরোপ-আমেরিকার সমস্ত ধরনের সহায়তা আর হতভাগা ফিলিস্তিনিদের জন্য শুধু সহানুভূতি। ১৯৪৮, ৬৭, ৭৩ এ আরব ইসরায়েল যুদ্ধ ও ফিলিস্তিনিদের প্রতিদিনের যুদ্ধে তা প্রমাণিত। 

প্রতিপক্ষ অনেক, কিন্তু পক্ষে তো কেউ নেই ফিলিস্তিনিদের। ওআইসির ৫৭টি দেশ, আরবের ২২টি দেশ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দাঁড়াতে পারলো না আজও। মুসলমানরা মরছে একথা বলে আবেগ সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়; কিন্তু ইয়েমেনে মরে কারা, মারে কে? সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়াতে যে মরছে মুসলমানরা তার কারণ কি? ইরান ইরাক যুদ্ধই বা কেন হয়েছিল? এরকম অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। প্রশ্নগুলো যখন রাজনৈতিক তখন ধর্মীয় আবেগ সমাধান দিতে পারে না ফিলিস্তিন ইস্যুতে।

মধ্যপ্রাচ্য লুণ্ঠন, প্যালেস্তাইনিদের বিতারণ, অস্ত্র ব্যবসা, মধ্যপ্রাচ্যব্যাপি যুদ্ধ পরিস্থিতি জিইয়ে রাখা, ইসরায়েলকে ব্যবহার করে আমেরিকার কর্তৃত্ব বহাল রাখা সব কিছুর মধ্যে যে সুতার বন্ধন আছে তার ফলে এ যুদ্ধের নিষ্পত্তি হবে না। তাই বেদনার সাথেই বলতে হচ্ছে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে না বরং ফিলিস্তিনের উপর ইসরায়েলি স্থায়ী আগ্রাসন চলতেই থাকবে।

- লেখক : কেন্দ্রীয় সদস্য, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //