পরাধীন দেশের বিদ্রোহী কবি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে বাঙালি পাঠককে সচকিত করে যে কবির আবির্ভাব হয়েছিল, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। অনেক দিক থেকেই বাংলা কবিতায় নতুনের স্পর্শ এনেছিলেন তিনি। নতুন স্বাদের রাজনৈতিক কবিতাও বাংলা সাহিত্যে তারই অবদান। পূর্ববর্তী কবিদের তুলনায় তার রাজনীতি মনস্কতা অনেক বেশি ছিল। 

নজরুল রাজনীতির সংস্পর্শে যে উদ্দীপ্ত হতেন, কিশোর বয়সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দিতে চলে যাওয়া তার একটি প্রমাণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পরিবেশে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম এক ধূমকেতুর নাম। রাজনীতি সচেতনতা ও জনমূল-সংলগ্নতা নজরুলের কবি চৈতন্যে এনেছিল নতুন মাত্রা। 

শান্তিকামী মানুষের মাথার ওপরে ইংরেজ-শাসক আর এ দেশেরই পদলেহী দালালরা অশান্তি ও রক্তের প্লাবন নামিয়ে দিয়েছিল যখন, সেই সময়ে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বনকারী কবির কবিতায় উচ্চারিত হয়, ‘জাগো অনশন বন্দি ওঠ রে যত, জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত জাগো’। 

আজফার হোসেনের মতে, ‘যে সময়ে নজরুল ঔপনিবেশিক ভারতের ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’র আকাক্ষা ব্যক্ত করেছিলেন বা তার দাবি তুলছিলেন, সে সময়ে ভারতের কোনো রাজনৈতিক নেতা বা লেখক সে দাবির ধারে কাছে যাননি। এমনকি মহাত্মা গান্ধীও তখন মহাত্মা হয়ে ওঠেননি। আর যেভাবে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলেছেন নজরুল, তার বয়ানই যেন প্রতিধ্বনিত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন উপনিবেশবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি লড়াইয়ের ময়দানে ময়দানে।’

সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা আন্দোলন ও নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের স্বপ্ন সম্ভাবনা নজরুলের কবিমানসকে করে তুলেছিল আলোক-উদ্ভাসিত। অসত্য অমঙ্গল অকল্যাণের রাহুগ্রাস থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছেন স্বদেশের মাটি আর মানুষকে। যুদ্ধোত্তর বিরুদ্ধ প্রতিবেশে দাঁড়িয়েও তিনি গেয়েছেন জীবনের জয়গান, উচ্চারণ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য বিদ্রোহের বাণী।

কংগ্রেসের রাজনীতি, সাম্যবাদের আদর্শ, সশস্ত্র বিপ্লববাদের লক্ষ্য এই তিনের প্রতিই বিভিন্ন সময়ে আকর্ষণ দেখা গেছে নজরুলের। সেই সময়ে মুসলিম লীগও ছিল; কিন্তু নজরুল সেখানে যোগ দেননি। চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে পরিচয় ছিল তার। কংগ্রেস থেকে উদ্ভূত লেবার স্বরাজ পার্টির সদস্য ছিলেন তিনি। স্বরাজ দলের প্রার্থী হয়ে ভোটেও দাঁড়িয়েছিলেন একবার। যদিও হেরে যান। আবার কংগ্রেসের সঙ্গেও ছিলেন। পরে মুজাফফর আহমদের সান্নিধ্যে পৌঁছে সাম্যবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যদিও পার্টি সদস্য ছিলেন না।

১৯২০ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায় প্রথম কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশিত হওয়া মাত্রই ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। ওইদিন বিজলী পত্রিকাটি দু’বার ছাপাতে হয়েছিল। যার সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার। কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের মতে, সেদিন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি পড়েছিল। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা ও অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও কবিতাটি বাঙালি মানসে ‘চির উন্নত মম শির’ হিসেবে বিরাজমান। 

‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় ১৯২২ এর ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লেখার জন্য কারারুদ্ধ হন নজরুল। লিখেছিলেন, ‘দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি পূজা/ দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্তমাগে দশভূজা।’

কারাগারে নজরুলের অনশন, আর সেই অনশন ভাঙ্গাতে রবীন্দ্রনাথের তারবার্তা ইত্যাদি মিলে নজরুলের ওই দেবীবন্দনার কবিতাটিকে প্রবলভাবে রাজনৈতিক করে তুলেছে। মহাত্মা গান্ধীর প্রতিও ভক্তির কবিতা লিখেছেন নজরুল। ‘বিষের বাঁশী’তে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন। বাজেয়াপ্ত হয়েছিল ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪)। তাছাড়া নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হয়েছিল তাঁর ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), প্রলয় শিখা (১৯৩১), চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১)। প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘যুগবাণী’ (১৯২২), আর ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৯২৬) বাজেয়াপ্ত হয়। কারারুদ্ধ হয়ে বিচারের সময় আদালতে দাঁড়িয়ে নির্ভয়ে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন নজরুল, তাও এক জ্বলন্ত রাজনৈতিক কবিতা।

সব মিলিয়ে নজরুল বাংলা রাজনৈতিক সাহিত্যের জগতে এক তুমুল হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাগুলো সম্পর্কে ধারণা থাকলে তবেই সেই কবিতার মর্ম উপলব্ধি সম্ভব। নজরুলের কবিতায় প্রায়ই সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন পাঠক। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতাটি তারই একটি উদাহরণ। 

নজরুলের রাজনৈতিক কবিতার আর একটি ক্ষেত্র হলো বিদ্রুপ ভঙ্গিতে লেখা ব্যঙ্গ-হাস্য মিশ্রিত রচনা। সেগুলো ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামক সংকলনে একত্রিত করা হয় এবং প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংকলনটি বাজেয়াপ্ত হয় ১৯৩১ সালে। এই সংকলনে আছে ‘ডেমিনিয়ান স্টেটাস’, ‘লীগ-অব-নেশন’, ‘দে গরুর গা দুইয়ে’, ’রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স’, ‘সাহেব ও মেমসাহেব’, আইমন কমিশনের রিপোর্ট: প্রথম ভাগ - ‘ভারতের যাহা দেখিলেন’, এবং দ্বিতীয় ভাগ- ‘ভারতের যাহা দেখাইলেন’, ‘প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ প্রভৃতি।

চিত্তরঞ্জন দাস হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে মুসলমানদের জন্য অধিক কর্মসংস্থান সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে যে প্রস্তাব করেছিলেন, চিত্তরঞ্জনের অনুরাগী হওয়া সত্ত্বেও তা পছন্দ করতে পারেননি নজরুল। ‘চন্দ্রবিন্দুতে’ প্যাক্ট কবিতাটিতে তিনি লিখেছিলেন- ‘বদনা গাড়ুতে গলাগলি করে, নব প্যাক্টের আশনাই,/মুসলমানের হাতে নাই ছুরি, হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই’।

এছাড়া রয়েছে তার বিখ্যাত কবিতা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। যে কবিতা শোষকের বিরুদ্ধে, জুলুমের প্রতিবাদে বন্দি, কারারুদ্ধ মজলুমের বা বিপ্লবীর শেকল ছিড়ে বেরিয়ে পড়ার এক দুর্দান্ত আহ্বান।

দেশে দেশে বিপ্লবী, প্রতিবাদী, সংগ্রামী কবিদের কবিতা যখন আমরা পড়ি। এমনকি দেশের জন্য আত্মউৎসর্গকারী বা ফ্যাসিবাদের বলি হওয়া কবিদেরও আমরা যখন দেখি, তাদের কারো মধ্যে আমরা এমন একজন আপাদমস্তক দ্রোহের কবি খুঁজে পাই না, যিনি নজরুলের মতো বিদ্রোহী।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //