এলএসডি এবং বিপথগামী তরুণ সমাজ

হাফিজুর রহমান গ্রামের ছেলে। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামে। ভর্তি হয়েছিলেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে। ২০১৫-১৬ সেশনের ছাত্র হাফিজুর সংস্কৃতি অঙ্গনেরও পরিচিত মুখ ছিলেন। মূকাভিনয় করতেন। তিনি টিএসসিভিত্তিক সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইম অ্যাকশনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন মানে তিনি মেধাবী ছিলেন। নিশ্চয়ই একটি বড় স্বপ্ন নিয়ে দূর মফস্বল থেকে আলো ঝলমলে রাজধানীতে এসেছিলেন এই তরুণ। আমরা জানি না, তিনি কী হতে চেয়েছিলেন; কিন্তু ভালো ফলাফল করে বেরিয়ে গেলে তার সামনে নিশ্চয়ই একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছিল। যেহেতু মূকাভিনয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, ফলে এই পরিচয়টিও তার ক্যারিয়ার গড়তে হয়তো সহায়তা করত; কিন্তু কিছুই হলো না। বিকশিত হবার কালেই ঝরে গেল একটি ফুল। 

ঈদের পরদিন জরুরি কাজের কথা বলে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন হাফিজুর। এরপর তার আর কোনো খোঁজ না পেয়ে কসবা থানায় একটি জিডি করা হয়। ৮ দিন পর ঢাকা মেডিকেলের মর্গে হাফিজুরের লাশ শনাক্ত করেন তার বড় ভাই। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, এলএসডি (লাইসার্জিক এসিড ডাইইথ্যালামাইড) সেবন করেছিলেন এই তরুণ। আর তারপরই বিভ্রম ঘটায় নিজের গলায় ধারালো দা দিয়ে আঘাত করেন। এতে তার মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে শাহবাগ থানার ওসি সাংবাদিকদের বলেছেন, ১৫ মে রাত পৌনে ৮ টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলা নিজেই কাটতে থাকেন তিনি। আর বলছিলেন ‘আমাকে মাফ করে দাও’। হাফিজুর কার কাছে মাফ চাইলেন? কেন মাফ চাইলেন? তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে? আমরা কি তাকে মাফ করতে পেরেছি? 

হাফিজুরের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে গোয়েন্দারা যে তথ্য পেয়েছেন, সেটি আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। যেসব প্রশ্নের সুরাহা করা না গেলে আমরা হাফিজুরকে ক্ষমা করলেও হাফিজুরের আত্মা হয়তো আমাদের মাফ করবে না। আমরা দায়ী থাকব তার মতো অসংখ্য তরুণের কাছে। আমরা দায়ী থাকব এই সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। আমরা দায়ী থাকব এই সময়ের কাছে।

মৃত্যুর আটদিন পরে ঢাকা মেডিকেলের মর্গে হাফিজুরের পরিচয় শনাক্ত হয়। এর পর এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ খুঁজতে নেমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে হাফিজুরের অস্বাভাবিক মৃত্যু সঙ্গে এলএসডির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়ার কথা জানায় ডিবি। এর আগে নানারকম মাদকের ছোবল, বিশেষ করে ইয়াবার ভয়াবহতার কথা মানুষ জেনেছে; কিন্তু এলএসডির খবর সেভাবে জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলএসডি এক ধরনের বিভ্রম তৈরি করে। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, এলএসডি গ্রহণের পর বন্ধুদের একজন হাফিজুরকে বলেছিলেন, ‘মামা তুমি কাজটা ভালো করনি’। এরপর হাফিজুর কার্জন হলের মাঠ থেকে ছুটে বেরিয়ে যান। বন্ধুরা একবার সেখান থেকে ধরে এনেছিলেন। এরপর তিনি আবার বেরিয়ে যান। কয়েকজন রিকশাচালকের পা চেপে ধরে বলেন, ‘আমাকে মাফ করে দাও’। এরপরই তিনি ডাবওয়ালার কাছ থেকে দা নিয়ে নিজের গলায় কোপ দেন। হাফিজুরের অবস্থা দেখে ভয়ে কাউকে কিছু না বলে বন্ধুরা পালিয়ে যান।

প্রশ্ন হলো, এলএসডির মতো এই ভয়াবহ মাদক কী করে দেশে ঢুকল এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেহেতু এই মাদক গ্রহণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে অনেককে গ্রেফতার করেছে, ফলে বোঝাই যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই এই মাদক দেশে আসছে। ঠিক কত তরুণ ও যুবক এরই মধ্যে এই মাদকে আসক্ত হয়েছেন, সেই তথ্য জানা খুব কঠিন। যেহেতু এই মাদক বিদেশ থেকে আসে, সুতরাং এর সঙ্গে নিশ্চয়ই বিশাল চক্র আছে এবং সেই চক্রে হয়তো রাষ্ট্রের প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠীও জড়িত। এই চক্রকে ধরতে না পারলে এরকম আরও অনেককে হাফিজুরের পরিণতি ভোগ করতে হবে। অনেক স্বপ্নের অপমৃত্যু হবে। অনেক বাবাকে তার সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে করবস্থানে যেতে হবে। 

দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভেতরে কী হচ্ছে, কী রকম গ্যাং ও গ্রুপ তৈরি হচ্ছে, এলএসডির মতো ভয়াবহ মাদক কী করে সেখানে থাবা বসাচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি এর দায় এড়াতে পারে? বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পড়া মুখস্ত করা এবং তারপর একটি সার্টিফিকেট প্রদানের জায়গা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একজন তরুণের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তার জীবনবোধ গড়ে তোলাই শিক্ষকদের প্রধান কাজ। যদি সত্যিই শিক্ষকরা তাদের সেই দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাহলে হাফিজুরের মতো তরুণরা কি এলএসডির মতো ভয়াবহ মাদকে আসক্ত হতে পারতেন? ফলে আমরা যখন হাফিজুরের মৃত্যু নিয়ে কথা বলি, তখন এসব প্রশ্নও সামনে আনতে হবে। 

তৃতীয় প্রশ্ন হলো, হাফিজুরের মতো যে মেধাবী তরুণরা মফস্বল থেকে ঢাকায় এসেছেন নিজের জীবন গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অথবা যে তরুণরা ঢাকায় বেড়ে উঠেছেন এবং তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, তারা কোথায় যায়, কী করে, কাদের সঙ্গে মেশে- সেই খবর কি পরিবারগুলো ঠিকমতো রাখছে? এখানে অভিভাবকরা কি তাদের দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন? শুধু সন্তান জন্ম দেওয়াই কি অভিভাবকের কাজ? 

অস্বীকার করার উপায় নেই, সন্তানকে আপনি যত বেশি স্বাধীনতা দেবেন, সে আপনার কাছ থেকে তত দূরে সরে যাবে। আপনি তার ওপর যত বেশি নিয়ন্ত্রণ হারাবেন, সে তত বেশি বখে যাবে। আপনি জানবেনও না সে কাদের সঙ্গে মেশে, কী করে, কী দেখে, কী করতে চায়। তার ভেতরে ভেতরে কী পরিবর্তন হচ্ছে, সেটি আপনি টেরও পাবেন না। সুতরাং সন্তানকে স্বাধীনতা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবক যদি তার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে ব্যর্থ হন, তাহলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। 

স্মরণ করা যেতে পারে, রাজধানীর বনানীতে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় সাফাত আহমেদ নামে যে ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেছিলেন, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যে অপরাধ, তা তিনি জানেন না। তার ভাষ্য, তারা ‘মেয়ে বন্ধুদের’ সঙ্গে প্রায়ই পার্টিতে ‘এমনটা’ করে থাকে। জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা এতে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাদের ভাষ্য, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হিসেবে সাফাত উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করত। অনৈতিক কর্মকা-কে তার স্বাভাবিক বলেই মনে হতো।

প্রশ্ন হলো, কী ধরনের সমাজ আমরা নির্মাণ করেছি এই তরুণদের জন্য? কী ধরনের পারিবারিক কাঠামোর ভেতরে তারা বেড়ে উঠেছে? কী ধরনের মূল্যবোধ তারা পরিবার থেকে শিখেছে? সুতরাং সাফাত যে কথা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, এই অপরাধে কেবল তার একার নয়, তার অভিভাবকদেরও কি শাস্তির আওতায় আনা উচিত ছিল না, যারা ধর্ষণের মতো একটা গুরুতর অপরাধকেও অপরাধ বলে তাদের সন্তানদের শেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন? 

সুতরাং তাদের আয়ের উৎস চিহ্নিত করে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারলে সামাজিক চাপে এরকম দু’চারজন সাফাতের হয়তো বিচার হবে কিংবা উপযুক্ত নজরদারির অভাবে হাফিজুরের মতো অনেক তরুণ হয়তো বিকশিত হবার কালেই নিজের গলায় ডাব কাটার ধারালো দা দিয়ে নিজের গলায় কোপ দিয়ে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে; কিন্তু পৃথিবীর যে গভীরতর অসুখ- সেটি সারবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //