প্রবীণরা কারো দয়া বা করুণার পাত্র হতে পারেন না

বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস আজ ১৫ জুন (মঙ্গলবার)। এবারের প্রতিপাদ্য ‘একসেস টু জাস্টিস’ বা ন্যায় বিচার প্রাপ্তির অধিকার। জাতিসংঘের আহ্বানে ১৫ জুন বিশ্বের সব দেশ বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে থাকে।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হলো, সর্বপ্রথম ২০০৬ সালে আইএনপিইএ (International Network for the prevention of elder abuse) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) যৌথভাবে জাতিসংঘের কাছে প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতার জন্য একটি দিবস পালনের দাবি জানায়। জাতিসংঘ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ডিসেম্বর ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৬৬/১২৭ নম্বর রেজুলেশন গ্রহণ করে ১৫ জুনকে বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। সেই থেকে প্রতিবছর বিশ্বের প্রতিটি দেশ এইদিন টিকে যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করে থাকে। 

পৃথিবীর নির্যাতিত, নিপীড়িত, লাঞ্চিত ও বঞ্চিত মানুষের কাছে ন্যায় বিচারের দাবিটি এখন এক নম্বরে অবস্থান করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি মানুষের জীবনধারনের সীমাহীন কষ্টকে অনেকখানি লাঘব করেছে। অতীতের যেকোনো পরিস্থিতির চাইতে মানবজাতি অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। 

যতদিন যাচ্ছে ততই ন্যায় বিচারের দাবিটি অধিক জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে। মানুষ ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দাবিকে সবার আগে বিবেচনা করছে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা গেলে পৃথিবীর সব মানুষ চাহিদা মোতাবেক জীবনধারণে সক্ষম হতো। ন্যায় বিচারের অভাবে পৃথিবীর তাবৎ সম্পদ দিন দিন অল্প কিছু মানুষের হাতে পুঞ্জিভূত হচ্ছে। বাকি মানুষ সম্পদ সৃষ্টির জন্য অভাব, অনটন, দুঃখ-দুর্দশা মোকাবিলা করে টিকে আছে। 

পৃথিবীর শতকোটি মানুষের দাবিকে মর্যাদা দিয়ে জাতিসংঘ এবারের প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য করেছে একসেস টু জাস্টিস বা ন্যায় বিচার প্রাপ্তির অধিকার। জাতিসংঘ প্রতিপাদ্যে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছে; সেগুলো হলো- ভায়োলেন্স, অ্যাবিউস ও নেগলেক্ট।

ভায়োলেন্স বলতে আমরা বুঝি- সহিংসতা, সন্ত্রাস, হিংস্রতা, জুলুম, জবরদস্তি, উৎপীড়ন, বলৎকার, আক্রমণ, গজব ইত্যাদি। আমাদের দেশে কিছু প্রবীণ কমবেশি শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন। মারধর, কিল-ঘুষি, চড়-থাপ্পড়, ধাক্কা দেয়া, শ্বাসরোধ করা, ধারালো অস্ত্রের আঘাত, বেত বা লাঠির আঘাত ইত্যাদির মাধ্যমে ভায়োলেন্স করে। বেশিরভাগ ভায়োলেন্সের খবর রিপোর্ট হয় না কিংবা সংবাদ মাধ্যমে আসে না।

দৃষ্টির আড়ালে থাকা এসব দুষ্কর্ম্ম সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ খুবই দুরূহ কাজ। মানসম্মান, লোকলজ্জা, ভবিষ্যতে আরো নিগ্রহের কথা চিন্তা করে প্রবীণদের অনেকই জনসমক্ষে এসব প্রকাশ করতে নারাজ। তারপরও যতটুকু সামাজিক যোগাযোগ ও সংবাদমাধ্যমে আসে ততটুকু শুনলে আমাদের প্রবীণরা আতংকিত হয়ে পড়েন।

এবিউস বলতে আমরা বুঝি অবহেলা, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অযত্ন, অসম্মান, অমর্যাদা, অনাদর, অমনোযোগ, পরিহার, হেয় করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হেলাফেলা করা। বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই বিপুল সংখ্যক প্রবীণ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছেন। তারা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কাছে যথাযথ সম্মান মর্যাদা পাচ্ছেন না।

সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে প্রতিনিয়তই লক্ষ্য করা যায় যে, সম্পদের জন্য প্রবীণ পিতাকে মারধর কিংবা খুন করা হয়েছে। মাদকাসক্ত সন্তান টাকা না পেয়ে মাকে হত্যা করেছে। প্রবীণকে ভয় দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, নাজেহাল করে সহায় সম্পদ হাতিয়ে নেয়। ক্ষেত্র বিশেষ বলপ্রয়োগ কিংবা শারীরিক নির্যাতন করে চেকে স্বাক্ষর, ক্রেডিট-ডেবিট কার্ড নিয়ে যাবার মতো ঘটনা ঘটছে। ব্যক্তিগত ঋণ পরিশোধের জন্য প্রবীণ পিতামাতাকে চাপ সৃষ্টি করা হয়। 

প্রবীণ নারীর সম্ভ্রমহানির সংবাদ আমাদেরকে ভীষণভাবে ব্যথিত করে। বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ কিংবা নামমাত্র মূল্যে সম্পত্তি বিক্রির ঘটনাও আমাদের নজরে পড়ে।

আমাদের সমাজে প্রবীণ পিতামাতা, শ্বশুর-শাশুড়িকে গালাগাল, কটুবাক্য, কটুক্তি, নিন্দা, অপমান, অসম্মান করার ঘটনা প্রতিনিয়ত দেখি ও উপলব্ধি করতে পারি। প্রবীণের নামে বদনাম ছড়িয়ে কুৎসা রটিয়ে নাজেহাল করে বিকৃত আনন্দ লাভের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দেখতে পাই। 

প্রবীণ পরিবারের সাথে থাকলে সন্তান লালনপালন, রান্নাবান্নার কাজ, বাসা পাহারা, বাজার করা, বাচ্চাদের স্কুল-কোচিংয়ে নেয়ার কাজ কেউ কেউ অনিচ্ছা সত্ত্বেও করে থাকেন।

প্রবীণদের অবহেলা করার নানান রকমের কায়দাকানুন রয়েছে। যেমন- একজন প্রবীণকে দেখে সালাম না দেয়া কিংবা না দেখার ভান করে চলে যাওয়া। কোনো কাজে অফিস আদালতে হাজির হলে সংশ্লিষ্টদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হওয়া, যথাসময়ে চিকিৎসা শুরু করার ক্ষেত্রে অযথা বিলম্ব করা, ওষুধ পথ্যের সরবরাহের ক্ষেত্রে অমনোযোগী হওয়া, উন্নত চিকিৎসার ক্ষেত্রে গড়িমসি করা, পরিবারের সদস্যদের গতানুগতিক সেবা, প্রবীণদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ না হওয়া। ভরণপোষণ জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের মতভিন্নতা চরম অসম্মানজনক। ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজনরা কথা বন্ধ করে দিয়ে চরম অবহেলা প্রদর্শন করে থাকে। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে সহায়তা না পাওয়া, বিনোদনমুলক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আগ্রহও পরিবার-সমাজের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে সম্ভব হয় না অনেক সময়।

সমাজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রবীণদের সম্মানজনক স্থানে বসার সুযোগ কম। সামাজিক উন্নয়নে সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে অনেক কম। আমাদের মনে রাখতে হবে আজকের বর্তমান প্রবীণরা গড়েছেন। তারা কারো দয়া কিংবা করুণার পাত্র হতে পারেন না। স্বস্তিদায়ক, শান্তিপূর্ণ,  সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার প্রতিটি প্রবীণের রয়েছে। 

জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩, রাষ্ট্রপতি কতৃক সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা সরাকারের নেয়া গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।  সরকার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৭ লাখ প্রবীণকে বয়স্ক ভাতার আওতায় নিয়ে এসেছে। সার্বজনীন পেনশন চালু করার পরিকল্পনা সরকারের বিবেচনায় আছে। 

কোভিড-১৯ আমাদের প্রবীণদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। করোনা চলাকালীন আমাদের অনেক প্রবীণ যথাযথ সেবাযত্ন  চিকিৎসা পাননি। কেউ কেউ অবহেলার শিকার হয়েছেন। প্রবীণদের অনেকে মানসিক সংকটে পড়েছেন। সরকারের নানা রকমের উদ্যোগ থাকার পরও প্রবীণদের অনেকেই ন্যায় বিচার পাবার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছেন। প্রবীণের ন্যায় বিচারপ্রাপ্তির অধিকার বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবার কার্যকর ভূমিকা পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //