মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে চাই মানবকল্যাণমুখী শিক্ষা

হযরত মুহম্মদের (সা.) একটি আদর্শ শিক্ষা কবিতায় ফুটে উঠেছে। ভিক্ষা চাওয়া এক লোককে অর্থ সাহায্য না দিয়ে নিজস্ব সহায় সম্পদ দিয়ে সংসার চালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন নবী। যেকোনো ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির জন্য এ এক আদর্শ শিক্ষা। 

‘তিন দিন হতে খাইতে না পাই, নাই কিছু মোর ঘরে,

দারা পরিবার বাড়িতে আমার উপোস করিয়া মরে,

নাহি পাই কাজ, তাই ত্যাজি লাজ বেড়াই ভিক্ষা করি,

হে দয়াল নবী, দাও কিছু মোরে, নহিলে পরানে মরি। 

নবীর শিক্ষা, ‘কর না ভিক্ষা, মেহনত কর সবে।’

এ কবিতা আমাদের শিক্ষা দেয়, উন্নয়নের জন্য নিজস্ব মেধা, শ্রম আর সীমিত সম্পদের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে সুচারুভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হলে সার্থকতা লাভ করা যায়। বিশ্বব্যাপী মানুষ উন্নয়নের জন্য কাজ করলেও মানব সমাজের সার্বিক উন্নয়ন কাক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা পায়নি। আর তাতেই পৃথিবীতে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বিভাজন দেখা যায়। আমাদের দেশে মানুষ অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়ে জীবন সংগ্রামে হাবুডুবু খাচ্ছে। সিংহভাগ ধর্মপ্রাণ মানুষের দেশে এমনটাতো হওয়ার কথা নয়। 

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফামের তথ্য মোতাবেক বিশ্বের ২৬ জন ধনী ব্যক্তির কাছে যে পরিমাণ সম্পদ আছে তা বিশ্ব জনসংখ্যার অর্ধেকের সমান। ২৬ জন মানুষের হাতে গচ্ছিত সম্পদ ৩৮০ কোটি মানুষের সম্পদের সমান। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় গর্বিত একটি দেশ, সমাজতন্ত্র যাদের অন্যতম মূল স্তম্ভ সেই দেশও বিশ্বের ধনীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। আমাদের দেশে অতি ধনীদের সংখ্যা, বৃদ্ধির দিক থেকে শতকরা হিসেবে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের মধ্যে ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধির হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে দেশের উন্নয়নের আকার বেড়েছে, জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র কমেছে; কিন্তু এসবের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়েছে। সরকার যে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে তা বেশি সম্পদের মালিকদের ভাগে চলে যাচ্ছে আর যারা কম সম্পদের মালিক তাদের ভাগে তুলনামূলক অনেক কম অংশ যাচ্ছে। এতে ধনীরা আরও ধনী ও দরিদ্ররা আরও দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। 

অনেকেই মনে করেন বিশ্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যখন ছিল তখন আজকের মতো বৈষম্য দেখা যেত না। আমরাও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলাম। অথচ আজ শুধু আয়ে নয়, পাশাপাশি ভোগে এবং সম্পদে বৈষম্য আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। উন্নয়ন আর অগ্রগতির জোয়ারে আজ আমরা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে হালকা করে রেখেছি এবং সমাজতন্ত্রকে সাত হাত মাটির নিচে চাপা দিয়ে দিয়েছি। সংবিধানকে পবিত্র বিবেচনা করে নির্দেশনা মানার চাইতে যত্ন করে তুলে রেখে সম্মান জানাচ্ছি। এতে করে বিচিত্র এক মসনদ কেন্দ্রিক রাজনীতিক-সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সেই পরিবেশে পড়ে মানুষের সার্বিক কল্যাণের উন্নয়ন পথ হারিয়ে ফেলেছে, ফলে দেশের কোটি কোটি মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। 

দেশের শ্রমিকের শ্রম দিনে দিনে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। সমাজে গায়ে-হাতে তেল-কালি মাখা মানুষের চাইতে ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ-কালোবাজারি-মজুদদাররা অনেক বেশি সম্মানিত। আমাদের কৃষক মাঠে কাজ করে। শস্যের মৌসুম শেষে অবসরে কাপড়বুনন, অন্য হাতের কাজে নিয়োজিত হয়। এরা বাঁচার তাগিদে যৎসামান্য আহার গ্রহণ করে সারাদিন রাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও একবেলা পেট ভরে খাবার জোগাড় করতে পারে না। অথচ এদের শ্রমে গড়ে উঠছে এক শ্রেণির মানুষের সম্পদের পাহাড়। আমাদের গার্মেন্টস শিল্প এসব শ্রমিকের শ্রমের ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে। শ্রমিকদের প্রাপ্য শ্রমের মূল্য যথাযথভাবে প্রদান না করাই শিল্পের মুনাফার অন্যতম সোপান। করোনাকালীন মহাআপদেও শিল্প-কারখানা চালু রাখতে শাসক শ্রেণি বাধ্য হচ্ছে ব্যবসায়ী নিয়ন্ত্রিত নীতি নির্ধারকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য। 

১৯৭১ সালে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী গর্বিত জাতি বাঙালি। সেই বাঙালিও করোনা মহামারির বিধ্বংসী রূপ দেখার পর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে ব্যর্থ হলো। কেউ অর্থনীতি রক্ষার জন্য, কেউ জীবিকার জন্য, কেউ সংস্কৃতি রক্ষার জন্য নিবেদিত হয়ে পড়ল। আর শাসক শ্রেণি উন্নয়ন ও অগ্রগতি রক্ষায় নির্বিকারভাবে সবাইকে সহযোগিতা করে চলল। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য জীবন বাঁচাতে বাঙালি যে যোগ্যতা দেখিয়েছিল তা নির্দিষ্ট অল্প কিছু দিনের জন্য করতে পারল না। এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ পরের শ্রমে নিজের ভাগ্য গড়ে তোলা মানুষের স্বার্থপরতা। জনকল্যাণের আস্ফালনে প্রভাবশালীদের স্বার্থরক্ষায় লকডাউনের মধ্যে একটি একটি করে শর্ত ভাঙার প্রতিযোগিতা দেখা গেল। কঠিন লকডাউন কঠিন হবার কথা কিন্তু তার মধ্যে স্বার্থ লুকিয়ে থাকলে তা কঠিন থাকতে পারে না। দ্বিতীয় দফার লকডাউন তাইতো ইতিমধ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছে। 

আমাদের এমনটা হবার কথা ছিল না। আজকের এ মহামারিতে মানুষ শুধু করোনার বিধ্বংসী রূপই দেখছে। তার গতি প্রকৃতি, প্রতিরোধের উপায় সবই তার অজানা। আজ কি তবে জীবন রক্ষার তাগিদ গৌণ হয়ে পড়ল! এখন আমরা নিজে কত বড় তা প্রমাণেই ব্যস্ত। স্বজাতির শাসন শেখাতে পারেনি অন্যদের অবদানকে মূল্যায়ন করতে। তারপরও বিক্ষিপ্তভাবে চেতনার মধ্যে মহানুভবতা এসে পড়লে তা স্তিমিত হতে সময় লাগে না। এখানেও ২/১ জন সুযোগ নেয় মহান হবার। প্রথম লকডাউনে দেশের মানুষ দেখেছে কিছু মানুষ মহানুভবতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সরকারও হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি; কিন্তু শেষ বিচারে দেখা গেল স্বজনপ্রীতি আর চুরিতে সব একাকার। কোনো দায়দায়িত্ব নেই, জবাবদিহিহীন পরিবেশ। সরকার রফতানিমুখী শিল্প মালিকদের জন্য যে প্রণোদনা ঘোষণা করল সেই পরিমাণ অর্থ সামাজিক সুরক্ষায় ব্যয় করল না। মহান মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অবদানকে যেমন মাইক্রোসকোপের তলায় নিয়ে আসা হয়েছে, ঠিক তেমনি করোনা যুদ্ধেও সাধারণ মানুষের জীবন বাঁচানোকে গৌণ করে ফেলা হয়েছে। 

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেন, ‘জনগণের সক্ষমতার বিকাশ হচ্ছে উন্নয়ন’। উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে জনগণের গড় আয়ু, শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যতা, মানবাধিকার, নারীর সম-অধিকার, নিরাপত্তা, কল্যাণ বিবেচনায় এসেছে। মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়ার উন্নয়ন পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন না হলেও কিছু মানুষ আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছে। দীর্ঘ পরাধীনতার কারণেই হোক বা বর্তমান শাসক শ্রেণির কর্মকা-েই হোক মানুষ তার নিজের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না। নিজস্ব মেধা, শ্রম আর সম্পদের চাইতে পরনির্ভরতা জাকিয়ে বসেছে। কৃষি যুগের পর থেকে মানুষের মধ্যে যে স্বার্থপরতা দানা বেঁধেছে এ ঘটনাক্রম তারও ফলাফল হতে পারে। দুর্ভাগ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভাবনার মুক্তি দিতে পারল না। 

‘মানুষ মানুষকে পণ্য করে

মানুষ মানুষকে জীবিকা করে’

ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত গানের কথাটুকু আমাদের সমাজের জন্য খুব বেশি প্রযোজ্য। উন্নয়ন ও অগ্রগতি চলমান ধারায় জাতির সুষম অগ্রযাত্রা সম্ভব হচ্ছে না। পিছিয়ে পড়া ক্ষমতাহীন মানুষগুলো সমস্যার কথা বলতে পারছে না। চিন্তা করতে পারছে না। স্বাধীনতা এসব মানুষকে চিন্তা করার শক্তি ও ক্ষমতা দিতে পারল না। শুধু ইসলাম নয়, সকল ধর্মই মুক্তিকামী মানুষের কল্যাণে বাড়তি সম্পদ ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছে; কিন্তু ধর্মপ্রাণ বাঙালি তাদের বাড়তি সম্পদ মুক্তিকামী মানুষের জন্য ব্যয়ে উৎসাহিত নয়। 

সরকার যতই শিক্ষা ব্যবস্থায় মানব কল্যাণের গল্প-কবিতা বাদ দিয়ে ধর্মীয় চেতনার গল্প-কবিতার সংযোগ ঘটাক তাতে কোনো উপকার হয়েছে বলে মনে হয় না। আজ তাই নিজস্ব মেধা, শ্রম আর সম্পদের ওপর নির্ভরতা এবং মানবকল্যাণের বিষয়ে শিক্ষার প্রয়োজন। এ শিক্ষাই পারবে মানুষে মানুষে বৈষম্য, অর্থনৈতিক সমস্যা, শিক্ষার বৈষম্য, ভোগের বৈষম্য, সম্পদের বৈষম্য, সেবার বৈষম্য, প্রাপ্তির বৈষম্য রোধ করতে। এতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করা হবে। এতে সংবিধানের সমাজতন্ত্র বাস্তবায়িত হবে। 

লেখক : সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //