সোশ্যাল মিডিয়ার ভাষা : ভীতি ও রীতি

ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল জি বাংলার অনুষ্ঠান সা-রে-গা-মা-পায়ে গান গেয়ে পরিচিতি পাওয়া বাংলাদেশি তরুণ শিল্পী মাঈনুল আহসান নোবেল সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ফেসবুকে বেফাঁস মন্তব্য করে। শুধু তাই নয়, এ কারণে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে এই আইনে মামলার আবেদন করেছেন গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইথুন বাবু। গত ২ জুন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আস সামছ জগলুল হোসেনের আদালতে মামলার আবেদন করা হয়। 

এর আগে ২৩ মে নোবেলের বিরুদ্ধে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ইথুন বাবু। পরে ৩১ মে মানহানিকর পোস্ট দেয়ার অভিযোগ এনে নোবেলের বিরুদ্ধে ঢাকা জজকোর্টে মামলা করেন তিনি। এরপর হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা। 

নিজের ফেসবুক পেজ ‘নোবেল ম্যান’ থেকে দেশের স্বনামধন্য একাধিক শিল্পীকে নিয়ে মানহানিকর পোস্ট দেয়ার অভিযোগ ওঠে নোবেলের বিরুদ্ধে। এসব পোস্টের একটিতে ইথুন বাবুকে চোর বলে আখ্যায়িত করা হয়। পোস্টে লেখা হয়, ‘ইথুন বাবু একজন চোর। অন্যের গান নিজের নামে চালায় দিসে।’

ঈদের আগের রাতে গত ১৩ মে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী জেমসকে নিয়েও একাধিক আপত্তিকর স্ট্যাটাস দেন তিনি। তিনি তার ফেসবুক পেজে লেখেন: ‘ওই জেমস! ঈদের গান কই? নাকি ভয়েস গেছেগা’। আরেকটি পোস্টে নোবেল লেখেন, ‘তোদের সো কল্ড লেজেন্ড জেমসের কয়ডা গান রিলিজ হইসে গত কয়েক বছরে? ঝিমায় গেছে নাকি? লুল!’ জেমসকে গান বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে নোবেল লেখেন, ‘বেটা বয়স হইসে। এবার বাদ দে গান বাজনা। বহুত করসোস।’ শুধু তাই নয়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্কেও বিতর্কিত মন্তব্য করায় তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন সুমন পাল নামে ত্রিপুরার এক যুবক।

এখানেই শেষ নয়। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি প্রখ্যাত গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, রবীন্দ্রনাথের লেখা জাতীয়সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যতটা না দেশকে (বাংলাদেশ) এক্সপ্লেইন করে, তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি এক্সপ্লেইন করে প্রিন্স মাহমুদ স্যারের লেখা ‘বাংলাদেশ’ গানটি।

দেখা যাচ্ছে, একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে বারবার ঝামেলায় জড়াচ্ছেন এই তরুণ শিল্পী। তিনি যে এসব না বুঝে করছেন বা তিনি যে মানসিক ভারসাম্যহীন, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রশ্ন হলো, তিনি কী সচেতনভাবেই বিতর্ক জন্ম দেয়ার জন্যই এসব করছেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনায় থাককেই কি তিনি এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছেন?

সম্প্রতি অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তার মাকে নিয়ে ফেসবুকে যে স্ট্যাটাস দেন তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকেই এমন সব মন্তব্য করেছেন, তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে যেভাবে টিপ্পনি কেটেছেন, তা শালীনতা-ভদ্রতা ও সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। অনেকের মন্তব্যে বোঝা গেছে যে, চঞ্চল চৌধুরী যে মুসলমান নন, সেটি তার মায়ের সিঁদুর পরা ছবি দেখে তারা বুঝতে পেরেছেন। অনেকেই নাকি এতদিন ভেবেছিলেন যে চঞ্চল চৌধুরী মুসলমান; কিন্তু মায়ের সঙ্গে ছবি দেখে সেই ভুল ধারণা ভেঙে যায়। প্রশ্ন হলো, চঞ্চল চৌধুরী হিন্দু কি মুসলমান, তার মা কপালে সিঁদুর পরলেন না-কি হিজাব পড়ে ছবি তুললেন, তা নিয়ে আমাদের আপত্তি কেন? চঞ্চল চৌধুরী হিন্দু জানলে কি সমালোচকেরা তার অভিনয় কম পছন্দ করতেন? 

সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু কিছু শব্দ মাঝে মধ্যেই বেশ জনপ্রিয় বা বহুল ব্যবহৃত হয়। যেমন- ছাগু, হেফাজতি, জামাতি, বামাতি, শিবির, রাজাকার, দালাল, চেতনাজীবী, সহমত ভাই ইত্যাদি। এই শব্দগুলো মূলত ব্যক্তিগত আক্রমণের জন্য ব্যবহার করা হয়। সব সময় যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বেলায় এসব শব্দ ব্যবহার করা হয় তাই নয়, বরং নিজের মতামতের সঙ্গে না মিললে, অর্থাৎ ভিন্নমতের কোনো মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে গিয়েও অনেক সময় এসব শব্দ ব্যবহার করা হয়। শুধু যে সমাজের অনগ্রসর বা কম পড়ালেখা করা মানুষেরাই তাদের প্রতিপক্ষের বেলায় এসব শব্দ ব্যবহার করেন তা নয়, বরং সমাজের অগ্রসর অংশের মানুষ হিসেবে পরিচিত বা শিক্ষিত এবং ভালো চাকরি করেন এমনকি শিক্ষকতা-সাংবাদিকতা কিংবা চিকিৎসার মতো সম্মানজনক পেশারও অনেকে এইসব শব্দ ব্যবহার করেন।

‘ছাগু’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় কাউকে জামাত-শিবির বোঝাতে। ‘হেফাজতি’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় কাউকে প্রো-ইসলামিক বুঝাতে। ‘বামাতি’ বলা হয় বামপন্থিদের কটাক্ষ করতে। অর্থাৎ জামাতের সঙ্গে মিল রেখে। ‘দালাল’ শব্দটি সব পক্ষের বা সব মতের লোকদের ক্ষেত্রেই তাদের বিরোধিরা প্রয়োগ করেন। যেমন- বিএনপিপন্থিরা তাদের প্রতিপক্ষকে আওয়ামী লীগের দালাল এবং আওয়ামীপন্থিরা তাদের প্রতিপক্ষকে বিএনপি-জামায়াতের দালাল বলে অভিহিত করেন। ‘চেতনাজীবী’ শব্দটি মূলত প্রো-আওয়ামী লীগারদের কটাক্ষ করতে ব্যবহার করা হয়। কারণ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে। 

‘সহমত ভাই’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় যারা ক্ষমতাবান লোকদের যে কোনো পোস্টে একমত পোষণ করে প্রতিক্রিয়া জানান, তাদের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ভাইয়ের সব কথার সঙ্গে যারা একমত। এখানে ভাই বলতে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কোনো নেতা। 

তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবহৃত গালির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে ‘রাজাকার’। কারণ এটি আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে ঘৃণিত শব্দ। একাত্তর সালে যিনি ছিলেন শিশু, শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে তাকেও ‘রাজাকার’ বলে গালি দেয়ার প্রবণতা আছে। অথচ ২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পরামর্শ দিয়েছিলেন, অপরাধ প্রমাণিত হবার আগে কাউকে যেন ‘রাজাকার’ বলা না হয়। নওগাঁ ও জয়পুরহাট জেলায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত তিনজনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তদন্ত দল এবং প্রসিকিউটরদের পক্ষ থেকে আবেদন দেওয়া হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক প্যানেল এই পরামর্শ দেন। তদন্ত দলের চিঠিতে অভিযুক্তদের নামের আগে ‘রাজাকার’ শব্দটি উল্লেখ থাকায় অভিযুক্তদের আইনজীবী এ নিয়ে আপত্তি তোলেন (বিবিসি, ৩০ এপ্রিল ২০১৭)। অথচ আমরা নিজের মতের সঙ্গে না মিললেই বা কারও কোনো বক্তব্য সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত বা নীতির বিরোধী হলেই তাকে অনায়াসে ‘রাজাকার’ বলে গালি দিচ্ছি এবং সেটি ফেসবুকের মতো ওপেন প্ল্যাটফর্মেই।

ফেসবুক এতই ওপেন একটি প্ল্যাটফর্ম যে, এখানে আপনি যা লিখছেন, যে ছবি আপ করছেন বা যে সংবাদ শেয়ার করছেন, তা সবই আপনার সঙ্গে যুক্ত মানুষজন দেখতে পান। ফেসবুকে যদি আপনার সঙ্গে আপনার বাবা, মা, ভাই, বোন, অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধব যুক্ত থাকেন, তাহলে তারা সবাই আপনার মন্তব্য, স্ট্যাটাস, শেয়ার দেখতে পাচ্ছেন। কার স্ট্যাটাসে আপনি কী প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, তাও দেখছেন। সুতরাং ফেসবুকের মতো এত ওপেন একটি প্ল্যাটফর্মে আপনি কী করছেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণও বটে। 

আমরা অনেক সময় নিজেদের ক্ষোভ ঝাড়ার জন্য স্ল্যাং ব্যবহার করি; কিন্তু আপনার এই স্ল্যাংটা তো আপনার সঙ্গে ফেসবুকে যুক্ত মানুষেরাও দেখলেন। প্রশ্ন হলো, আপনার এই রাগের মাথায় লেখা স্ল্যাংটি কি সবাই দেখার জন্য প্রস্তুত? আপনার শিক্ষক বা বাবা  অথবা বাবার বন্ধু কিংবা আপনার অফিসের ঊর্ধ্বতন কেউও তো শব্দটি দেখতে পারেন। সুতরাং তারা আপনার সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবেন?

ফেসবুক আসলে এমন একটি মাধ্যম যেটি এখন অনেক সময় মূলধারার গণমাধ্যমকেও চ্যালেঞ্জ করে। কারণ অনেক সংবাদই গণমাধ্যমের আগে ফেসবুক মারফত মানুষ জেনে যায়; কিন্তু তারপরও ফেসবুক কোনো গণমাধ্যম নয়। কারণ ফেসবুকে আপনি যা খুশি লিখতে পারেন। আপনার লেখাটি কোনো একজন সম্পাদকের হাতে সম্পাদিত হয়ে যাচ্ছে না। মূলধারার গণমাধ্যমের সঙ্গে এখানেই সোশ্যাল মিডিয়ার প্রধান পার্থক্য যে, গণমাধ্যমে একজন সাংবাদিক চাইলেই যা খুশি লিখতে বা বলতে পারেন না; কিন্তু ফেসবুকে আপনি যে কাউকে একটা গালি দিয়ে দিতে পারেন। আপনার মতের সঙ্গে না মিললে আপনি তাকে ছাগু, জামায়াতি, দালাল, রাজাকার বা আরও কোনো গালি দিয়ে দিতে পারেন। 

ভয়ংকর ব্যাপার হলো, এই গালাগালি এখন আর ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। বরং অনেক ইস্যুতেই সম্মিলিতভাবে যেমন প্রপাগান্ডা ছড়ানো হয়, তেমনি টার্গেট করে কাউকে সম্মিলিতভাবে গালাগালও করা হয়। অনেক সময় এই কাজগুলো পলিটিক্যাল এজেন্ডা হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ফলে ফেসবুকে আপনি ব্যক্তিগতভাবে কোনো একটি বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেই, যে পার পেয়ে যাবেন বিষয়টি এমন নয়। বরং অবস্থা বেগতিক হলে আপনি এরকম কোনো গ্রুপের টার্গেটে পরিণত হয়ে যেতে পারেন এবং তাতে আপনার জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে।

সুতরাং পকেটে স্মার্টফোন আর তাতে ইন্টারনেট কানেকশন আছে মানেই আপনি প্রচণ্ড স্বাধীন একজন মানুষ এবং প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে যা খুশি করে ফেলবেন, যা খুশি লিখে ফেলবেন- এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। বরং আপনার পকেটে একটি স্মার্টফোন এবং তাতে ইন্টারনেট কানেকশন আছে মানেই হলো আপনি একটি অ্যাটম বোমা পকেটে নিয়ে ঘুরছেন। সেই বোমা দিয়ে আপনি নিজে যেমন অন্যকে মারতে পারেন, তেমনি আপনি নিজেও এই বোমায় নিহত বা আহত হতে পারেন।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //