কালো টাকার মালিক কারা?

এবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর থেকেই কালো টাকা নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়, সেখানে মূল বিষয় ছিল সংশয়। অর্থাৎ এবারও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে কি-না; কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করলে টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না ইত্যাদি।

তবে বাজেট ঘোষণার আগে গত ১৯ মে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘দেশে যত দিন পর্যন্ত অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, তত দিন পর্যন্ত এই অর্থ সাদা করার সুযোগ বহাল থাকবে।’

অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি-না- সে প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেননা সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করবে, যেখানে সাধারণ নীতি হিসেবে কোনো ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করতে সমর্থ হবেন না এবং যেখানে বুদ্ধিবৃত্তিমূলক ও কায়িক সব প্রকার শ্রম সৃষ্টিধর্মী প্রয়াসের ও মানবিক ব্যক্তিত্বের পূর্ণতর অভিব্যক্তিতে পরিণত হবে। সংবিধানের এই বিধান মতে, অনুপার্জিত আয়কে রাষ্ট্র বৈধতা দিতে পারে না।

বিশেষ পরিস্থিতিতে, বিশেষ ব্যবস্থায় এটি মেনে নেয়া গেলেও অর্থমন্ত্রীর ভাষায় যতদিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, ততদিন এই টাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে ঘোষণার অর্থই হলো, রাষ্ট্র কালো টাকা উপার্জনে নাগরিকদের বাধা দিতে রাজি নয়। অর্থাৎ যে যেভাবে পারো পয়সা কামাও; কিন্তু সরকারকে ১০ শতাংশ কর দিয়ে সেই টাকা সাদা করে নাও। এ ধরনের ব্যবস্থা যতটা না সংবিধান পরিপন্থি, তার চেয়ে বেশি অনৈতিক। কেননা এই ব্যবস্থা সৎ পথে উপার্জনকারী নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক। এ রকম অনুপার্জিত আয় কর ফাঁকি, মানি লন্ডারিং এবং নানা প্রকার দুর্নীতি থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে।

কালো টাকার মালিক শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে তার অবৈধ আয়কে বৈধ করতে পারলে সৎ করদাতাদের জন্য সেটি এক ধরনের পরিহাস। কালো টাকা উপার্জনকারীরা ১০ শতাংশ কর দিয়ে যখন পুরো অবৈধ আয়কে বৈধ করার সুযোগ পান, তখন এর অর্থই হলো কালো টাকা আয় করা কোনো খারাপ কাজ নয়। এটি প্রকারান্তরে বিভিন্ন চাঁদাবাজি ও ঘুষকে উৎসাহিত করে। তাছাড়া বছরের পর বছর এ ধরনের সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনীতির কী উপকার হয়েছে, সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

স্মরণ করা যেতে পারে, বিগত অর্থবছরের বাজেটেও অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করা এবং অর্থ পাচারকে সুকৌশলে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে সচল করা, রাজস্ব আয় ও বিনিয়োগ বাড়ানো এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির নামে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন দুটি ধারা সংযোজনের মাধ্যমে জমি, ভবন, ফ্ল্যাট কেনা, নগদ অর্থ, ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার ও বন্ডে অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অর্থের বা সম্পদের উৎস নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন তোলার বিধানটিও রহিত করার প্রস্তাব করা হয়।

গত ২৪ জুন একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল: কালো টাকার উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করা নিষেধ। খবরে বলা হয়, জমি-ফ্ল্যাট কেনার পাশাপাশি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ শেষ ৩০ জুন। এমনকি নগদ টাকা ও ব্যাংকে রাখা টাকা সাদা করার সুযোগের মেয়াদও শেষ হচ্ছে; কিন্তু তারপরও আয়কর অধ্যাদেশের একাধিক ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে আয়তনভেদে কর দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ফ্ল্যাট কিনে টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগেরও সুযোগ হয়েছে।

কয়েক বছর আগে আয়কর অধ্যাদেশে ১৯ নামে একটি ধারা যুক্ত করা হয়। সেখানে বলা হয়, কোনো কর দাতা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অপ্রদর্শিত আয় ঘোষণায় আনতে পারবেন। এ জন্য অপ্রদর্শিত অর্থের ওপর ২৫ শতাংশ কর (ওই বছরের সর্বোচ্চ করহার) এবং ওই করের ওপর ১০ শতাংশ জরিমানা অর্থাৎ সাড়ে ২৭ শতাংশ কর দিয়ে ঘোষণায় আনা যাবে। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, প্রায় প্রতি বছরই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলেও গত এক দশকের মধ্যে চলতি অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি কালো টাকা সাদা হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সব মিলিয়ে ১০ হাজার ৩৪ জন করদাতা কালো টাকা সাদা করেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে।

তবে কালো টাকা বলতে আমরা শুধু সমাজের দৃশ্যমান বড় লোকের অদৃশ্য আয়ের অপ্রদর্শিত অর্থকেই বুঝে থাকি। অথচ এর বাইরেও প্রচুর কালো টাকা রয়েছে- যা নিয়ে খুব বেশি কথা হয় না।

মূলত সমস্ত কালো টাকার মালিক সাধারণ মানুষ। অর্থাৎ এই টাকাগুলো ভুক্তভোগী মানুষের কাছ থেকে কখনো পাড়ার মাস্তান, কখনো পুলিশ, কখনো সরকারি কর্মচারীসহ রাষ্ট্রের নানা স্তরের ক্ষমতাবান লোকেরা অবৈধ উপায়ে, কখনো সেবা দেওয়ার বিনিময়ে, কখনো রাস্তায় গাড়ি আটকিয়ে স্রেফ মাস্তানি করেই আদায় করে থাকে। এভাবে সারা দেশ থেকে প্রতিদিন দোকানদার, গাড়ির চালক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সেবা গ্রহীতাদের কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়- তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। যেহেতু এ সব টাকার কোনো রসিদ নেই; যেহেতু এই টাকা যারা গ্রহণ করেন, যাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয়। তারা এই আয়ের বিপরীতে কর দেন না অর্থাৎ যেহেতু এটিকে প্রদর্শন করা হয় না- অতএব, এটিও অপ্রদর্শিত আয় তথা কালো টাকা। 

ট্র্যাজেডি হলো, অর্থমন্ত্রী যেমনটি বলেছেন যে, যতদিন দেশে কালো টাকা থাকবে, ততদিন এটি বৈধ করারও সুযোগ থাকবে, সেই হিসেবেও এই ঘুষ ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্জিত টাকা নির্দিষ্ট পরিমাণে কর দিয়ে বৈধ করার সুযোগ নেই। অতএব এই উপায়ে অর্জিত অর্থ সারাজীবনই কালো থেকে যাবে এবং এই কালো টাকা উপার্জন বন্ধে রাষ্ট্রও কোনো শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে না বা করতে পারে না। কারণ যারা এভাবে চাঁদাবাজির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়, তাদেরও নানা কারণেই রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়। তাদের রাজনীতি ও ভোটের মাঠে প্রতিপক্ষ দমন এবং নির্বাচনের সময় কাজ লাগে; কিন্তু এসবের বিনিময়ে যেহেতু তাদের নির্ধারিত বেতন দেওয়া হয় না,

তাই তাদের জন্য সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারির বাইরেও অর্থনীতির ইনফরমাল সেক্টর থেকে চাঁদা আদায়ের পথ খুলে রাখা হয়। কেউ এর বিরোধিতা করে না। বরং যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এসব প্রতিহত করবে, তারাও এই আয়ের সঙ্গে যুক্ত। বছরের পর বছর ধরে এখানে একটি অলিখিত সমঝোতা রয়েছে। সুতরাং যখন কালো টাকা সাদা করার প্রশ্ন আসে, তখন ফরমাল কালো টাকার বাইরে এসব ইনফরমাল কালো টাকা নিয়েও আলোচনা করা দরকার এবং কীভাবে এই কালো টাকার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা যায়- তা নিয়েও ভাবা দরকার। 

সবচেয়ে বড় কথা, আপনি টাকার উৎস জানতে চাইলেন কি চাইলেন না সেটি আইনের প্রশ্ন; কিন্তু যুক্তি ও নীতির প্রশ্ন হলো, এই টাকা আসলে কার? অর্থাৎ মি. রহিম যে একশ’ কোটি টাকার মালিক হলেন, সেই টাকা সাদা করতে গিয়ে তিনি রাষ্ট্রকে ১০ শতাংশ কর দিলেন, তাতেও এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, তিনি এই একশ’ কোটি টাকা কোথা থেকে কোন প্রক্রিয়ায় আয় করলেন? কর দিয়েছেন বলেই তাকে প্রশ্ন করা যাবে না- এর অর্থই হলো রাষ্ট্রে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জন বৈধ। এভাবে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু নৈতিক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠন কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //