কার্যত বিবস্ত্র ও ফিউশন

সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘ড্রেস কোড’ আছে। ইউনিফরমধারী চাকরিজীবী যেমন- সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, আধাসামরিক বাহিনী অর্থাৎ বিজিবি এবং পুলিশ, আনসারকে দায়িত্ব পালনকালীন নির্ধারিত পোশাক পরতে হয়। এ ধরনের অন্যান্য বাহিনী যেমন- জেল, ফায়ার সার্ভিস এবং আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত পোশাক পরতে হয়।

সাদা চোখে অন্যান্য সরকারি কর্মচারীকে নির্ধারিত পোশাক নেই মনে হলেও তাদের জন্য পোশাক নির্দেশনা রয়েছে। সরকারি বেতন গ্রেডের ১৭ থেকে ২০ গ্রেডভুক্ত কর্মচারী, যারা চাকরিতে স্থায়ী হয়েছেন তাদের সরকারিভাবে বিনামূল্যে পোশাক দেওয়া হয় এবং দায়িত্ব পালনকালে এই পোশাক পরা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক। 

পোশাক গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন এই দু’ধরনের দেওয়া হয়। এতে পুরুষদের জন্য থাকে ফুল সাফারি শার্ট, হাফ সাফারি শার্ট, জুতা, মোজা, ছাতা, নামের ব্যাজ, ভি-গলা ফুল সোয়েটার, ফুল শার্ট ও হ্যান্ড গ্লাভস। বরাদ্দ প্রতিজনের জন্য প্রায় আট হাজার টাকা। তবে ডেস্প্যাচ রাইডাররা এইসঙ্গে রেইন কোট, হেলমেট ও ব্যাগ পেয়ে থাকেন, যার জন্য বরাদ্দ প্রায় তিন হাজার ৭০০ টাকা। নারীদের পোশাকে থাকে জর্জেট এবং সুতি শাড়ি দুইটি করে ও আনুষঙ্গিক ব্লাউজ, পেটিকোট, স্যান্ডেল/জুতা, মোজা, ছাতা, নামের ব্যাজ, শাল/সোয়েটার, ফুল হাতা ব্লাউজ ও হ্যান্ড গ্লাভস। বরাদ্দ প্রায় নয় হাজার টাকা।

কিন্তু বাংলাদেশে অতি অল্পসংখ্যক ১৭ থেকে ২০ গ্রেডভুক্ত কর্মচারী পাওয়া যাবে, যারা নিয়মিত পোশাক পরেন। এটি যেহেতু আচরণের অংশ অতএব, এটি পালনে ব্যর্থতার জন্য সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এ বর্ণিত অসদাচরণের অভিযোগে বিভাগীয় মামলার বিধান আছে; কিন্তু আজ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে নির্ধারিত পোশাক না পরায় কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে- এমন তথ্য চোখে পড়েনি।

পোশাক দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীকে, যাতে সহজে চেনা যায়। ফলে সেবা প্রার্থীরা বিড়ম্বনার হাত থেকে রেহাই পান। অন্যদিকে সরকারি চিঠি ও কাগজপত্র বহনকালে প্রাপক যথাযথ প্রতিনিধির কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি গ্রহণ করেছেন মর্মে নিশ্চিত হতে পারেন। পোশাক থাকলে যেহেতু সরকারি কর্মচারী চিহ্নিত হন অফিসে টাঊট-বাটপাররা সেবাপ্রার্থীদের বিভ্রান্ত করতে ব্যর্থ হয়। সাধারণের ট্যাক্সের অর্থে কেনা এই পোশাক সংশ্লিষ্ট কর্মচারী যদি নাই পরেন, তবে এই অর্থ অপচয় বন্ধ করাই হবে যুক্তিসঙ্গত। 

কেউ কেউ নাকি বলেন, এই পোশাক পরলে পরিচিত জন জেনে যাবেন যে তিনি ছোট চাকরি করেন। তাহলে সমাজ আর তাকে আগের মতো মূল্যায়ন করতে চাইবে না। তাই তারা এ পোশাক পরতে চান না।

মিথ্যাবাদিতা ও সামাজিক ভড়ংয়ের এই চক্র থেকে বের হয়ে আসারও প্রয়োজন আছে। যে চাকরির কারণে তিনি ও তার পরিবার খেয়ে-পরে বেঁচে-বর্তে আছেন- সেই চাকরির কথা প্রকাশে এই কুণ্ঠা নিতান্তই দুঃখজনক। আমরা সামাজিক কৃত্রিম স্তর ও বিভাজনের কথা বলে তার বিলোপের জন্য গলা ফাটাই; কিন্তু কিছু কৃত্রিম স্তর আমরা নিজেরাই কি সৃষ্টি করছি না? আমি নিজ যোগ্যতায় পাওয়া চাকরি স্বাধীনভাবে করি এবং প্রাপ্ত অর্থে সংসার চালাই- এর মধ্যে গৌরব বোধ না করতে পারলে এই লুকোচুরির অবসান হবে কি? আমাদের সমাজ খেটে খাওয়া মানুষকে মূল্যায়নে অত্যন্ত কঞ্জুস। অভিযোগ আছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা নগদ অর্থ তাদের দিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। কর্মচারীদের অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাদের অভিযোগ, টেন্ডারের মাধ্যমে সংগ্রহ করা পোশাক অত্যন্ত নিম্নমানের থাকে। এর বাস্তব সুরাহাও প্রয়োজন। 

সরকারি কর্মকর্তাদেরও ‘ড্রেস কোড’ রয়েছে; কিন্তু সেটি মানার ব্যাপারেও অনেকেই উদাসীন থাকেন। কর্মকর্তারা (ক) সাফারি স্যুট অর্ধ/পুরা হাতা (খ) ট্রাউজার ও বুশ শার্ট অর্ধ/পুরাহাতা (গ) লাউঞ্জ স্যুট বা কম্বিনেশন স্যুট (ঘ ) শেরওয়ানির সঙ্গে পায়জামা বা ট্রাউজার পরতে পারেন। তাদের মোজাসহ জুতা পরতে হবে। খেলা বা নকশা করা পোশাক পরে অফিস করা নিষিদ্ধ। ২০০৯ সালে জারী করা পরিপত্রে মার্চ-নভেম্বর সময়কালে সব পুরুষ কর্মকর্তাকে স্যুট-টাইয়ের পরিবর্তে অর্ধ/পুরাহাতা শার্ট, প্যান্ট পরে অফিসে আসার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে ওই নির্দেশনায় আনুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা স্যুট-টাই পরতে পারবেন মর্মে উল্লেখ করা হয়। সরকারি ঊর্ধ্ব পদে থাকা ব্যক্তিরাও এখন আর ‘ড্রেস কোড’ মানছেন না। যেমন টাইবিহীন কোট পরার ফ্যাশন এখন আমাদের মাথায় গেড়ে বসেছে। অফিসে হরদম এই বেশভুষা চলছে; কিন্তু এটি বিদ্যমান ড্রেস কোডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফতুয়া পরে অফিসে আসা বা পাঞ্জাবির ওপরে কোট পরে পোশাকের ফিউশন সৃষ্টি মনের মাধুরি মেশানোর প্রক্রিয়া হলেও ড্রেস কোড অনুযায়ী তা গ্রহণযোগ্য নয়। অফিসে এ ধরনের পোশাক পরিধান কাঙ্ক্ষিত নয়।

প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা অফিসে পায়জামা পাঞ্জাবি পরে আসতে চাইলে তাদের শেরওয়ানি পরতে হবে ড্রেস কোড অনুযায়ী; কিন্তু অনেকেই তা মানেন না। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তারা মোজাসহ জুতা পরে অফিসে আসবেন। সেটাও ভুলে গিয়ে অনেকে স্লিপার পরে অফিস করেন। কিংবা অফিসে এসে জুতা খুলে স্লিপার পরে অফিসের মধ্যে ঘোরাঘুরি করা ‘ড্রেস কোড’ সম্মত নয়। এসব বিষয় অশোভন শুধু নয়, অসদাচরণ ও বটে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে পোশাকের নির্দেশনা থাকলেও হরহামেশা অনেক সরকারি কর্মকর্তাই তা মান্য করছেন না। এমনকি বেসামরিক প্রশাসনের ইউনিফরমধারী কিছু কর্মকর্তা ইউনিফরম ছাড়াই রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন এমন অভিযোগও উঠেছে। এটি শৃঙ্খলাহীনতার নামান্তর। শুধু তাই নয়, নির্ধারিত অফিস সময়ের পরে দায়িত্ব পালনকালে অনেকেই টি-শার্ট বা ঘরোয়া পোশাক পরে মিডিয়ার সামনে মতামত/অভিমত ব্যক্ত করছেন। এতে প্রাতিষ্ঠানিক ইমেজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভারতে সি বি আই কিছুদিন আগে ড্রেস কোড কড়াকড়ি অনুসরণের পরিপত্র জারি করেছে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন পর্যায়ে ড্রেস কোড মানার বিষয়ে সরব নির্দেশনা জারির অবকাশ রয়েছে।

আমাদের দেশের সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিদ্যমান ড্রেস কোডটি ১৯৮৪ সনে জারি করা হয়। পরবর্তীতে এতে কয়েকবার সামান্য পরিবর্তন আনা হয়; কিন্তু সেই সময়ে সরকারি চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য ছিল না বিধায় তাদের জন্য ড্রেস কোড প্রণয়ন করা হয়নি। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে বিভিন্ন পর্যায়ে নারীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। 

অতএব, সময় এসেছে সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত নারীদের জন্য উপযুক্ত ড্রেস কোড প্রণয়নের। বর্তমানে নারীদের জন্য একমাত্র যে নির্দেশনা রয়েছে তা হলো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সময় নারীরা শাড়ি পরবেন। এর রঙ হবে দিনের বেলায় হালকা ও রাতের বেলায় গাঢ় রঙের। 

নারীদের পরিধেয় দাফতরিক পোশাকের ব্যাপারেও পরিপত্র জারি এখন আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউনিফরমধারী বাহিনীতে নারী সদস্যদের পোশাক অনেক আগে থেকেই কার্যকর এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বিধায় নারী সরকারি কর্মচারীর পোশাক নির্দেশনা প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।

ইংরেজিতে একটি কথা আছে ‘When you disregard statutory dress then you are functionally un dressed.’ অর্থাৎ তুমি যখন বিধিবদ্ধ পোশাক পরবে না তখন তুমি কার্যত বিবস্ত্র। দাফতরিক নির্ধারিত পোশাক পরে না আসা আর বিবস্ত্র হয়ে অফিসে আসায় নীতিগতভাবে পার্থক্য মিলে কি?

সরকারি দফতরের নিচু থেকে উঁচু সবার ক্ষেত্রেই এই কথাটি সত্য। যারা ফিঊশনের নিরীক্ষা চালান তাদের ক্ষেত্রেও। কারণ এখানে নিয়ম-মাফিক চলতে হয়, খেয়াল খুশিমতো নয়। শৃঙ্খলা গণপ্রশাসনের বড় শর্ত, এটি ভুলে গেলে চলবে না। অনিয়মকে বাড়তে না দিতে চাইলে যারা নিয়ম ভঙ্গ করেন তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প নেই।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //