অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু, তদন্ত কমিটি এবং আমাদের বোধোদয়

বাসা থেকে বের হই না বেশ কিছুদিন। ঘরবন্দি সময় ভালো কাটছে না মোটেই। চারদিকে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। চলছে লকডাউন। নিম্ন আয়ের মানুষরা ভালো নেই। ভালো নেই ব্যবসায়ীরা, বেসরকারি চাকরিজীবীদের কারো কারো বেতন কমছে, কেউ কাজ হারাচ্ছেন। অস্থির এক সময়। এই দুঃসময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার হওয়া একটি খবরে চোখ আটকে গেল। না, আগুন লাগা বা পুড়ে মারা যাওয়ার খবর আমাদের দেশে নতুন নয়। এদেশে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে এমন ঘটনা। আমাদের আর মনেই হয় না, একটি মানুষের মৃত্যু মানে শুধু তার চলে যাওয়া নয়; পাশাপাশি একটি পরিবারের সারা জীবনের হাহাকার রচনা হওয়া। অথচ স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাটের গুদাম পুড়েছিল বলে বঙ্গবন্ধু নিজে দৌলতপুরে গিয়ে পোড়া পাট ধরে কেঁদেছিলেন। কিন্তু এখন এতো যে মানুষ মারা যায়, কে রাখে তাদের খবর?

কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক খুললেই শুধু ধ্বংসস্তূপের ছবি আর স্বজনহারা মানুষের আহাজারি। ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও সংবাদকর্মীদের পরিশ্রম ও ব্যস্ততা উল্লেখ করার মতো। অন্যবারের মতো ইতোমধ্যে ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে সন্তান আর কোনোদিন বাবা বলে ডাকতে পারবে না, যে মা কোনোদিন আর তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন না, যে ভাই আর কোনোদিন তার ভাইকে পাবেন না, যে পিতা কোনোদিন সন্তানের সফলতায় অহংকার করতে পারবেন না, যে স্ত্রী আর ফিরে পাবেন না তার স্বামীকে; তার কিংবা তাদের সেই ক্ষতি কি কোনোদিন পূরণ করা সম্ভব? সম্ভব নয়। তবে এই ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেই ব্যবস্থা করা কিন্তু সম্ভব। আমরা একটু সচেতন হলেই এই ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলতে পারি। আমাদের সেই বোধের উদয় কবে হবে?

গত ৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার বিকেলটা হাসেম ফুড এন্ড বেভারেজের ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের জন্য অন্যরকম ছিল। সেদিন হবে তাদের অনেকের জীবনাবসান, তা কি তারা জানত? ভয়াবহ এই অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে। আগুন লেগে ৬তলা ভবনটি পুরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সেদিন। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, প্রথমে নিচতলায় আগুন লাগে। এরপরেই তা ছড়িয়ে পড়ে ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কীভাবে এই আগুন লাগল এই বিষয়টি নিয়ে এখনও মুখ খুলছে না কেউ। এ ঘটনায় গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি; যা বরাবরই হয়। কিন্তু কমিটি এখনো কোনো কিছু নিশ্চিত করতে পারেনি।

খবরের কাগজে এসেছে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকরা বলেছেন, কারখানার নিচতলায় থাকা প্যাকেজিং মেশিনের স্পার্ক থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। এরপর অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কাগজের মাধ্যমে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। উপরের ফ্লোরগুলোতে অতিরিক্ত মাত্রায় দাহ্য পদার্থ প্লাস্টিক ঘি জুসের প্যাকেটসহ অন্যান্য কাঁচামাল থাকায় আগুন বাতাসের সঙ্গে ছড়াতে থাকে। ফলে ফায়ার সার্ভিস শুরু থেকে চেষ্টা করলেও কিছুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

জানা যায়, কারখানার নিচতলায় ডানপাশে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে কমপক্ষে ১৫টি প্যাকেজিং মেশিন। আর ডানপাশে রয়েছে ফয়েল কাগজের গোডাউন। ওই গোডাউন থেকে কাগজ নিয়ে প্যাকেজিং এর মেশিনে কাজ করা হতো। ফলে নিচতলার পুরোটাই মেশিন আর ফয়েল কাগজের সংমিশ্রণে আগুন লাগার আদর্শ স্থান হয়ে উঠেছিল। ফলে কোনো একটি মেশিনের স্পার্ক থেকে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পরেই দ্রুত সময়ের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু আগুন ঊর্ধ্বমুখী, মুহূর্তের মধ্যে তা উপরের তলাগুলোতে ছড়াতে থাকে। নিচতলার বামপাশে লিফট ও জেনারেটর থাকলেও সেগুলোর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কিছুদিন আগেও রাজধানীর পুরান ঢাকার আরমানিটোলায় হাজী মুসা ম্যানশন নামে একটি ছয়তলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১৫টি ইউনিট কাজ করে। টানা তিন ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু এতেও প্রাণ যায় অনেকের।

আমার মনে আছে, ২০১৯ সালে ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা গিয়েছিলেন ৭৮ জন মানুষ। এ আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার কেমিক্যাল বিস্ফোরণ থেকে। আগুনের তীব্রতার কারণে গাড়ির সিলিন্ডারগুলো কয়েক মিনিট পর বিস্ফোরিত হয়। দোতলায় হাইলি ফ্লেমেবল (অত্যন্ত অগ্নিদাহ্য) পদার্থ ছিল। সেখানকার বিস্ফোরণেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। মুহূর্তেই আগুন কয়েকটি বাড়িতে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গাড়িগুলোর সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। এর আগে ওই ঘটনায় গঠিত কয়েকটি তদন্ত কমিটি বলেছে, দুটি গাড়ির সংঘর্ষের ফলে একটি গাড়ির সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত। খোদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সেই সময়ের মেয়র সাইদ খোকনও বলেছিলেন, আগুনের সূত্রপাত গাড়ির সিলিন্ডার থেকে। খুব খারাপ লাগে যখন দেখি, গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিতর্ক চলে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে! মন্ত্রী থেকে সাবেক মন্ত্রী, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা একেকজন একেক রকম কথা বলেন। কিন্তু তাতে কি আর স্বজন হারানো, সব হারানো মানুষগুলো ফিরে পান কিছু? 

আমরা কি ভুলে গেছি, কয়েক বছর আগের নিমতলীর সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা? হ্যাঁ, ভুলে গেছি! আমরা কি সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছি? না, নেইনি। আমরা এমনই সব খুব দ্রুত ভুলে যাই। আমরা এই ঘটনাও ভুলে যাব, যেমন আমরা প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পর কিছুদিন খুব সোচ্চার হই এবং তা ভুলেও যাই; যেমন নিরাপদ সড়কের দাবির কথা আমরা এখন প্রায় ভুলে গিয়েছি। কয়েক বছর আগে গাজীপুরের টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় ন্যাশনাল ফ্যান কারখানায় দুপুরে বিস্ফোরণে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছিল। এতে ঘটনাস্থলেই দুইজন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছিলেন। তখন জানা যায়, কারখানার শ্রমিকেরা কাজ করছিলেন। এমন সময় ভেতরে হিট চেম্বারে বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ধরে যায়। আর এতে ঘটনাস্থলেই দগ্ধ হয়ে দুই শ্রমিক নিহত হন। হতাশার কথা হলো, গাজীপুরের এ ঘটনার মতো এরকম শত শত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এসব ঘটনার পর প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এরপর প্রতিবেদন দেয় সেই কমিটি; তারপর সব থেমে যায়। কোনরূপ প্রতিক্রিয়া ছাড়াই অর্থাৎ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ছাড়া সবাই পার পেয়ে যায়। অতীতের সকল রেকর্ড কিন্তু এ কথাই প্রমাণ করে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন চলবে?

বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, গত এক বছরে সারাদেশে আঠারো হাজারেরও বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং এতে অর্ধশতেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর এসব অগ্নিকাণ্ডে দেশের ক্ষতি হয়েছে ৪৩০ কোটি টাকার মতো, যা উদ্বেগজনক। পত্রিকা পড়ে জানলাম, এসবের বেশিরভাগই ঘটেছে কেমিক্যালের মজুদ, গ্যাসের সিলিন্ডার, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, চুলার আগুন, ছুঁড়ে দেয়া জ্বলন্ত সিগারেট থেকে। আর কলকারখানায় অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এক হাজারের মতো, আর দোকানপাটে প্রায় দুই হাজার।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু হওয়ার পর গত দুই দশকে ৭০০ গার্মেন্টস শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের মনে আছে, কয়েক বছর আগে তাজরীন ফ্যাশনে লাগা আগুনে ১১১ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হন আরও অনেক শ্রমিক। বাঁচার আশায় ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে পঙ্গু হয়ে যান কেউ কেউ। এরপর কারখানায় নিরাপদ কর্ম-পরিবেশ এবং নিরাপত্তা নিয়ে দেশে-বিদেশে বিস্তর কথা-বার্তা হলেও থেমে নেই কারখানা দুর্ঘটনা।

আমাদের দেশে বহুবার অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় সবারই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এতবড় বড় প্রতিষ্ঠানে যেখানে হাজার হাজার কর্মী কর্মরত, সেখানে কেন পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে না? কেন থাকে না জরুরি বহির্গমন ব্যবস্থা? কোনো আইন নেই? আর কেমিক্যালের মজুদ কেনো আবাসিক ভবনে থাকবে? এখন আরও যেসব বাসায় এসব মৃত্যুকূপ আছে, তার কতটুকুইবা সরানো হবে! ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় কারখানা স্থাপনের অনুপযুক্ত বহুতল ভবনের বিভিন্ন তলায় গড়ে উঠেছে গার্মেন্টস, শিল্প-কারখানা, মার্কেট, কাঁচা-বাজার। এসব কারখানায় ছোট ছোট কক্ষে বসানো হয় ভারি যন্ত্রপাতি। আর অনেক কারখানায় আলাদা গুদাম না থাকায় ভবনের মধ্যেই বিভিন্ন তলায় মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। আর এসবের মধ্যে ঠাসাঠাসি করে দিনরাত কাজ  করে শিল্পশ্রমিকরা।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে থাকে না শ্রমিকদের ওঠানামার জন্য প্রশস্ত সিঁড়ি ও জরুরি বহির্গমনের আলাদা কোনো পথ। এমনকি অনেক গার্মেন্টস বা শিল্প-কারখানায় অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা থাকে না। আবার থাকলেও প্রয়োজনের সময়  কারখানা শ্রমিকদের অজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণের অভাবে তা ব্যবহৃত হয় না। এদেশে বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটকে দায়ী করা হয়ে থাকে। আসলে এদেশে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তার, ফিটিংস, ফিউজ, সার্কিট ব্রেকার সঠিক মানসম্পন্ন নয়। নিয়মিত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারেও রয়েছে শৈথিল্য। এসব কারণে দিন দিন বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি। মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি এসব অগ্নিকাণ্ডে অর্থনৈতিক ক্ষতিও কিন্তু কম নয়। আমরা একবারও ভাবি না, ক্রমাগত অগ্নিকাণ্ডের ফলে দেশের বিভিন্ন শিল্পখাতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। এখনো সময় আছে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেবার।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //