রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানায় আগুন

বিচার হলেও পরিস্থিতি বদলাবে কি?

কোনো একটি কারখানায় আগুন লেগে বহু মানুষের হতাহত হওয়ার পরদিনই দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা দায়ের এবং তারপরেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানসহ আটজনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে বিরল; কিন্তু প্রশ্ন হলো, আদৌ কি তাদের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ প্রমাণ করা যাবে? দ্বিতীয়ত, দেশের বিচারিক প্রক্রিয়া যে পরিমাণ ধীর, তাতে কত দিনে বিচার শেষ হবে এবং সেটি কার্যকর হতে কত সময় লাগবে? তৃতীয়ত, এর আগে নিমতলী, চকবাজারের চুড়িহাট্টা এবং রূপগঞ্জের অব্যবহিত আগে রাজধানীর মগবাজারের বিস্ফোরণে যে মানুষগুলো নিহত হলেন- সেসব ঘটনায় তো হত্যা মামলা হয়নি। তাহলে এর বিচার কী হবে? নিমতলীর ঘটনায় তো কোনো মামলাই হয়নি। বরং বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল। সেটিরও তদন্ত হয়নি। এত বড় একটি ঘটনা, যেখানে ১২৪ জন মানুষের প্রাণহানি হলো, সেই ঘটনায় কেন হত্যা মামলা হলো না- সেই প্রশ্নও তোলা দরকার। 

তবে এর সব প্রশ্ন ছাপিয়ে যেটি মূল কথা, তা হলো ধরা যাক- নিমতলী, চকবাজার, মগবাজার এবং রূপগঞ্জের আগুনের ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার হলো। তাতেও কি ওইসব ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন, তারা ফিরে আসবেন? যে সন্তান তার বাবাকে হারিয়েছে, সে কোনোদিন আর তাকে বাবা বলে ডাকতে পারবে? যে পিতা তার সন্তানের লাশ কাঁধে করে কবরস্থানে গেলেন, তার শোকের অশ্রু কেউ মুছতে পারবে? যে নারী তার স্বামীর পুড়ে যাওয়া লাশটিও শনাক্ত করতে পারেননি, তার মনের যন্ত্রণা কে নেভাবে? 

এসব ঘটনায় ধরা যাক গাফিলতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার দায়ে অনেক লোকের বিচার হলো। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং কারও কারও মৃত্যুদণ্ড হলো, তাতেও কি এই নিশ্চয়তা দেওয়া যাবে যে, ভবিষ্যতে আর কোনো কারখানায় গরিব শ্রমিকের শরীর পুড়ে কয়লা হবে না? আর কোনো আবাসিক ভবন কেমিক্যালের গোডাউনে পরিণত করা হবে না বা কেমিক্যালের গোডাউন আছে এমন কোনো ভবনকে বাসাবাড়ি হিসেবে ভাড়া দেওয়া হবে না? বিচার হলেও কি পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের গোডাউন পুরোপুরি সরিয়ে ফেলা গেছে? 

এসব তদারকির জন্য রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান দায়িত্বপ্রাপ্ত, তারা কি সবাই নিজের কাজটি ঠিকমতো করবে, না-কি ঘুষ খেয়ে কারখানার ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দেবে? রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবে তদন্ত রিপোর্টে মূল অপরাধীদের আড়াল করবে? যদি এই পৌনঃপুনিকতা চলতে থাকে, তাহলে দু-একটি ঘটনায় বিচার করেও সামগ্রিক সিস্টেম বদলানো যাবে না। বরং রূপগঞ্জের জুস কারখানার পরে আমাদের হয়তো অন্য কোনো কারখানায় এ রকম অগ্নিকাণ্ডের ব্রেকিং নিউজ দেখার জন্য টেলিভিশনের স্ক্রলে চোখ রাখতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত ৮ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেডের জুস কারখানায় আগুন লাগে। পরদিন পর্যন্ত এই আগুন জ্বলতে থাকে। এতে অর্ধ শতাধিক শ্রমিক পুড়ে মারা যান- যাদের মধ্যে অনেক শিশুও রয়েছেন। ৮ জুলাই বিকেলে যখন ছয় তলা কারখানায় আগুন লাগে, তখন সেখানে চার শ’র বেশি কর্মী কাজ করছিলেন। কারখানায় প্লাস্টিক, কাগজসহ মোড়কীকরণের প্রচুর সরঞ্জাম থাকায় আগুন মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সব ফ্লোরে। এমনকি কারখানায় প্রচুর কেমিক্যাল ছিল এবং এই ভবনে কেমিক্যাল গুদাম ব্যবহারের কোনো লাইসেন্স দেওয়া হয়নি বলেও জানিয়েছে বিস্ফোরক পরিদফতর। 

তারা বলছে, হাসেম ফুড কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করার কারণে অন্য সংস্থার লাইসেন্স নিতে পারে। তবে বিস্ফোরক পদার্থের গোডাউন করলে অবশ্যই লাইসেন্স নিয়ে করতে হবে। তারা অনুমতি ছাড়া বিস্ফোরক পদার্থ নিজেদের মতো করে গোডাউনে রাখলে আইন অনুযায়ী শাস্তি হবে। 

ফায়ার সার্ভিসও বলছে, ভবনটিতে প্লাস্টিক, পেট্রোসিনথেটিক কেমিক্যাল পদার্থ, রেজিন, বিভিন্ন জুসের ফ্লেভার, রোল, ফয়েল প্যাকেট ও কার্টনসহ বিভিন্ন মালামালে গুদাম ভর্তি ছিল। প্রচুর দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন ভয়াবহ রূপ নেয়। তাতে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়। শুধু তাই নয়, কারখানার সিঁড়ির দরজা তালাবদ্ধ থাকায় মৃতের সংখ্যা বেড়েছে। প্রশ্ন হলো, সিঁড়ির দরজা কেন তালাবদ্ধ ছিল?

তবে ঘটনার পরে যথারীতি এর দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন কারখানার মালিক। গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তিনি কোনো আগুন দেখেননি। তাছাড়া কারখানা মানেই সেখানে শ্রমিক থাকবে। শ্রমিক মানেই সেখানে কাজ হবে। আর কাজ হলে আগুন লাগতেই পারে- এই হচ্ছে তার সরল ব্যাখ্যা; কিন্তু কথাগুলো তিনি সহজে এবং সাবলীলভাবে বলেছেন বা বলতে পেরেছেন, বাস্তবতা তত সহজ নয়। তাকেই ব্যাখ্যা দিতে হবে, কেন এত বড় একটি কারখানা গড়ে তুললেও শ্রমিকের জীবন রক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সেখানে ছিল না? কেন ছাদের দরজা বন্ধ ছিল? কেন অনুমোদনহীনভাবে তিনি কেমিক্যালের বস্তা সেখানে স্তূপ করে রাখলেন? 

বস্তুত ভবনের ভেতরে দাহ্য পদার্থগুলো সঠিক জায়গায় রাখা জরুরি, যাতে কোথাও অগ্নিকাণ্ড হলে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে না পড়ে। এ জন্য কারখানা পরিদর্শন অধিদফতর ও স্থানীয় প্রশাসনকে নিয়মিতভাবে কারখানাগুলোর ভেতরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগের জায়গাগুলো তদারকি করা দরকার; কিন্তু এসব কথা দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত কেতাবেই থাকে। 

গণমাধ্যমের খবর বলছে, শিশুদের দিয়েই চলছিল হাশেম ফুড লিমিটেডের সেজান জুস কারখানাটি। তাদের অল্প বেতনে খাটানো হতো। এমনকি কয়েক মাসের বেতনও বকেয়া ছিল তাদের। সুতরাং যে মালিক কম পারিশ্রমিকে শিশুদের কাজে নিয়োজিত করেছেন, তাদের বেতন বকেয়া রেখেছেন, তিনি যে তাদের জীবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেবেন না- সেটিই স্বাভাবিক।

প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে প্রথমেই একটি তদন্ত কমিটি হয়। কখনো মামলাও হয়; কিন্তু অনেক সময়ই তদন্ত রিপোর্ট আলোর মুখ দেখে না। আবার তদন্ত রিপোর্টে এ জাতীয় ঘটনা প্রতিরোধে অনেক সুপারিশ থাকলেও, সেগুলো বাস্তবায়িত হয় না। কারণ সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেসব সিদ্ধান্তে আবার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নাগরিকদের একটি অংশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। ফলে প্রভাবশালীদের চাপে সেসব সুপারিশ ফাইলেই বন্দি থাকে।

মামলা হলেও বিচার শেষ হয় না। পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় বিস্ফোরণে ৮০ জন এবং তার আগে নিমতলীতে ১২৪ জনের প্রাণহানি হলেও, সেসব ঘটনায় বিচার শেষ হয়নি। চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলার তদন্তও এগোচ্ছে না। তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দফায় দফায় তারিখ দিয়ে যাচ্ছেন আদালত।

পুরান ঢাকায় একাধিকবার কেমিক্যালের গোডাউনে বিস্ফোরণে অনেক মানুষ নিহত হলেও, এসব ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যা মামলা করা হয়নি। ট্র্যাজেডি হলো, দেশে বাস দুর্ঘটনার পরে জানা যায় বাসের ফিটনেস ছিল না বা চালকের লাইসেন্স ছিল না অথবা হেলপার গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। লঞ্চ ডোবার পরে জানা যায়, লঞ্চের রুট পারমিট বা অনুমোদন নেই। ভবনে আগুন লাগার পরে জানা যায় সেটি নকশা মেনে তৈরি হয়নি বা সেখানে অগ্নি নির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। কারখানায় আগুন লাগার পরে জানা যায়, সেখানে কেমিক্যাল রাখার অনুমোদন ছিল না। প্রশ্ন হলো, যাদের এসব ফিটনেস দেখার কথা, নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন করার কথা, তারা সারাবছর কী করেন? প্রশ্ন করলেই তাদের গৎবাঁধা উত্তর, জনবল সংকট। কথা হচ্ছে, সেই অল্প জনবল নিয়েই তারা কী করেন? তারা কি কারখানায় শ্রমিকের জীবন রক্ষার সরঞ্জাম ঠিকঠাক আছে কি-না সেটি পরীক্ষা করেন, না-কি কারখানা পরিদর্শন মানেই মোটা অংকের টাকার খাম এবং নিয়মিত মাসোহারা গ্রহণ- সেটিও দেশের মানুষ জানে। সুতরাং, জনবল সংকট যেমন একটি বড় সমস্যা, তার চেয়ে বড় সমস্যা সরকারি প্রতিষ্ঠানের লাগামহীন দুর্নীতি ও জবাবদিহি না থাকা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনমুখী এবং সরকারি কর্মচারীদের সত্যিকার অর্থে জনগণের সেবকে পরিণত করা না গেলে একটির পর আরেকটি ঘটনার জন্য আমাদের শুধু অপেক্ষাই করতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //