অনন্য তাজউদ্দীন আহমদ

‘১৯৭১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি একদিন খুব সকালে আমি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে এসেছি। আমার অফিস ঘরে ঢুকব। এমন সময় নিরাপত্তা অফিসার বি এন বোস ডাকলেন, স্যার চা খাবেন? ওর সঙ্গে পেছনের ঘরে বসে চা খেতে খেতে দেখি, ওর বিছানায় খুব সুন্দর একটা কম্বল রাখা। আমি তাকে বললাম, এই কম্বলটা খুব সুন্দর। এটা কি আপনার? উনি বললেন, এটা আমি গতকালই বাজার থেকে কিনে এনেছি। বললাম, আপনি আমাকে এটা দেন, আমি টাকা দিচ্ছি, আপনি অরেকটা কিনে নিয়েন। বোস বললেন, স্যার, এটা আমি গত রাতে গায়ে দিয়েছি। তার চাইতে বরং আমি একটা নতুন কম্বল কিনে দেবো। বললাম, ঠিক আছে, যখন কিনতে যাবেন আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েন।

এরপর আমি অফিস রুমে ঢুকে তাজউদ্দীন আহমদের রুমের দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি প্রধানমন্ত্রী একটা গেঞ্জি গায়ে, পরনে লুঙ্গি, আর শরীরের ওপরে পাতলা গামছা বিছানো। এই অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লাগল। একটু পরেই প্রধানমন্ত্রী অফিস ঘরে ঢুকে কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ফারুক সাহেব, রাতে বেশ শীত পড়ে। নভেম্বর মাস তো, শীত এসে গেল।

তিনি শুধু এ বিষয়ে এটুকুই বললেন। আমার ওবেলার কাজ শেষ হলে চলে গেলাম বি এন বোসের কাছে। বোসকে টাকা দিয়ে বললাম, আজই একটা কম্বল কিনে আনেন। আর সেটা এনে প্রধানমন্ত্রীকে দেবেন। তাকে বলবেন কম্বলটা আপনি দিয়েছেন অথবা বিএসএফ থেকে দিয়েছে।

পরদিন সকালে যথারীতি কাজে বসতেই তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ফারুক সাহেব, দেখুন তো শীতের কথা ভেবে, কত সুন্দর একটা কম্বল পাঠিয়েছেন গোলক মজুমদার (১৯৭১ সালে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আইজি)। শিশুর মতো হেসে বললেন, ভালোই হলো, শীতে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমি বুঝলাম বোস আমার চাইতেও কয়েক কাঠি বাড়িয়ে বলেছে। মনে মনে আমার খুব ভালো লাগল; কিন্তু এই কথাটি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বলার সুযোগ আমার আর কখনো হয়নি।’

এই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ফারুক আজিজ খান তার এক অগ্রন্থিত সাক্ষাৎকারে। ফারুক আজিজ খান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন।

দুই.
‘লন্ডনে আমাদের সঙ্গে একটা গ্রুপের পরিচয় হলো। তারা ভিয়েতনামের পক্ষে ভাড়াটে যোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এরকম গ্রুপ আছে, যারা চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও খুবই সাহসী ও দক্ষ হয়। নির্ভুল নিশানায় অব্যর্থ আঘাত হানতে পারে তারা। ভিয়েতনামের পক্ষে যুদ্ধ করা গ্রুপটির সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলতে থাকল।

এদের দু’জন ইংরেজ এবং একজন অস্ট্রেলিয়ান। আমাদের পক্ষ হয়ে নাশকতামূলক তৎপরতা চালাবেন তারা। তাদেরকে বললাম, পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দরে বা অন্য কোনো জাহাজে যদি বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো যায়, তাহলে একটা বড় কাজ হয়।

এই তিনজন একদিন আমার বাসায় এলেন। আমি এবং ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম। তারা বললেন, ‘আমরা গুজরাট উপকূল থেকে মাছধরা ট্রলার নিয়ে করাচি সমুদ্রবন্দরে যাব। সেখানে জাহাজে বোমা পেতে বিস্ফোরণ ঘটাব। এ জন্য আমাদের অর্থ দিতে হবে।’

এ কাজটি সম্পন্ন করতে তাদের সঙ্গে ১৬ হাজার ৮০০ পাউন্ডে রফা হলো।

কিন্তু এই কাজে এত টাকা খরচ করব কিনা, তা নিয়েও ভাবতে থাকলাম। সন্দেহ নেই এরকম একটি নাশকতামূলক কাজ করতে পারলে সেটা বেশ চাঞ্চল্যকর ব্যাপার হবে। বিশ্ব প্রচার মাধ্যমে উঠে আসবে বাংলাদেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি ও সাহসিকতার প্রমাণ হবে; কিন্তু এ ধরনের একটি ব্যয়বহুল কাজ করব কিনা, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।

সেপ্টেম্বর মাসে আমি এবং ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী কলকাতা গেলাম। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। কলকাতার থিয়েটার রোডে তার অফিসে গেলাম। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমরা তাঁর কক্ষে ঢুকলাম। তিনি একটি চেয়ারে বসে আছেন। পরনে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি। তাঁকে আমাদের পরিকল্পনার কথা অবহিত করলাম। বললাম, এর জন্য প্রয়োজনীয় ১৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড সংগ্রহ করেছি। শত্রু ঘাঁটিতে নাশকতামূলক এই কাজটি করে আমরা বিশ্বকে চমকে দিতে চাই।

মুজিবনগর সরকারের পক্ষে প্রায় সব কাজই তখন করছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন বা তাঁর অন্য কোনো পরামর্শ বা পরিকল্পনা আছে কি-না, তা আমরা জানতে চাইছিলাম। এত বড় একটি কাজ প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে না জানিয়ে আমরা করতে চাইনি। আর এই কাজটি যে মুক্তিযোদ্ধারা করছে সেটা জানিয়ে রাখাও একটি উদ্দেশ্য ছিল।

আমাদের সব কথা শুনে তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, দেখুন, এ ধরনের অভিযান সফল হতে পারে আবার নাও হতে পারে। তাই এই কাজে এত টাকা ব্যয় করা ঠিক হবে না। আমরা খুবই আর্থিক সংকটের মধ্যে আছি। একেবারেই চলতে পারছি না। ভারত সরকারের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল আমরা। তারা আমাদের অনেক কিছু দিচ্ছেন, আবার অনেক কিছুই দিচ্ছেন না। আপনাদের সংগৃহীত অর্থটা পেলে আমাদের যুদ্ধ আমরা নিজেরাই করতে পারব। ভাড়াটে লোকের প্রয়োজন হবে না।

তাজউদ্দীন আহমদকে সেদিন একজন নিরহঙ্কার, অমায়িক এবং আদর্শবান রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মনে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তিনি আমাদের সবার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।’

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদ তাঁর এই অনন্য অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন গোলাম মোর্তোজা সংকলিত ‘ফজলে হাসান আবেদ ও ব্র্যাক’ বইয়ে।

তিন.
ওপরের দুটি বর্ণনা যে মানুষটিকে নিয়ে, সেই তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫) জন্মেছিলেন এখনকার গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। পবিত্র কোরআনে হাফেজ ছিলেন। পড়েছেন গ্রামের মক্তবে, নিজ বাড়ি থেকে দূরে ভুলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলে, কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি স্কুলে। পরে গেছেন কালীগঞ্জের মিশনারি স্কুল সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে। সেখান থেকে ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুল ঘুরে গেছেন সে সময়ের বিখ্যাত মিশনারি বিদ্যাপীঠ সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে। এখান থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছেন ম্যাট্রিকুলেশন। তৎকালীন কলকাতা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ১৯৪৪ সালে সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে ১২তম স্থান অধিকার করে ম্যাট্রিকুলেশন ডিগ্রি নেন।

তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের প্রাদেশিক রাজনীতিতে যুক্ত হন স্কুলে থাকা অবস্থাতেই। ১৯৪৩ সালেই ঢাকার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের অফিস ও সংগঠন গড়ার কাজে ব্যাপৃত হন। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার কারণেই নিয়মিত ছাত্র হিসেবে যথাসময়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৪৮ সালে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন। ইন্টারমিডিয়েটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বোর্ডে মেধা তালিকায় ৪র্থ স্থান লাভ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে এমএলএ নির্বাচিত হন। ক্রমান্বয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পূর্ণ করে বঙ্গবন্ধুর অন্যতম রাজনৈতিক সহকর্মী হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলনের বছরেই দলের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য হন। ১৯৭১ সালে প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অসামান্য দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে স্বাধীন দেশে প্রথম অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর মন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে তিনি গ্রেফতার হন। এবং ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

চার.
তাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতিতে ছিলেন চিন্তাশীল, প্রগতিবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক। তার অর্থনৈতিক ভাবনা ছিল সাম্যবাদী ঘরাণার। অধিকসংখ্যক মানুষের কল্যাণ আকাক্সক্ষী রাষ্ট্র বিনির্মাণ ছিল তার প্রতীতি। তিনি প্রচলিত দল, গোষ্ঠী বা রাজনীতিকে যতটা প্রাধান্য দিতেন, তার চাইতে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন ‘রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র হয়ে উঠবার পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার’ ওপর। সেটাই ছিল তার রাজনীতি। আমাদের প্রচলিত রাজনীতিতে যে যুক্তিহীন রাষ্ট্রাচারবিরোধী ভক্তিবাদ প্রবল, তিনি ছিলেন সেটার সম্পূর্ণ বিপরীত প্রবণতার মানুষ। যেটাকে ন্যায্য ও জনকল্যাণের বলে ভাবতেন সেটাকেও নিয়ম ও নীতির মধ্যে ফেলে কাজ করতে চাইতেন। আমাদের প্রচলিত রাজনীতির সঙ্গে তা ছিল বেমানান।

ক্ষুদ্র দল বা গোষ্ঠীপ্রীতির চাইতে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দেশের অধিকসংখ্যক মানুষের টেকসই কল্যাণভাবনা। ভাবাবেগের চাইতে যুক্তিপ্রবণ চিন্তার প্রাধান্য ছিল তার কাছে বিবেচ্য। ব্যক্তিজীবনের সততাকে তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেন তার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রতিটি পদক্ষেপে। ফলে, আমাদের আবেগঘন তুষ্টিবাদের রাজনীতিতে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন না বটে; কিন্তু রাষ্ট্র বিনির্মাণকাজে তার প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার পক্ষে নীতিগত অবস্থানের কারণেই দেশের ভেতর ও বাইরের বহু প্রভাবশালী মহলের বিরাগভাজন হয়েছিলেন; কিন্তু মাথা নত করেননি আমৃত্যু। সে কারণেই স্বাধীন দেশে যেমন খুব আদৃত হননি তেমনি তার খুনের পর ক্ষণকালিন ইতিহাসের হাতেও অনাদৃতই থেকেছেন। প্রচলিত ইতিহাসের আলো তাকে অবহেলা করেছে বটে; কিন্তু চিন্তাশীল মানুষের রাষ্ট্রভাবনায় তিনি অনন্য হয়ে আছেন। অনন্য হয়ে থাকবেন ভবিষ্যতেও।

-সিনিয়র সাংবাদিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //