তাজউদ্দিন আহমদ : শীতলক্ষ্যা পাড়ের রাজনৈতিক কবি

তাজউদ্দিন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই কাপাসিয়ার শীতলক্ষ্যা পাড়ের দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৌলানা ইয়াসিন খান ও মা মেহেরুন্নেসা খানমের এই সন্তান পরে ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। 

যে সময় তাজউদ্দিন আহমদ জন্মগ্রহণ করেন  তখন দরদরিয়ার আশে-পাশে শালবনে ঘেরা ঘন জঙ্গল ছিল। মা সাহসিনী মেহেরুন্নেসা বাঘ তাড়িয়েছিলেন বলে শ্রুতি আছে। বলা হয়ে থাকে, তাজউদ্দিন আহমদের মনন গঠনে মা মেহেরুন্নেসার প্রভাব সুগভীর। শিশু তাজউদ্দিন আহমদ মূলধারার শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষায়ও সক্ষমতার সাক্ষর রেখেছিলেন। তিনি কোরআনে হাফেজ ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি দু’টি মিশনারী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। 

শিশু তাজউদ্দিনের সাথে পরিচয় হয়েছিল কাপাসিয়া থানায় বন্দী তিন বিপ্লবীর। এই বিপ্লবীরা তাজউদ্দিনের সাথে পরিচয়ের সূত্রে তার মধ্যে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা দেখতে পান। তারা তার সাথে ঘনিষ্ঠ হোন, তার সঙ্গে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। আলোচনার বিষয় খুবই অনুমেয়, তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। চলছে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার সংগ্রাম, পাশাপাশি এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার লড়াই যেখানে একটি ন্যায্য ও শোষনহীন সমাজ গড়ে উঠবে। ধারণা করা হয়, তারা তাকে বিশেষ বিশেষ বই পড়তে উৎসাহিত করতেন। যাতে তাজউদ্দিন আহমদের মধ্যে দেশপ্রেমের ধারণা পোক্ত হয়। এভাবেই তাজউদ্দিন হয়ে উঠেন একজন মুক্ত মনের মানুষ এবং মাতৃভূমির প্রতি কর্তব্যপরায়ন এক নাগরিক। 

কিশোর তাজউদ্দিন আহমদ সহপাঠীদের সঙ্গী করে গড়ে তুলেন ‘ধর্মগোলা’। যেখানে দুঃসময়ের জন্য শস্য মজুদ করা হতো এবং তা গরীব মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হতো। 

সংস্কার এড়িয়ে কিশোর তাজউদ্দিন আহমদ মায়ের হাতে রান্না করা খাবার বসন্ত রোগে আক্রান্ত রোগীর বাড়ীতে পৌঁছে দিতেন। আজও করোনাকালে টিকার প্রতি মানুষের যে নানান ভুল ধারণা, সেই কালে টিকার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে কুসংস্কার আরো ব্যাপক ছিল। তিনি যারা টিকার ব্যাপারে ভুল ধারনাকে উস্কে দিত, তাদের খুঁজে বের করে যথাযথ শিক্ষা দিতেন। যা মানুষের মধ্যে টিকার প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে সহায়ক হয়েছিল। 

বয়েজ স্কাউট তাজউদ্দিন আহমদ রাত জেগে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেন। অসহায়, অসুস্থ ও আহতদের তিনি নিজে রক্ত দেয়া ছাড়াও রক্ত যোগাড়ে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি যখন ঢাকার একটি বিদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকতেন তখন তার খেলাধুলার প্রতি অনুরাগ চোখে পড়ে। তিনি সেসময় সিনেমা দেখার প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠেন। ইংরেজি সিনেমার প্রতি ছিল তার ভালবাসা। হোস্টেল সুপার তা জানতেন, তারপরও তিনি তা অনুমোদন করতেন এই কারণে যে, এতে তিনি কোনো সমস্যা দেখেননি।  এটা তাজউদ্দিন আহমদের পড়ালেখায় কোনো প্রভাব ফেলেনি। 

এসময় তিনি মাঝে মাঝে রাজনৈতিক সমাবেশেও যোগদান করেন, নেতাদের বক্তব্য শোনার জন্য। অসাধারণ এক রাজনৈতিক পটপরির্তনের সময় তিনি বড় হচ্ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ ও তাকে ঘিরে দেশভাগের ষড়যন্ত্র যুবক তাজউদ্দিন আহমদকে প্রভাবিত করেছে। অসাধারন সুন্দর হস্তাক্ষরে ইংরেজিতে দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাবলী নির্মোহভাবে ডায়েরিতে লিখে রাখতেন।

তিনি একজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ভূমিকা পালন করতে থাকেন। তিনি মুসলিম লীগের আবুল হাসিম ও কামরুদ্দীন আহমদের  গ্রুপের সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এদের সাথে কমিউনিস্টদের ভাল যোগাযোগ ছিল। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তানে পরিণত হলেও শুরু থেকেই পাকিস্তান তার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। সোজা কথায় বাঙালি মুসলমানরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত হলেও পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়। তার প্রথম পদক্ষেপ হলো বাংলা ভাষার উপর আঘাত। শাসকগোষ্ঠী বিশেষ করে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার এক সমাবেশে ঘোষনা করেন ‘উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পরে। তারা ‘না’, ‘না’ প্রতিধ্বনিতে তা প্রত্যাখ্যান করে। তাজউদ্দিন আহমদ ছাত্র সমাজের এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অন্যতম সংগঠক হিসেবে কাজ করেন। ভাষা আন্দোলনকে একটি সফল আন্দোলনে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ ব্যাপারে তার লেখা ডায়েরি ১৯৫২ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। পরবর্তীকালে ইতিহাসবিদ বদরুদ্দিন উমরের বইয়ে তার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।

তাজউদ্দিন আহমদ ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা ও আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগে পরিণত করে সংগঠনটিকে একটি অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ধারার লোকদের কাছে নিয়ে যেতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে সংগঠনটি গণ সংগঠনে  এবং সকল সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য সংগঠনে পরিণত হয়।  একদিকে তিনি ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের কর্মী হওয়া সত্বেও পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তান বাঙালির আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে পারবে না। মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা পেলে তিনি শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন, শেখ মুজিবর রহমান নির্বাচিত হোন সভাপতি। মুজিব-তাজউদ্দিনের নেতৃত্বেই এগিয়ে যেতে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। এসময় আওয়ামী লীগ জনগণের সামনে ৬ দফা দাবি তুলে ধরে, পরে তা স্বাধীকার ও সবশেষে এক দফা অর্থাৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে ধাবিত হয়। সত্তরের সাধারণ নির্বাচন ও মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে তিনি অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দেন। তবে প্রচারবিমুখ এই প্রজ্ঞাবান নেতা লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। 

ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টোর ত্রিমুখী আলোচনা ব্যর্থ হলে ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় গোপনে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। তার আগে এই রক্তপিপাসু তার সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে যান। চলে অপারেশন সার্চলাইট ও গণহত্যা। শেখ মুজিব গ্রেফতার হন। কর্তব্যবোধ ও পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি সহকর্মী তরুণ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে সঙ্গী করে অজানার উদ্দেশে পাড়ি দেন। উপস্থিত হোন ভারতীয় সীমান্তে, জানতে পেরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাদেরকে ভারতে স্বাগত জানান। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তিনি তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাত করেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা চান। ১০ এপ্রিল তিনি জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। জাতি উদ্দীপ্ত হয়। জানতে পারে, শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, উনার অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে। মেহেরপুরের নতুন নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। এই নাম তাজউদ্দিন আহমদ কর্তৃক প্রদত্ত। 

নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে যুদ্ধ এগিয়ে চলে, ঘরে-বাইরের শত্রুকে মোকাবেলা করে তিনি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। একটি মাত্র পোষাক দিনে পরে রাতে ধুয়ে তা শুকাতে দিতেন। দুর্যোগপূর্ণ রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের কষ্টের কথা মনে করে সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতেন। মোশতাকের ‘মুজিবকে চাও নাকি স্বাধীনতা চাও’ এই প্রোপাগান্ডাকে উড়িয়ে দিয়ে আত্নবিশ্বাসী তাজউদ্দিন আহমদ বলতেন, আমরা দু’টোই চাই- ‘স্বাধীনতা ও মুজিব’ এবং বাস্তবে তা করে দেখিয়েছিলেন। 

যুদ্ধের সময় অনেকেই জৌলুষপূর্ণ জীবন-যাপন করলেও তিনি অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। এমনকি তিনি পারিবারিক জীবনযাপনও করতেন না। তিনি তার কার্যালয়ের পাশেই একটি কক্ষে রাত্রিবাস করতেন। অপ্রয়োজনে অর্থ খরচেও তার আপত্তি ছিল, ফলে অনেকের কাছেই তিনি বিরাগভাজন ছিলেন। তিনি যুদ্ধটাকে নিজেদের যুদ্ধ বলে মনে করতেন, বিদেশি শক্তি আমাদের দেশ স্বাধীন করে দিক এটা তিনি চাইতেন না। আত্নমর্যাদার ব্যাপারে তাজউদ্দিন সম্পর্কে ভারতীয় এক কূটনীতিক উচ্চ ধারণা পোষণ করে মন্তব্য করেন। 

৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করলে তিনি সাংবাদিকদের সামনে বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমি তো শুধু ধাইয়ের দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান বাহিনী আত্নসমর্পন করে, পৃথিবীর বুকে স্থায়ীভাবে অঙ্কিত হয়ে যায় একটি নতুন মানচিত্র যার নাম বাংলাদেশ। ২২ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার বিশেষ বিমানে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে। গুরুত্বের দিক দিয়ে এটা অসামান্য ঘটনা হলেও আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনো তা পালন করি না। 

এবার তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে পাকিস্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য। সরকারের অসাধারণ কূটনৈতিক দক্ষতার কারণে বৈশ্বিক জনমতের কাছে পাকিস্তান হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভুট্টো সেই ছোট-খাটো সাদা শার্ট পরিহিত বঙ্গবন্ধুর সার্বক্ষণিক (শারীরিক ও মানসিক) সঙ্গী লিটল নটোরিয়াস ম্যান তাজউদ্দিনের কাছে আবারো পরাজয় স্বীকার করেন। তারা জাতির জনককে মুক্তি প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু লন্ডন-দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফেরেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। মাত্র ৪৮ ঘন্টার ব্যবধানে ১২ জানুয়ারি সংবিধান সমুন্নত রেখে সংসদীয় গণতন্ত্রের লক্ষ্যে নেতা শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইতিহাসে এ ঘটনা বিরল। এ ঘটনার এক ভিডিও চিত্রে সন্তুষ্টচিত্তের এক তাজউদ্দিন আহমদকে দেখা যায়, যেন যার অধিকার তাকে তা ফিরিয়ে দিতে পেরে তিনি কত নিশ্চিন্ত। পরের ঘটনাবলী সবার কমবেশি জানা। 

শীতলক্ষ্যা পাড়ের এই রাজনৈতিক মহাকবি কিভাবে এ পর্যায়ে উঠে এলেন তা অনেক গবেষণার বিষয়। তবে তার মনন গঠনে শান্ত, সৌম শীতলক্ষ্যার প্রভাব যে সুগভীর সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক থাকতে পারে না। শুধু এই কারণেই শীতলক্ষ্যা অনেক মহীয়ান। শীতলক্ষ্যা পাড়ের দুইপারের বাসিন্দারা একটু বেশি গর্ব তো করতেই পারেন এই রাজনৈতিক মহাকবির জন্ম ও বেড়ে উঠা নিয়ে। তাজউদ্দিন আহমদের প্রতি যেমন আমাদের উদাসীনতা তেমনই দখল ও দূষণে শীতলক্ষ্যাও আজ ক্লান্ত। কারো যেন ভ্রুক্ষেপ নেই। কোথায় যেন একটি অন্তঃমিল  খুজে পাওয়া যায়। হায়রে আত্নঘাতী বাঙালি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //