পরিবর্তনশীল বিশ্ব রাজনীতি ও বাংলাদেশ

স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উৎসব অতিক্রমের দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিশ্ব রাজনীতি-কূটনীতির সঙ্গে এখনকার পরিবর্তন বিবেচনায় নিলে বিস্ময়াভূত হতে হয়। সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব, পূজিবাদী বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব এখন নেই। বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের মানচিত্র পাল্টে গেছে। 

প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঠান্ডাযুদ্ধ যুগে বিভিন্ন দেশ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়তো আমেরিকার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক ছত্রছায়ায় যেতে বাধ্য হতো। উন্নয়নের পথ সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ এ নিয়ে ছিল বিতর্ক। সোভিয়েত ইউনিয়ন শান্তি-স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্রের স্লোগান তুলে তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোকে আকর্ষণ করত। উল্টোদিকে আমেরিকা গণতান্ত্রিক বিশ^, মুক্তবিশ^ প্রভৃতি স্লোগান সামনে আনতো। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর মনে করা হতো আমেরিকার নেতৃত্বে এককেন্দ্রিক বিশ্ব পৃথিবী শাসন করবে। কিন্তু তাও এখন উবে যচ্ছে। আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি উপেক্ষা করে আণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান, এশিয়ায় উত্তর কোরিয়া এখন আণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি পাকিস্তানের আণবিক বোমা থাকত তবে পরিণতি কী হতো কে জানে! কয়েক দিন আগে জানলাম, ২০১৫ সালের চুক্তি ও পরে অবরোধের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধর রাষ্ট্র ইরান ইউরেনিয়াম ধাতব বা সিলিকন ফুয়েল প্লেট তৈরি করেছে এবং বোমার কাছাকাছি এসে গেছে সেই দেশ।

প্রকৃত বিচারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া শিশু রাষ্ট্রগুলো সবাই এখন সাবালকত্ব পেয়ে সামরিক শক্তি সঞ্চয়ে উদগ্রীব হয়ে আছে। কোনো রাষ্ট্রই পদানত থাকতে চাইছে না। অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম দেশগুলো আণবিক শক্তিধর হয়ে পাশ্ববর্তী দেশগুলোকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইবে তা অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা চলে। তাই আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন, চুক্তি-সমঝোতা, বন্ধু-শত্রু সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে বা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটেছে চীনের শক্তি ও অবস্থানে। চীন এখন মহাপরাক্রমশালী হয়ে ওঠে সবদিক থেকে আমেরিকাকে পাল্লা দিতে উদ্যত। 

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, ঠান্ডাযুদ্ধ যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থ সামর্থ্য কিন্তু এখনকার চীনের মতো শক্ত ছিল না। তারা সামনে রাখতো রাজনৈতিক তত্ত্ব-মত। জনমতই শক্তি বলে সেই দেশ সমাজতন্ত্রই মুক্তির পথ তত্ত্ব সামনে আনতো। চীন এখন তত্ত্ব-মতের আপ্তবাক্যের মধ্যে নেই। টাকা ও পণ্য হচ্ছে তার কূটনীতির বাহন। রফতানি বাণিজ্য ও বিনিয়োগে কেবল তৃতীয় বিশে^র দেশ নয়, ইউরোপে তার প্রভাব ক্রমাগত বাড়াচ্ছে। বিগত ১৭ ফেব্রুয়ারি বিবিসির নিউজ থেকে জানা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হিসাবে আমেরিকাকে টপকে গেছে চীন। 

লেখাট যখন লিখছি, তখন নিকট এক বন্ধু টাইমস অব ইন্ডিয়ার ২০ জুলাই ২০২১ প্রকাশিত একটি ভিডিও নিউজ লিংক পাঠায়। হেডিং হচ্ছে : ‘চায়না থ্রেটেনস টু নিউক জাপান ওভার পসিবল তাইওয়ান থ্রেট।’ সেই সংবাদ থেকে জানা যায়, চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি তাইওয়ান ইস্যুতে জাপানের বিরুদ্ধে একটি ভিডিও প্রচার করেছে, যাতে বলা হয়েছে ‘আমরা প্রথমে আণবিক বোমা ব্যবহার করবো, ধারাবাহিকভাবে করতেই থাকবো। যতক্ষণ না জাপান নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করে বলবে দ্বিতীয়বার তারা নাক গলাবে না।’ ২০ লাখ মানুষ এই ভিডিও বার্তা দেখে এবং পরে তা নাকি মুছে ফেলা হয়েছে। আপলোড হয়ে যাওয়ায় তা প্রচারে এসেছে। 

এদিকে পিকিংয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের বক্তব্যের জবাবে ২৬ জুলাই চীনের দৈনিক গ্লোবাল টাইমসে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী নতুন হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে শিখতে হবে অপরের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র্্র এখনো তা না শিখে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক সঙ্গীদের নিয়ে আমরা সেটা শিখিয়ে দেবো। বিশে^র কোনো দেশের ওপর এখন আর অন্য কোনো দেশের শ্রেষ্ঠত্ব নেই এবং চীন কখনো তার সঙ্গে অন্য কানো দেশকে সেরকম আচরণ করার অনুমতি দেবে না। 

সামরিক এই উত্তেজনার মধ্যে চলছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পাল্টাপাল্টি। এক্ষেত্রে বিগত জুন মাসে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত জি সেভেন বৈঠকের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। ওই বৈঠকে বিশ^ব্যাপী অবকাঠামো নির্মাণ, জলবায়ু পরিবর্তন প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে ‘বিল্ড বেটার ওয়ার্ল্ড’ স্লোগান সামনে আনা হয়। চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনায় অবকাঠামো উন্নয়নে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনার বিপরীতে এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। চীনা ঋণের বোঝা বা জালে আটকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা সামনে এনে বলা হয়, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য জি সেভেন মূল্যবোধ দ্বারা চালিত, উচ্চমানের এবং স্বচ্ছ অংশীদারিত্বের প্রস্তাব দেবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন আহ্বান জানান, ‘পশ্চিমা মূল্যবোধের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে হবে।’ 

 স্বভাবতই বৈঠকে প্রশ্ন ওঠে, বেটার ওয়ার্ল্ড গড়ার অর্থ আসবে কোথা থেকে। জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থ ছাড় দেওয়ার মতো অবস্থায় আসেনি। লক্ষ্যণীয় হলো, বিশেষভাবে জার্মানি ও ইতালির সঙ্গে চীনের বাণিজ্যের এখন বাড়বাড়ন্ত। মজার ব্যাপার, প্রেসিডেন্ট বাইডেন করোনাভাইরাস মহামারি-পরবর্তী বিশ^কে গণতন্ত্র ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য আহ্বান জানান। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের কথা বলছে আমেরিকা! কীভাবে যে পাল্টে গেল দান! আইয়ুব-ইয়াহিয়াকে হয়তো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এখন মনে করতে পারছেন না। এদিকে বৈঠক শেষ হতে না হতেই চীন জি সেভেন নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, চীনকে হুমকি হিসাবে দেখা বন্ধ করা উচিত। কিছু দেশ বা একটি গোষ্ঠী সারাবিশ^ নিয়ন্ত্রণ করবে সেই দিন শেষ।

দিন কার কবে শেষ হবে, কার কখন উত্থান ও পতন হবে, তা কে বলতে পারে! আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ কি ভাবতো সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হবে! চীন-আমেরিকার মিতালি ভেঙে গিয়ে একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়াবে! যুক্তরাষ্ট-ভারত নৈকট্য সৃষ্টি হবে। সময়ই সবকিছুর নিয়ন্ত্রক। স্মরণ করা যেতে পারে, মুক্তিযুদ্ধের সময়েই পাকিস্তানকে রক্ষা করা এবং এশিয়াতে রাশিয়া ও ভারতের বিরুদ্ধে চীনকে ব্যবহারের অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে উপমহাদেশে আমেরিকা-চীন-পাকিস্তান অক্ষশক্তি গড়ে উঠেছিল। 

 একদিকে ৩০ লাখ বাঙালির রক্ত ঝড়ে, ৩/৪ লাখ নারীর ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়, চীন-আমেরিকা-পকিস্তানের পরাজয় ঘটে; কিন্তু এরই প্রতিদানে ‘সমাজতান্ত্রিক চীন’ ‘লাল চীন’ হয়ে ওঠে আমেরিকার নিকট বন্ধু, পুঁজিবাদী দুনিয়ার সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে পরবর্তীতে ‘পৃথিবীর কারখানা।’ সূচনায় আমাদের রক্তের ভেতর দিয়েই হয় চীনের অর্থনৈতিক উত্থান। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, রাশিয়া যখন ছিল আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী, তখন ইউরোপ ছাড়াও রাশিয়ার সীমান্তজুড়ে এশিয়ার মধ্যপ্রাচ্য ছিল বিশ^ উত্তেজনার রেডস্পট। তখন মধ্যপ্রাচ্যের তেল আর প্যালেস্টাইন ইস্যু বিশ্ব রাজনীতির প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়।

এখন নতুন প্রযুক্তি, নতুন জীবাশ্ম, এমনকি পাথুরে তেল জ্বালানির উৎস হিসেবে স্থান করে নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমলে তেলের মূল্য ও মধ্যপ্রাচ্যের জৌলুস কমবে, ফলে মধ্যপ্রাচ্যে অর্থনৈতিক সংকট নেমে আসতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামরিক দিক থেকেই নয়, ‘পাইরেসি’ তথা চুরি করে তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতেও চীন আগামীতে আমেরিকাকে চ্যলেঞ্জ জানাতে যাচ্ছে


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //