অনলাইন ব্যবসা শূন্য গোয়ালে দুষ্টু রাখাল

সম্প্রতি এক বন্ধু ইনবক্সে জানালেন, তিনি গত রোজার ঈদে বাচ্চার জন্য দুটি জামার অর্ডার দিয়েছিলেন অনলাইনে। এ জন্য টাকাও অগ্রিম পাঠিয়েছিলেন বিকাশের মাধ্যমে; কিন্তু রোজার ঈদ তো দূরে থাক, কোরবানির ঈদও চলে গেছে। ‘সেই বোষ্টমি আর এলো না’। ওই পেজে তিনি একাধিকবার নক করেছে। ফোন করেছেন; কিন্তু আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে করে এখন আর ফোনও ধরে না। বছর খানেক আগে একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার স্ত্রীরও। এই তালিকায় তারও এক হাজার টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছিল। 

এ তো গেলো জামা কিনতে এক দুই হাজার টাকার মামলা। এই শোক হয়তো দীর্ঘস্থায়ী নয়; কিন্তু যারা অনলাইন ব্যবসা বা ই-কমার্স সাইট ইভ্যালিতে টিভি, ফ্রিজ এমনকি মোটরসাইকেল কেনার জন্য লাখ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়েও পণ্য পাননি এবং আদৌ পাবেন কি-না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই, তাদের মনের অবস্থাটা কী? 

ইভ্যালি যখন অবিশ্বাস্য কম মূল্যে পণ্য দিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করছিল, তখন থেকেই অনেকে এদের বিজনেস মডেল নিয়ে প্রশ্ন তুলছিলেন যে, অর্ধেক দামে কী করে তারা পণ্য ডেলিভারি দেয়! যখন তাদের গোমর ফাঁস হলো, তখন অসংখ্য মানুষ হায় হায় করছেন।

ইভ্যালি বা এ ধরনের ই-কমার্স সাইটগুলো যা করছিল, তা যে স্বাভাবিক ব্যবসায়িক কার্যক্রম নয়, এটি ঠিকই বলা হচ্ছিল। সতর্ক ক্রেতারা এদের এড়িয়ে চলেছেন; কিন্তু সব মানুষ সাবধান বা যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও সতর্ক নন। ইভ্যালির মতো ই-কমার্স উদ্যোক্তারা হয়তো এই জনগোষ্ঠীকেই টার্গেট করেছিল। এই কথার অর্থ এই নয় যে, যারা ইভ্যালি থেকে পণ্য কিনেছেন তারা বুদ্ধিমান নন। নিশ্চয়ই অনেক বুদ্ধিমান লোকও এসব সাইট থেকে পণ্য কিনেছেন বা পণ্য কেনার জন্য অগ্রিম টাকা দিয়েছেন। তাদের অনেকে হয়তো পণ্য পেয়েছেন, অনেকেই হয়তো পাননি। আদৌ পাবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। যদি না পান তাহলে প্রমাণ হবে তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল এবং তারা লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ধরা খেয়েছেন। 

প্রশ্ন হলো, এরকম একটি অদ্ভুত ও বিপজ্জনক মডেলে ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এতদিন ব্যবসা করল কী করে? ব্যবসায়ী নেতারাও কি বিষয়টি খেয়াল করেননি না-কি তারা পর্যবেক্ষণ করছিলেন? এই যে কিছু অতি চালাক লোকের সংঘবদ্ধ তৎপরতার কারণে পুরো ই-কমার্স খাত নিয়েই মানুষের মনে সন্দেহ সংশয় তৈরি হলো এবং যার ফলে হাজার হাজার সৎ ব্যবসায়ী তরুণ-তরুণী মানসিকভাবে বড় ধরনের ধাক্কা খেলেন, তাদের ক্ষতিপূরণ কে দেবে?

স্মরণ করা যেতে পারে, এর আগে মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) নামে ডেসটিনি ও যুবক-এর মতো প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখেও অনেকে প্রতারিত হয়েছেন। মাল্টি লেভেল মার্কেটিংয়ের সেই দুঃসহ স্মৃতি জাগিয়ে তুলল ইভ্যালির মতো অনলাইন বিজনেস প্ল্যাটফর্মÑ যাদের বিষয়ে শুরু থেকেই সতর্ক করা হচ্ছিল।

সবশেষ ১৯ জুলাই ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রাসেল ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এক পোস্টে দাবি করেছেন, সময় পেলে আগের সব অর্ডার গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দিতে পারবেন। প্রশ্ন হলো, সেই সময়টা কতদিন? কারণ গণমাধ্যমের খবর বলছে, ইভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির দেনার পরিমাণ ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সম্পদের চেয়ে ৬ গুণের বেশি এই দেনা পরিশোধ করার সক্ষমতা কোম্পানিটির নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, লোকসানে পণ্য বিক্রি করার কারণে ইভ্যালি গ্রাহক থেকে অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পরও মার্চেন্টদের কাছে বকেয়া অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। গ্রাহক ও মার্চেন্টের বকেয়া ক্রমাগত বাড়ার কারণে এক সময় বিপুলসংখ্যক গ্রাহক ও মার্চেন্টের পাওনা অর্থ না পাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে এবং এর ফলে সার্বিকভাবে দেশের আর্থিক স্থিতিশীল নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা সবার হাতে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে যাওয়া এবং মানুষের ঘরের ভেতরে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশে দ্রুতই জনপ্রিয় হতে থাক ই-কমার্স সাইটগুলো; কিন্তু গত কয়েক বছরে বেশ কিছু ই-কমার্স সাইট তৈরি হয়েছে, যেগুলো গ্রাহকদের অবিশ্বাস্য ছাড় দিয়ে পণ্য বিক্রি করছে। যাদের আগে টাকা পরিশোধ করতে হয় এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পণ্য সরবরাহ করা হয়। আবার টাকা নিয়েও পণ্য সরবরাহে বারবার সময়ক্ষেপণ এমনকি পণ্য না দেওয়ার অভিযোগও ভুরি ভুরি। অনেকের ব্যবসার কৌশলও স্পষ্ট নয়। এসব মিলিয়ে ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসা নিয়ে জনমনে সন্দেহ-সংশয় তৈরি হয়েছে। আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, অনেক তরুণ এই ই-কমার্সে ব্যবসা করে, তথা অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। অনেকে বড় উদাহরণও তৈরি করেছেন। বিশেষ করে নারীদের বিরাট অংশ যারা চাকরির পেছনে না ছুটে এই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম কাজে লাগিয়ে নানারকম ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। কেউ পাইকারি বাজার থেকে কম দামে পোশাক-প্রসাধনীসহ নানারকম ফ্যাশনেবল পণ্য কিনে; কেউ নিজের ঘরে খাবার বানিয়ে বিক্রি করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে একত্রে বড় বড় প্ল্যাটফর্মও গড়ে তুলেছেন; কিন্তু সমস্যা হলো, যেহেতু এটি বাংলাদেশে একেবারেই নতুন একটি ধারণা, ফলে এই শূন্য গোয়ালে অনেক দুষ্টু রাখালও ঢুকে গেছে যারা মানুষকে অবিশ্বাস্য সব অফার দিয়ে বা চটকদার বিজ্ঞাপনে বিমোহিত করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতারণার দায়ে অনেকে গ্রেফতারও হয়েছে; কিন্তু তারপরও এই প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। আবার মানুষের একটি বিরাট অংশই এসব প্রলোভন ও লোভের ফাঁদে পা দিয়ে ধরা খাচ্ছে; কিন্তু পুরো বিষয়টি নিয়ে হৈ চৈ শুরু হয় মূলত ইভ্যালির বিষয়টি সামনে আসার পর থেকে। 

তবে ইভ্যালির ঘটনার পরে নড়ে-চড়ে বসেছে সরকার। গত ২৪ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ই-কমার্স বা অনলাইন ব্যবসার নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে। যেমন কোনো প্রতিষ্ঠান পণ্য পৌঁছে দেওয়ার আগে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা পাবে না। সেই সঙ্গে গ্রাহক একই জেলার হলে তাকে পাঁচ দিনের মধ্যে পণ্য পৌঁছে দিতে হবে। অন্য জেলার বা গ্রামের হলে পণ্য ডেলিভারিতে সময় পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ১০ দিন। এই নীতিমালায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আদালতে ক্রেতাদের মামলারও বিধান রাখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে মেয়াদোত্তীর্ণ, নকল, ভেজাল পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রয় করলেও শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা নীতিমালাটি এমনভাবে হালনাগাদ করবে, যাতে ক্রেতার অর্ডার করা পণ্য হাতে না পাওয়া পর্যন্ত ওই পণ্যের পেমেন্ট সংশ্লিষ্ট বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে জমা না হয়। এ জন্য পণ্য অর্ডারের বিপরীতে পরিশোধিত টাকা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সরকার অনুমোদিত মিডলম্যান প্রতিষ্ঠানের কাছে টাকা জমা থাকবে। 

সুতরাং এটি বলাই বাহুল্য যে, এরকম পদ্ধতি চালু হলে ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠান যারা গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা অগ্রিম নিয়ে সেই টাকা ব্যাংকে রেখে বা অন্য কোনোভাবে কাজে লাগিয়ে মুনাফা অর্জন করতো, সেই সুযোগ বন্ধ হবে। আর এই সুযোগ বন্ধ হলে এসব প্রতিষ্ঠান এত দিন ধরে যে বিজনেস মডেলে ব্যবসা করত, সেটিই সম্ভব হবে না। অর্থাৎ বাজারমূল্যের চেয়ে অর্ধেক দামে তারা কোনো পণ্য দিতে পারবে না। সেই সঙ্গে যেহেতু গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছানোর আগে তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা হবে না, ফলে কেউ টাকা নিয়ে দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস ঘুরাতেও পারবে না। 

শুধু গ্রাহক নয়, বরং যারা সৎভাবে অনলাইনে ব্যবসা করেন, তাদের স্বার্থেও এরকম একটি নীতিমালা করা জরুরি। না হলে ই-কমার্সের নামে প্রতারণা এবং অবিশ্বাস্য ছাড় দিয়ে কিছু লোককে সুবিধা দেওয়া এবং বিনিময়ে বিশাল অংশের মানুষকে প্রতারিত করার প্রবণতা বন্ধ হবে না। যে ই-কমার্সের হাত থেকে লাখ লাখ তরুণ নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছেন, চাকরির বাজারে অনেক চাপ কমেছে এবং একই সঙ্গে কেনাকাটায় মানুষের ঝামেলাও অনেকে কমে গেছে, সেই ব্যবস্থাটি সচল রাখা তথা ভোক্তাবান্ধব রাখতে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //