ছয়দফা প্রচারণায় বঙ্গবন্ধুর কর্মকৌশল

১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বহু দাবিনামা নিয়ে আন্দোলন করেছে। দাবিগুলোর অধিকাংশই ছিল ন্যায়সংগত ও জনসমর্থিত; কিন্তু দুটি দাবিনামা এই অঞ্চলে রাজনৈতিক জীবনে এনে দিয়েছিল আমূল পরিবর্তন। পাল্টে দিয়েছিল ভূ-রাজনীতি। যার একটি ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব আর অপরটি ১৯৬৬ সালে প্রণীত ছয়দফা। প্রথম প্রস্তাবের মাধ্যমে স্বাধীন পাকিস্তান আর দ্বিতীয়টির দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছিল। 

ছয়দফা কোন মনগড়া ভাবনার বিবরণ ছিল না। এটি ছিল ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে বাঙালি জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া শাসন, শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের পটভূমিতে গড়ে ওঠা জাতীয় মুক্তির সুনিশ্চিত দলিল। ছয়দফা প্রচারণার পথ মসৃণ ছিল না। এই প্রচারণায় শেখ মুজিব ও তাঁর দলের নেতাকর্মীদের, শাসকশ্রেণির নানা হুমকি ও বাঁধার মুখে পড়তে হয়েছিল। শত বাঁধা, হুমকিকে আমলে না নিয়ে বঙ্গবন্ধু দৃঢ় সংকল্প ও প্রত্যয় নিয়ে সমগ্র দেশে ছয়দফার বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ২০ মার্চ ১৯৬৬ থেকে ৮ মে ১৯৬৬ পর্যন্ত এই ৫০ দিনে ৩২টি জনসভায় তিনি অংশগ্রহণ করেন। এসব জনসভায় ভাষণ দিয়ে তিনি ছয়দফার পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছিলেন।

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ব্যক্ত বাঙালির রাষ্ট্র-ধারণা ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র এক ছিল না। দেশের মোট জনগণের শতকরা ৫৬ শতাংশ বাঙালি হলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাতে চলে যায়। দেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পূর্ববাংলার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের এক ধরনের ঔপনিবেশিক শাসন (অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ) কায়েম হয়। বাঙালিদের অবস্থা দাঁড়িয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবি খুবই ন্যায়সঙ্গত ছিল। দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা হওয়ার পরও পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে শুধু বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি করা হয়নি। বরং উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি করা হয়েছিল। অথচ  এ ন্যায্য দাবি আদায়ে শুধু আন্দোলন নয়, রক্ত পর্যন্ত দিতে হয়েছে। 

রাষ্ট্রের রাজধানী, দেশরক্ষা বাহিনীসমূহের সদর দফতর এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপিত হয়। ১৯৫৪  সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে পূর্ববাংলায় ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় বটে; কিন্তু ঐ সরকারকে মাত্র ৫৬ দিন ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হয়। ১৯৪৭-১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট ৮ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছাড়া পূর্ববাংলাকে নিয়ে একনিষ্ঠভাবে ভাববেন এমন প্রতিনিধিত্বকারী আর কেউ ছিল না। শুধু দেশের শীর্ষস্থানীয় পদ নয় প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পাকিস্তানের উভয় অংশে বৈষম্য দিন দিন তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর লাহোর প্রস্তাবের উল্লেখযোগ্য বিষয়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দিকটি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত ছিল। ফলে এ ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানে একটি চাপা অসন্তোষ শুরু থেকেই ছিল। এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘ছয়দফা হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এর তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরী হচ্ছিল। একই সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের যুগলবন্দী, স্বাধিকারের দাবিতে যাঁরা এক মোহনায় মিলেছিলেন’’। 

যা হোক সময়ের ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালে কাশ্মিরের বিবাদপূর্ণ এলাকা নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক ব্যবস্থা যে কতটা দূর্বল ছিল তা এই যুদ্ধের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠে। সতের দিন কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্রশস্ত্রের এমন অবস্থা ছিল না যে ভারতের আক্রমণ মোকাবেলা করতে পারে। সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি শাখার সদর দফতরই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। উক্ত যুদ্ধে পূর্ব বাংলার নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের এই নির্লিপ্ততা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিকভাবেই শঙ্কিত করে তুলেছিল। এ যুদ্ধ ব্যাপারে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছিলেন এভাবে- ‘চীনের ভয়ে ভারত পূর্বপাকিস্তানে যুদ্ধে জড়াতে সাহস করেনি’। এর প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- পূর্ব পাকিস্তানকে ১৭ দিন যুদ্ধকালীন সময়ে এতিমের মতো ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত লেফট রাইট করে হেঁটে যেতো তবুও তাদেরকে বাঁধা দেয়ার মতো অস্ত্র বা লোকবল কিছুই পূর্ব বাংলার ছিল না। আর চীনই যদি আমাদের রক্ষাকর্তা হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে চীনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধলেই হয়। উক্তদিনগুলোতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার বিষয়ে উদাসীনতায় যে স্বায়ত্তশানের প্রয়োজনীয়তাকে আরো স্পষ্ট করে তুলেছিল সে বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন-ÔÔThe question of autonomy appears to be more important after the war, the time has come to make East Pakistan self sufficient in all respects.’’ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের ফলে শুধু পূর্ব পাকিস্তানে অসন্তোষ ছড়ায়নি, এসময় পশ্চিম পাকিস্তানেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল। আইয়ুব খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের দূতিয়ালিতে তাসখন্দে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহদুর শাস্ত্রীর একটি সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে। উক্ত চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ সমাপ্তির পর চুক্তিতে পাকিস্তানের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠে এবং আইয়ুব খান ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা লাহোরে একটি সম্মেলন আহ্বান করে। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে- নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে এই সম্মেলনে যোগ দেবার আমন্ত্রণ জানান। শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে এতে যোগ দিতে চাননি পরবর্তীতে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পরামর্শে তিনি সম্মেলনে যোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেন। এর কারণ তিনি বুঝেছিলেন যে সম্মেলনে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতির অর্থ দাঁড়াবে পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে সক্রিয়বিরোধী শক্তির অনুপস্থিতি। 

যা হোক অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৫ সদস্যের প্রতিনিধ দল ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সম্মেলনে যোগ দেন। উক্ত সম্মেলনেই তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ছয়দফা দাবি প্রণয়ন করেন। মূলত দু’ধরণের দাবি ছিল বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফা কর্মসূচিতে। একটি হলো- রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কিত, অন্যটি অর্থনৈতিক। ছয় দফার প্রথম দফা হলো রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কাঠামো বিষয়ক; বাকি চার দফা অর্থনৈতিক বিষয় সম্পর্কিত।  লাহোর সম্মেলনে মোট ৭৪০ জন প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করেছিল। শেখ মুজিব উক্ত সম্মেলনে সাবজেক্ট কমিটির সভায় তাঁর ছয়দফা দাবি উত্থাপন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান উক্ত দফাগুলো সম্মেলনে উপস্থাপন করলে সভাপতি চৌধুরী মোহম্মদ আলী তা প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি তিনি সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে এই প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করতেও অস্বীকৃতি জানান। সভাপতির পাশাপাশি উপস্থিত ৭৪০ জনের মধ্যে ৭৩৫ জন প্রতিনিধিও তা তাৎক্ষণিকভাবে নাকোচ করে দেন। উক্ত ছয়দফা দাবি, কনভেনশনে নাকোচ করে দেওয়ার প্রতিবাদে শেখ মুজিব তাঁর ছোট প্রতিনিধি দল নিয়ে সম্মেলনস্থল ত্যাগ করেন। ঐ সম্মেলন থেকে সম্পর্কচ্ছেদ সম্পর্কে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছিলেন এভাবে- ‘‘লাহোর সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের প্রভাবশালী একটি মহল পূর্বপাকিস্তানের দাবি দাওয়া আলোচনা তো দূরের কথা শুনতে পর্যন্ত প্রস্তুত না থাকায় তিনি তার প্রতিনিধিসহ সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছেন’’।  

শেখ মুজিবুর রহমান শুধু দাবিগুলো উত্থাপন করেই ক্ষান্ত ছিলেন না, দাবিগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য ও সমগ্র দেশে ছয়দফার প্রতি জনমত সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। ছয়দফা প্রস্তাবগুলো উত্থাপনের পর তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। শাসকগোষ্ঠী এটিকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে যেন না পারে এজন্য তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পরে সাংবাদিকদের ছয়দফার ব্যাখ্যা দেন এবং  এই দফাকে তিনি বাঙালির মুক্তিসনদ বলে উল্লেখ করেন। তবে ছয়দফা  উপস্থাপনের পূর্বে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে অনুমোদন নেয়া তো দূরের কথা কমিটির সামনে তা পেশই করা হয়নি। এজন্য আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ ও বিভ্রান্ত হয়ে ছয়দফার বিরোধিতা ও সমালোচনা করতে থাকে। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পর্যন্ত ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ছয় দফায় সাম্রাজ্যবাদীদের হাত হতে পূর্ব পাকিস্তানের শোষণ বন্ধের কোন ব্যবস্থাপত্র নেই। তার দল পাকিস্তানের এক্য ও সংহতির ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে গৃহীত কোন প্রচেষ্ঠায় শরীক হবেন না। ভাসানীর ন্যায় বিভিন্ন ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোও ছয়দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি বলে নিন্দা করে। কাউন্সিল মুসলিম লীগ এ কর্মসূচিকে পূর্ব পাকিস্তাকে বিচ্ছিন্ন করার আন্দোলন বলে চিহ্নিত করে বলে- এটা ফেডারেশন নয়, কনফেডারেশনের দাবি। প্রকৃতপক্ষে লাহোর কনভেনশনে উপস্থাপনের পূর্বে ছয়দফা যাতে কোন বিরোধিতার সম্মুখীন না হয় সে জন্য শেখ মুজিব তা ওয়ার্কিং কমিটিতে পূর্বে উত্থাপন করেননি। এটা অগণতান্ত্রিক হলেও এর প্রয়োজনীয় কৌশলগত তাৎপর্য ছিল। ২০ ফেব্রুয়ারি রবিবার সকাল ৯টায় শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওর্য়াকিং কমিটির বর্ধিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে ছয়দফার প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন ও আনুষ্ঠানিক অনুমোদন প্রদান করা হয়। ওয়ার্কিং কমিটির সভায় অনুমোদন লাভের ৫ দিনের মধ্যে শেখ মুজিব তাঁর কর্মসূচি নিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় হাজির হন। ছয়দফার উপর বিভিন্ন মত-দ্বিমত কিছুদিন যাবৎ কেবল পত্রপত্রিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এই জনসভাই ছিল ছয়দফার উপর জনমত প্রচারের প্রথম প্রয়াস। দেশের অপামর জনসাধারণকে ছয়দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য আহবান জানিয়ে শেখ মুজিব বলেন- ‘‘একদিন সমগ্র পাক-ভারতের মধ্যে বৃটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসন ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ের বীর চট্টলের বীর সন্তানেরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য ছয়দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন। পাকিস্তানকে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ করে গড়ে তোলাই ছয়দফা প্রস্তাবের উদ্দেশ্য’’। ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব নোয়াখালী জেলার মাইজদী কোর্ট টাউন হলে নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন এবং বিপুল জনতার সামনে ভাষণ প্রদান করেন। একই তারিখে (২৭ ফেব্রুয়ারি) শেখ মুজিব নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জের দীঘিরপারে, ১লা মার্চ নারায়ণগঞ্জে, ৬ মার্চ ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে, ১১ মার্চ শেখ মুজিব ময়মনসিংহের জনসভায় যোগ দেন এবং ভাষণ প্রদান করেন। ১৮ ও ১৯ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পার্টি কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৯ মার্চে এ কাউন্সিলে ছয়দফা দাবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দান করে এটিকে দলীয় কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করে। ঐ একই দিনে (১৯ মার্চ) শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি পদে নির্বাচিত হন। নবনির্বাচিত সভাপতি হিসেবে ছয়দফা সম্পর্কে নেতা কর্মীদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। তিনি এ সংগ্রামের পথ যে অনেক কন্টকাকীর্ণ এবং এর সাফল্য যে সময় সাপেক্ষ তা উল্লেখ করে কর্মীদের সতর্ক করেন। ২০ মার্চ ঢাকার পল্টনে, ৭ এপ্রিল পাবনা জেলার নগরবাড়ীতে,  ৮ এপ্রিল পাবনায়,  ৯ এপ্রিল বগুড়ায়, ১০ এপ্রিল দিনাজপুরে, ঐ একই দিনে (১০ এপ্রিল) রংপুরে,  ১১ এপ্রিল রাজশাহীতে জনসভায় অংশ নিয়ে ছয়দফার সাথে যে কোন আপোষ চলবে না তা তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন এবং কখনই তিনি ছয়দফা প্রশ্নে কোন আপোষ করেননি। এমনকি জুলফিকার আলী ভুট্টোও উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু কখনো ছয়দফার সাথে আপস করবেন না। এ সম্পর্কে ভুট্টো নিজেই বলেন- Sheikh Mujibur Rahman took the position that the Six Point formula was “the property of the people of Bangladesh” and there could be no question of compromise on it. 

যা হোক ১৩ এপ্রিল ফরিদপুরে, ১৫ এপ্রিল যশোরে, ১৬ এপ্রিল কুষ্টিয়া, ১৭ এপ্রিল খুলনার জনসভায় শেখ মুজিব উপস্থিত হন। ১৮ এপ্রিল পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা আইনের ৪৭(৫) ধারা বলে পুলিশ পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে যশোরে গ্রেফতার করে। পরদিন অর্থাৎ ১৯ এপ্রিল তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। এসময় তাঁর ৫টি মামলা বিচারাধীন ছিল। ২১ এপ্রিল সিলেটে এম.ডি.ও আদালতের এক পরোয়ানা বলে রাত্রি ৯টায় তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে থেকে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করে সিলেটে প্রেরণ করা হয়। ২৪ এপ্রিল পল্টন ময়দানে সভাপতির আসন শূণ্য রেখেই জনসভার অয়োজন করা হয়। এসময় শেখ মুজিব ময়মনসিংহ জেলে ছিলেন। ২৫ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয় এবং তাঁকে ঢাকা ও ময়মনসিংহে বিপুল সংবর্ধণা দেওয়া হয়। ২৯ এপ্রিল কুমিল্লায়, ৭ মে সিলেটে কোর্ট ময়দানে, ৮ মে নারায়ণগঞ্জে জনভায় যোগ দেন। এ আন্দোলন যখন ব্যাপক জনসমর্থন লাভ করে বৃহত্তর আন্দোলনের রূপ নিতে থাকে ঠিক তখনই  আন্দোলনকে স্থবির করার জন্য ৮ মে ১৯৬৬ তারিখে শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশ রক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ৯ মে তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। একই সঙ্গে নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা শুরু হয়। এ আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে শেখ মুজিবুর রহমান ৮ মে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ একটানা ৩৩ মাস কারাগারে ছিলেন। ১৩ মে আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ দিবস পালন উপলক্ষে জনসভা করে। জনসভায় জনতা ছয়দফার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৭ জুন হরতাল ডাকা হয়। শত নির্যাতন উপেক্ষা করে জনগণ ৭ জুনের হরতাল পালন করে ছয়দফার প্রতি তাঁদের সমর্থন জানিয়ে দেয়। পুলিশ বিনা উস্কানিতে জনগনের উপর গুলি চালায়। শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন নিহত হন। আন্দোলন দমন করতে নির্যাতনের মাত্রা যত বাড়তে থাকে, সাধারণ মানুষ তত বেশী আন্দোলনে সামিল হতে থাকে। 

ছয়দফা প্রচারণায় তিনি যে সফল হয়েছিলেন তার উৎকৃষ্ট প্রমান পাওয়া যায় ৭ জুন তারিখের হরতালে। কারণ হরতাল সফল করার জন্য সর্বস্তরের জনগণের সতঃস্ফূর্তঅংশগ্রহণ ছিল। ছয়দফা যে বাংলার মানুষের সত্যিকার অর্থেই মুক্তির সনদ ছিল তা তিনি নিরলস প্রচারণার মাধ্যমে বাংলার মানুষকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন। দূরদর্শী শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীনতার রূপরেখা তৈরী করতেই ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবি ঘোষণা করেছিলেন।

ছয়দফায় স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়। তাই একে বাংলাদেশের অগ্রিম জন্মসনদ বলা যায়। ৬-দফা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলাম এই কর্মসূচিকে Only a short step away from complete independence বলে অভিহিত করেছেন। বাঙালির মুক্তির প্রশ্নে ছয়দফা কর্মসূচি যে সঠিক ছিল সে সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের অবিচল বিশ্বাস ছিল। এজন্য তিনি  দফাগুলো উত্থাপন করে শত বাধা বিপত্তির মুখে পতিত হলেও তা প্রচার ও বাস্তবায়নের লড়াই থেকে পিছুপা হননি। তাঁর প্রচেষ্টা ও ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে ছয়দফা ক্রমেই বাঙালি জনতার মুক্তির সনদে রূপান্তরিত হয়। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সত্তরের নির্বাচনকে এদেশের মানুষ ছয়দফা প্রশ্নে গণভোট হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আর এভাবেই স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে বিপুল জনরায় নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে পৌঁছে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বর্ণ দুয়ারে। ছয়দফা সম্পর্কে ইতিহাসবিদ সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের একটি বক্তব্যে প্রণিধানযোগ্য- "ছয়দফায় স্বাধীনতার কোন কথা লেখা ছিল না। সেখানে ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ণের সুপারিশ এবং স্বায়ত্তশাসনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটা পথ-নির্দেশ। এটা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক কৌশল’’। ছয়দফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন: শেখ মুজিব বলেন "আমার দফা আসলে তিনটা। কতো নেছো (নিয়েছ), কতো দেবা (দিবে), কবে যাবা?" ন্যাপ নেতা মোজাফফর সাহেব যখন শেখ মুজিবকে বলেছিলেন- এত দফা তিনি কেন দিয়েছিলেন? এর উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান হেসে বলেছিলেন, ‘‘ছয়দফার আদলে তো আমি এক দফার কথাই বলেছি আর সেটি হলো স্বাধীনতা।‘’ 

লেখক: গবেষণা সহকারী, 
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //