আশুরার তাৎপর্য ও শিক্ষা

হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস মহররম। এ মাসের দশম তারিখকে বলা হয় আশুরা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সৃষ্টির সূচনাকাল থেকে শেষ নবীর উম্মত পর্যন্ত অসংখ্য তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী ও স্মারক হয়ে রয়েছে দিনটি। শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়, ইহুদি ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের কাছেও দিনটি অনন্য মর্যাদার অধিকারী।

আশুরার এই দিনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক নবীর স্মৃতি। মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.) ও আদি মাতা হজরত হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আসার পর দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থেকে এই দিন তারা এক স্থানে মিলিত হন। হজরত নূহ আ. এর জাহাজ কয়েক মাস প্লাবনের পানিতে ভাসার পর এই দিনে জুদি পাহাড়ের গায়ে এসে লাগে। হজরত ইবরাহিম (আ.) কে সমকালীন জালেম শাসক আগুনে নিক্ষেপ করলে আল্লাহর নির্দেশে সে আগুনের গর্ত পরিণত হয় ফুলের বাগানে। এই দিনেই ঘটনাটি ঘটেছিল। হজরত ইদরিস (আ.) কে এই দিন উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়। হজরত ইউসুফ (আ.) দীর্ঘকাল পর এই দিন পিতা হজরত ইয়াকুব (আ.) ও মায়ের সঙ্গে আবার মিলিত হন। হজরত আইয়ুব (আ.) দীর্ঘকাল রোগ ভোগের পর এই দিন আরোগ্য লাভ করেন। হজরত মুসা (আ.) এই দিনে তূর পাহাড়ে গিয়ে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সরাসরি কথা বলার অনন্য মর্যাদা লাভ করেন। ফেরাউনের কবল থেকে হজরত মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইলের নিষ্কৃতি লাভের ঘটনাও ছিল এদিনে। এভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় প্রতি বছর আশুরার দিন।

কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে একটি ঘটনা অন্যসব স্মৃতিকে ম্লান করে দিয়েছে। শেষ নবী (সা.) এর আদরের নাতি, শেরে খোদা হজরত আলী (রা.) ও জান্নাতে রমণীকুলের নেত্রী হজরত ফাতেমা (রা.)-এর নয়নমনি হজরত হুসাইন রা. ও তার সাথীরা বর্তমান ইরাকের অন্তর্গত কুফা নগরীর অদূরে কারবালা প্রান্তরে এই দিনেই নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন ইয়াজিদ নিযুক্ত আঞ্চলিক গভর্নর উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনীর হাতে। ৭০ জনের কিছু বেশি সদস্যের প্রায় সবাই ছিলেন নবী পরিবারের যুবক ও কিশোর। এ ঘটনার স্মৃতি প্রতিটি মুসলমানের মনে আবেগের ঢেউ তোলে। এমনকি কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস অবলম্বন করে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য, মহাকাব্য ও উপন্যাস।

কিন্তু আশুরার দিনটিকে নিছক শোকের উপলক্ষ হিসেবে পালন করা ইসলামের মৌল চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আশুরা শোক নয়, ইবাদত ও উপলব্ধির দিন। বরং হজরত হুসাইনের আত্মত্যাগ ও অবিচলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া ও তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করার অঙ্গীকার এ দিনের প্রধান আবেদন।

এখন মুসলিম বিশ্বে কারবালার ময়দান একটি নয়, অনেক। একাধিক স্থানে প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে কারবালার মতোই মর্মন্তুদ ঘটনা। প্রাণ দিচ্ছেন অগনিত হুসাইন। অন্তর্কলহ ও বিভক্তির মাঝে পড়ে মুসলিম উম্মাহ শোচনীয় দুর্দশায় নিমজ্জিত। বৈরী শক্তিগুলোর আগ্রাসনের মুখে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান তারা। যে ধর্মীয় বন্ধন তাদের পৃথিবীব্যাপী ঐক্যের মাধ্যম, তার প্রতি ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা এখন অনেকটাই দুর্বল। নিজেদের মুসলিম পরিচয়কে গর্বের বিষয় মনে করতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন মুসলিমপ্রধান অনেক রাষ্ট্রের শাসকরা। সুতরাং মার্সিয়া আর ক্রন্দন নয়, এখন চাই ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণসাধনের প্রতিজ্ঞা। এটাই আশুরা দিবসের মূল আহ্বান ও দাবি। এ আহ্বানে সাড়া ও এ দাবি পূরণের চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারলে ঘটতে পারে মুসলিম উম্মাহর নব জাগরণ।

তিরমিজি শরিফে উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) এর একটি উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে। তিনি বলেন, আরবরা জাহেলী যুগেও আশুরার দিনে রোজা রাখত। আল্লাহর রাসূলও (সা.) এদিনে রোজা রাখতেন। তারপর তিনি হিজরত করে মদিনায় এসে নিজেও রোজা রাখলেন, মুসলমানদেরকেও রোজা রাখার আদেশ দিলেন। পরে যখন রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আয়াত নাজিল হলো, তখন থেকে আশুরার রোজা নফল বা ঐচ্ছিক হয়ে গেল। আরেক বর্ণনায় অছে, আল্লাহর শেষ নবী (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন, এখানকার ইহুদিরা রোজা রেখেছে এবং এদিনটিকে তারা বিশেষ মর্যাদা দেয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা জানায়, হজরত মুসা ও বনি ইসরাইলকে এই দিনে আল্লাহ তায়ালা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি দান করেছিলেন। এ জন্য হজরত মূসা (আ.) এদিনে রোজা রাখতেন। এ কথা শুনে মহানবী (সা.) ইরশাদ করলেন, হজরত মুসার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ। এই বলে তিনি মুসলমানদের আশুরার দিনে রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। তবে তিনি মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য আশুরার আগের দিন বা মহররমের নবম তারিখেও রোজা রাখার পরামর্শ দিলেন।

হজরত আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবি (র.) এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, মর্যাদার দিক দিয়ে আশুরার রোজা তিন ধরনের। সর্বোচ্চ মর্যাদা হলো আশুরার সঙ্গে আগের দিন ও পরের দিন মোট তিন দিন রোজা রাখা। দ্বিতীয় পর্যায় হলো- আশুরার সঙ্গে আগের দিনও অর্থাৎ দু’দিন রোজা রাখা। আর ন্যূনতম হলো শুধু আশুরার দিনে রোজা রাখা।

আশুরার দিনের রোজার ফজিলত প্রসঙ্গে সাহাবি হজরত আবু কাতাদা (রা.)-এর বরাতে তিরমিজি শরিফেই বর্ণিত আছে, আল্লাহর রাসূল সা, ইরশাদ করেন- আমি আশা করি আশুরার রোজার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা পেছনের এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। অতএব, আশুরার দিনের প্রধান কর্তব্য রোজা রাখাসহ ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকা। শোক মিছিল ও এ জাতীয় কর্মকাণ্ড ইসলাম সমর্থিত নয়। এগুলো বিদায়াত। এগুলো পরিহার করা প্রয়োজন।

বস্তুত মহররম ও আশুরা মুসলিম উম্মাহর নবজাগৃতির বারতা নিয়ে আগমন করে। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরি পঞ্জিকা প্রবর্তিত হয়েছে। কেননা ইসলামের নবীর হিজরত শুধু মুসলিম উম্মাহর জন্য নয় বিশ্বমানবতার ইতিহাসে এক মোড় ঘোরানো অধ্যায়। তাই হিজরি নববর্ষে নতুন উদ্দীপনার অঙ্গীকারের সঙ্গে নিজেদের জীবন ও কর্মকাণ্ডের জন্য সাজে সারাদুনিয়ার মুসলমান। বিগত বছরের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তারা এগিয়ে যায় সামনের দিনগুলোতে। ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর দৃঢ়বন্ধনে সবাইকে আবদ্ধ হয়ে মুসলিম মিল্লাত নিজেদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে আবার এগিয়ে যাবে- এ আহ্বান নিয়ে আগমন করে হিজরি নববর্ষ ও আশুরা দিবস।

সুতরাং আশুরা শোক নয়, ইবাদত ও উপলব্ধির দিন। বরং হজরত হুসাইনের আত্মত্যাগ ও অবিচলতা থেকে শিক্ষা নেওয়া ও তা নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করার অঙ্গীকার এ দিনের প্রধান আবেদন। এখন মুসলিম বিশ্বে কারবালার ময়দান একটা নয়, অনেক। একাধিক স্থানে প্রতিদিন সংঘটিত হচ্ছে কারবালার মতোই মর্মন্তুদ ঘটনা। প্রাণ দিচ্ছেন অগণিত হুসাইন। অন্তর্কলহ ও বিভক্তির মাঝে পড়ে মুসলিম উম্মাহ শোচনীয় দুর্দশায় নিমজ্জিত। বৈরী শক্তিগুলোর আগ্রাসনের মুখে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান তারা। সুতরাং মার্সিয়া আর ক্রন্দন নয়, এখন চাই ক্ষুদ্রস্বার্থ ত্যাগ করে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা এবং কল্যাণসাধনের প্রতিজ্ঞা। এটাই আশুরা দিবসের মূল আহ্বান ও দাবি। এ আহ্বানে সাড়া ও এ দাবি পূরণের চেতনায় উজ্জীবিত হতে পারলে ঘটতে পারে মুসলিম উম্মাহর নব জাগরণ।

লেখক- ইসলামি চিন্তাবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //