ভ্যাকসিন চুরির ঘটনা

ঢাকার উত্তরায় অবৈধভাবে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়ার অভিযোগে একজনকে আটক করে মামলা করেছে পুলিশ। দক্ষিণখান এলাকার ‘দরিদ্র পরিবার সেবা’ নামের একটি ক্লিনিকে এই ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণখানের তিনটি ওয়ার্ডের গণটিকা কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বেসরকারি সংস্থা ইউনিটি থ্রু পপুলেশন সার্ভিসেসকে (ইউটিপিএস)। 

ইউটিপিএস যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই দায়িত্ব পালন করছিল, সেই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই ক্লিনিকটিও ছিল। গণটিকা কর্মসূচির সময় ঢাকা সিটি করপোরেশনের এই সেবাকেন্দ্র থেকে টিকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ক্লিনিকের মালিক একজন পল্লী চিকিৎসক, তার বাসা থেকে মডার্না টিকার ২০টি খালি বাক্স ও ২টি টিকার অ্যাম্পুল উদ্ধার করা হয়েছে। টিকা দেওয়ার পর খালি ভায়াল বা শিশি ইউটিপিএসকে বুঝিয়ে দেওয়ার পরও গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির কাছে খালি ভায়ালগুলো এলো কোত্থেকে, তা এখনো স্পষ্ট হয়নি। 

চুরি শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল থেকেও করোনার টিকা চুরির অভিযোগ উঠেছে। মেক্সিকোর একটি হাসপাতাল থেকেও চুরি হয়েছে করোনাভাইরাসের টিকা। 

টিকা আবিষ্কারের আগে আমাদের আলেম সমাজের অনেকে বললেন, করোনাভাইরাস ‘আল্লাহর সৈনিক’, এমন কি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারিও একই কথা বললেন। কথা বলার সময় এদের হুঁশ থাকে না, এমন বাহুল্য কথা যে বুমেরাং হতে পারে, তা চিন্তাও করেন না। ভ্যাকসিন শরীরে নিয়ে ‘আল্লাহর সৈনিক’-এর বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ দাঁড় করানো যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না; কিন্তু কিছু মানুষ আলেমদের কথায় প্রথমে বিশ্বাস করেছিল এবং বিশ্বাস করেছিল বলেই প্রথমে টিকা নিতে অনাগ্রহী ছিল। অন্যদিকে ভারতবিরোধীরা ভারতে তৈরি টিকার অসারতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোর প্রচারণা শুরু করেন, এমন কি ভারতে উৎপাদিত টিকা নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপও করেছেন। এই প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে প্রথমে অনেকে টিকা নেননি। অনেকে আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে টিকা নেননি, যারা টিকা নিয়েছে তাদের পর্যবেক্ষণ করেছেন। উপরন্তু অনেকে সৃষ্টিকর্তার করুণার ওপর নির্ভর করে টিকা গ্রহণের বিরোধী ছিলেন, অনেকের মধ্যে এমন বিশ্বাস জন্মে যে, খেটে খাওয়া মানুষের করোনা রোগ হয় না। সর্বোপরি নিবন্ধনের জটিলতায় নিরক্ষর ও গরিব মানুষগুলো টিকা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। পাশ্চাত্যের শিক্ষিত লোকদের মধ্যেও ভ্যাকসিন নেওয়া ও মাস্ক পরা নিয়ে উন্নাসিকতা রয়েছে। আমেরিকায় মৃত্যু সংখ্যা এখনো সর্বোচ্চ; কারণ ওখানে এক শ্রেণির লোক টিকা গ্রহণ ও মাস্ক পরার প্রতি আগ্রহী নয়। 

টিকার চাহিদা বর্তমানে আমাদের দেশে বেড়েছে; যতই দিন যাচ্ছে করোনার টিকা নেওয়ার লাইন ততই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছ। মৃত্যুভয় রক্ষণশীল ও বিশ্বাসী মানুষগুলোকেও কাবু করে ফেলেছে, টিকা গ্রহণের জন্য এখন রাত ৩টায় লাইনে দাঁড়ায়। শুধু লাইনে দাঁড়ায় না, টিকা নেওয়ার জন্য গোপন পথে ধরনাও দেয়; কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ তাদের নাগরিকদের জন্য টিকা নিশ্চিত করতে পারছে না। যে দেশ তার যতবেশি নাগরিককে টিকার আওতায় আনতে সমর্থ হচ্ছে সেই দেশ তত দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। কোনো কোনো দেশ ৭০-৮০ শতাংশ নাগরিককে টিকার আওতায় এনে করোনার প্রকোপ অনেকটা থামিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড প্রভৃতি দেশে দু’একজন আক্রান্ত হলেও তার বিস্তার রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে; সাধারণ নাগরিকদের দেশের বাইরে যেতে হলে সরকারের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে যেতে হচ্ছে, তিন মাসের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করবে না এমন শর্তে অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। 

পৃথিবীর অনেক দেশের পাসপার্ট দিয়ে বিনা ভিসায় শতাধিক দেশ ভ্রমণ করা যায়। বিপদ শুধু আমাদের মতো গরিব দেশের। আমাদের কোটি কোটি লোক বেকার; জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেকার যুবকরা অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে; কর্মের অন্বেষায় নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছে, মালয়েশিয়ার গহীন জঙ্গলে না খেয়ে মশার কামড় খাচ্ছে, লিবিয়ায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে অকাতরে প্রাণ দিচ্ছে। অন্যদিকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের উছিলায় বৈধপথে শত শত ছাত্র-ছাত্রী ইউরোপ, ইংল্যান্ড, কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে গিয়ে অভিবাসী হচ্ছে। এ ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবার দুর্গতির জন্য উন্নত ও নির্ভরযোগ্য চিকিৎসা গ্রহণার্থে, ব্যবসার জন্য, ওমরাহ হজ করতে আমাদের বিদেশ যেতে হয়; কিন্তু এখন বিদেশ যাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছে। টিকার রাজনীতি শুরু হওয়ায় ছাত্র-ছাত্রী, কর্মপ্রত্যাশী শ্রমিক, রোগী এবং ব্যবসায়ীদের বৈধ পথে বিদেশে গমন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। 

এক সময় ঘন ঘন বিমান ছিনতাই হতো; এই ছিনতাই ঠেকাতে প্রতিটি বিমানবন্দরে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যাত্রীদের অনেক সময় নাজেহাল হতে হয়েছে এবং এখনো হতে হচ্ছে। আমেরিকা তাদের দেশ ও নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমেরিকা গমনেচ্ছু যাত্রীদের ভ্রমণ সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্ট যাচাই এবং যাত্রীর দেহ তল্লাশি যাত্রার মাঝপথে ভিনদেশেই করে থাকে। এখন করোনা ঠেকাতে নতুন উপসর্গ যোগ হয়েছে, বিদেশ গমনেচ্ছু যাত্রীদের নতুন একটি ডকুমেন্ট বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে; ইমিগ্রেশনে পাসপোর্টের মতো করোনার টিকা গ্রহণের সার্টিফিকেট দেখাতে হচ্ছে; কিন্তু কিছু টিকার সার্টিফিকেটও অনেক দেশের নিকট গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তিদের নিজ নিজ দেশের নির্ধারিত টিকা না নিলে ভিসাও দেওয়া হচ্ছে না। সৌদি আরবের শর্ত হচ্ছে, কেউ চীনের তৈরি সিনোফার্মের টিকার দুটি ডোজ নিলে তাদের আবার ফাইজার, মডার্না, অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার বুস্টার ডোজ গ্রহণ করতে হবে। 

পশ্চিমের দেশগুলোতে যেতে হলে তাদের তৈরি টিকা নিতে হবে, চীন বা রাশিয়ার টিকা নিলে হবে না। চীনও একইভাবে যারা তাদের টিকা নেয়নি তাদের চীনে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করছে। এগুলো ব্যবসা ও বিশ্ব রাজনীতির বিষয়; আমাদের মতো গরিব দেশের ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের পক্ষে এত দেশকে খুশি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সৌদি আরবের শর্ত মোতাবেক এক ধরনের টিকা নেওয়ার পর অন্য ধরনের টিকা নিলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কি-না, তা নিয়ে এখনো গবেষণা হয়নি। অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশের মানুষের টিকা নিয়ে এত বাছাই করার সুযোগ এবং সামর্থ্য কোনোটাই নেই; টিকা না পাওয়ার চেয়ে যে টিকা পাওয়া যাবে তাই গ্রহণ করাই সকলের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতদসত্ত্বেও বিদেশ গমনে ইচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীদের মডার্না, ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা আমাদের স্বার্থেই সমীচীন হবে। 

সত্তর দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমার পরিচিত এক ব্রাদারের বাসার চৌকির নিচে অসংখ্য সেলাইন দেখেছিলাম, সেলাইনের গায়ে লেখা ছিল ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল’। সেলাইনের ওপর সিল মারা লেখাটি কীভাবে তুলে ফেলা হতো তাও দেখেছি। এগুলো হাসপাতাল থেকে কীভাবে পাচার হতো তা কখনো জানার চেষ্টা করিনি। এখন একবিংশ শতাব্দীতে এসেও দেখছি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ওষুধ চুরির ছিদ্র বন্ধ করতে পারেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির কথা বারবার মিডিয়ায় আসছে। করোনা টিকা গ্রহণের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়লেও সরকারের পক্ষে চাহিদা অনুযায়ী টিকা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই ক্রাইসিস দেখেই লোকজন টাকা খরচ করে হলেও চুরি করা টিকা গ্রহণ করছে; কিন্তু চুরির টিকা যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও পরিবহন করা হয় না বিধায় এই টিকা নিলে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। করোনার ভ্যাকসিনের অপব্যবহার ও চুরি অবশ্যই রোধ করতে হবে। কারণ টিকার ক্রাইসিস আরও বেড়ে গেলে এবং কড়া নজরদারি না থাকলে জিঞ্জিরায় করোনার টিকা তৈরি শুরু হয়ে যেতে পারে। 


লেখক- সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //