‘পার্টিশন’ প্রপঞ্চ ও ফর্মের বুননকাঠামো

এক

আমি দেশভাগ না বলে ‘পার্টিশন’ বলব, ‘পার্টিশন’ একটি প্রপঞ্চ; বিশেষ করে যখন পেরিয়ে গেছে তার সত্তর বা ততধিক বর্ষ, মনের দাগ, স্মৃতির পাটাতন, শ্রুতির রেখা হয়ে গেছে ফ্যাকাশে, মলিন, বিবর্ণ; ধসে গেছে সে প্রজন্ম, তারপর এসেছে আরেকটি এবং আরও নতুন একটি প্রজন্ম- এক্ষণে লকলক করে বাড়ছে, বেড়ে উঠছে; তারা শুধু তাকায় পেছনে, না-শোনা না-দেখা ইতিহাসের দিকে- কিন্তু কিছু একটা ঘটেছে, অনেক বড় কিছু- সেটি বুঝতে চায় তারা, বুঝতে পারে কিন্তু ধরতে পারে না। জরুরি কিছু যে সেটি নিশ্চিত- ওই কাঁটাতার- যেন কত ব্যথার শকুন, কত মৃতদেহ, কত বিচ্ছেদ- ভাগ-বিভক্তির মন-মনন- দ্বিখণ্ডিত হৃৎপিণ্ড- সেই স্মৃতি তো ভোলার নয়- কে ভুলবে?

সেজন্য ‘দেশভাগ’ কথাটি যতটা যৌক্তিক তার চেয়ে বেশি প্রপঞ্চ-মাখা ‘পার্টিশন’ যেন পরিচিত হাহাকারের প্রতিচ্ছবি- খুব বেশি করেই মনে হয়, বাস্তব করে দেখা যায়। আমলে আনা সম্ভব হয়। পরিষ্কার করে ধরা ও ছোঁয়া যায়। ১৯৪৭-এ বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হওয়া নিয়ে অনেক চুলচেরা অসীম অসম অধীত কথাবার্তা কম হয়নি। হয়ে চলছে আজও। যুক্তিতে তা ঠিক খাড়া হয়নি যতটা আবেগে। মন ভাঙা যায় না, ভেঙে গেলে তা একা ভাঙে না, সমাজ-সংস্কৃতি-বাস্তবতা-সংগ্রাম-অস্তিত্ব-ইতিহাস-ঐতিহ্য-পরম্পরা-আহার-অনুযোগ ইত্যাকার সব দুমড়ে-মুচড়ে যায়, গেছেও। তাই গাণিতিক যৌক্তিক কোনো সমাধান বা ফল পার্টিশন বয়ে আনেনি, সে নিরীক্ষাও হয়নি। আজও। যদি সাদা চোখে দেখি আসামের দিকে, সিলেটের দিকে, খুলনার দিকে- কতকিছু সত্য হয়ে উঠবে, তার সারা শরীরে লেপ্টে আছে ক্ষত, বিক্ষত মন ও জীবন- তার উত্তর কী? কী তাদের অপরাধ? মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, স্বাধীনতার স্বপ্ন-আনন্দ মুছে গেছে দেশভাগের বেদনায়- কথাটি যেমনই হোক, এর পশ্চাৎপদ কারণ কী, কে দায়ী, কোন ধর্ম, কোন সম্প্রদায়- উত্তর কি আজও মিলেছে? কিংবা মিললেইবা কী? যা ঘটেছে- তাই পূর্ণ সত্য, প্রখররূপে বাস্তব। সত্যের কিনারে গড়ে উঠেছে যে বাস্তবের রুপোলিরেখা- সেইটিই মেনে নিয়ে চলা ছাড়া কার কী উপায়! কয়েক প্রজন্ম সেভাবেই চলছে। ওপারে যারা বাস করছেন, তাদের অনেকেই এপারের মানুষ, এপারে যারা আছেন তারাও অনেকে ওপারের মানুষ- সরলরূপে ধর্মের কারণেই এই এপার-ওপার করা। আবার ধর্ম-ব্যতিরেকে যারা ব্যতিক্রমরূপে ‘সংখ্যালঘু’র দাহ নিয়ে মাটি আঁকড়ে আছেন- তারা কষ্ট বা সংগ্রাম কম করছেন না- কম নয় মনের ব্যথা। একটা প্রতিরোধ প্রতিদিন চলে, মনে বা মনের বাইরে, ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’ কি-না- সেই সংকটে। এসব ঘটনা কে করল? কে একজন ব্যক্তিকে এরকম কঠিন মনস্তত্ত্বে পোড়াল, সেজন্য যে ভেসে যাচ্ছে- কত সুস্থ-সতেজ চিন্তা, অনিরাপত্তার অজুহাতে, অপদস্ততার ভয়ে, হীনম্মন্যতার কাঠগড়ায়- তার দাম কে দেবে?

সাহিত্য তো এসব নিয়েই। কথক তো তার চরিত্রের মধ্যে এসবই খুঁজবেন, খুঁজতে চাইবেন। সে তরিকাতেই তিনি ভাষা গড়বেন, ভাষার প্রতিমা তৈরি করবেন। ‘পার্টিশন’ কী তাতেই বোঝা বা জানা হয়ে যাবে। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ভ্রমণ আরও কঠিন। স্বাধীনতার পর আবার স্বাধীনতার জন্য লড়তে হয়েছে। সেটি অন্য আন্দোলন। অন্যরকম টিকে থাকা। জীবন-মরণ সে টিকে থাকার লড়াই। বাঁচার ও সংগ্রামের লড়াই। ভাষাভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্রের লড়াই। মধ্যবিত্ত হওয়ার লড়াই, নগরের নাগরিক হওয়ার লড়াই- সর্বোপরি বাজে-ভুয়া-চাপিয়ে দেওয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই। কী এক পাকিস্তান? কত দূরে তার কেন্দ্র- এ মেলে কীসে? কেউ তা ভাবেনি? এক ধর্ম (যদিও বাঙালি মুসলিম আর পাকিস্তানি মুসলিম তুমুল ফারাক- সেটা সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে কত লেখক বলেছেন) তবুও তাই-ই চেপে বসে, অনাহূতভাবে, মিছে ধর্মের বর্মে। বাংলা ভাষাসৈনিক হাসান হাফিজুর রহমানের (১৯৩২-১৯৮৩) গল্পে প্রচুর তোড়জোড়ের মধ্যে, পাকিস্তানের ভূত নামানোর ব্যস্ততার লড়াইয়ের মধ্যে দেশভাগের তীব্র কান্না পুনর্গঠিত হয়। আলাদা কথনে বিবৃত হয় দেশভাগ তথা পার্টিশন। গল্প : ‘আরও দুটি মৃত্যু’। অসম্ভব উত্তেজনাপ্রবণ, রোমহর্ষক গল্প। ঢাকা থেকে জামালপুরগামী ট্রেনে এক গর্ভবতী নারীর প্রসববেদনার তীব্রতার ভেতরে ট্রেনে দাঙ্গার ভয় ছড়িয়ে পড়ে। দেশভাগের অনাহূত আবেগের উত্তাপ টগবগ করতে থাকে তাতে। চরম ব্যস্ত-ভীড়াক্রান্ত ট্রেনের মধ্যে প্রসব-বিপদাপন্ন নারীর ক্রন্দন আর ভয়ে প্রাণ নিয়ে বাঁচানো জনতার রোষ আর মানবতার তীব্র যুদ্ধ নিয়ে এই গল্প। গল্পটি মনে রেখাপাত করে। গভীরতায় ছুঁয়ে যায়। এরকম কথক হাসান হাফিজ যে গদ্যে আটকান তা এরকম : ‘একটি মা। একটি মাতৃত্ব আকাক্সক্ষী নারী, জীবনের জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যুঝেছে। তার ফুলে ওঠা পেটের ভেতরে আছে একটি শিশু, একটু আগেও জীবিত ছিল সে। জন্মাতে পারলে অনেক কিছুই হয়ত করতে পারত। ... এ জন্মকে রুখল কে?’ মানবতার মর্মন্তুদ চিত্রার্পণ। সেটি দাঙ্গা কিন্তু পার্টিশনের পার্ট। পার্টিশনের দাগ। পার্টিশনের পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতির বর্ণনা কোন কথনে? ‘হয়তো নবজাত শিশুর কোমল কান্নায় এই ভয়াবহ ফসিলের মতো স্তব্ধতা গুড়িয়ে দেবে। এক আর্ত নারীকণ্ঠের তীক্ষ্ণ তীব্র প্রতিবাদ ছিন্নভিন্ন করে দেবে এই স্থবিরতা।’- কথকের ন্যরেশনে গড়ে ওঠে পরিস্থিতির কানেক্টিভিটি- তাতে ‘এহানে জাগা নাই’- স্বরটি পুরো ঘটনাটিকে তীব্র হাহাকারে পরিণত করে। বিপন্নতার অভাবনীয় কথন যেন। কণ্ঠস্বরে করুণ আর্তনাদ। এরকম আরও উদাহরণ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ গল্পে। প্রতীকী সে তুলসী গাছ। সেটিকে ঘিরে সক্কলের আবাস আবার বিচ্ছেদ, পুলিশ এসে বাড়িটি খালি করে গেলে তুলসী গাছ অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়ে রয়। ওয়ালীউল্লাহর বর্ণনায় বাস্তুচ্যুত, বিশীর্ণ মানুষদের কথা বলে, তাদেরই সবটুকু তুলে আনে- অকপট, নির্মম ও শক্তিশালী সে কথন : 

উঠানের শেষে তুলসীগাছটি আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরি রঙ। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয়নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছলে চোখের কথাও আর কারও মনে পড়েনি। 

কেন পড়েনি সে কথা তুলসী গাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা। 

কথকের কথার পর অন্য একটি ফর্মে আরেকটি প্রশ্নতপ্ত বাক্য : ‘মানুষেরই জানবার কথা’। কী জানবার কথা- তা বলা হয়নি, কিন্তু সবটুকু বলা হয়ে যায়। ওয়ালীউল্লাহ্ শক্তিশালী কথক। বিন্দুমাত্র ঝুলে যান না। সেটি সর্বরকমে সবটুকু আলো-আঁধারীতে সমস্তকিছু পদদলিত করে নির্মম সত্যটিই প্রকাশ করেন, অবচেতনের ধারায়, অপ্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্নতায়- যা হয়ে ওঠে তীব্র ও গভীররূপে প্রকাশ্য। হাসানের গল্পে যেমন ‘এহানে জাগা নাই’ পূর্ববঙ্গীয় টানের উৎকট বাস্তবতার গন্ধ আর ওয়ালীর ছুড়ে দেওয়া প্রশ্ন নিঃসীম, নিস্তব্ধ বাড়িটিতে তুলসীগাছের একাকীত্ব আর চলে যাওয়া সব মানুষের বসবাসের চিহ্ন- ‘কাগজের ছেঁড়া পাতা, কাপড় ঝোলাবার পুরনো দড়ি, বিড়ি-সিগেরেটের টুকরো, একটা ছেঁড়া জুতোর গোড়ালি।’- এমনসব আশ্চর্য প্রতীকী কারবার নিয়ে তুমুল গল্প! কথনের শক্তি কত? তার ফর্ম কঠিন-বাস্তবতায় মোড়া। জুড়ে আছে যা- তা সবটাজুড়ে পার্টিশন। দেশভাগের ভেতরের নির্মম হাহাকার। কোনো তুল্যমূল্য নয়! কথাগুলো স্থানিক, ঢাকার, পূর্ববঙ্গের, কিংবা রাঢ়বঙ্গের- এই স্থানিকতার আভা বিস্তর বঙ্গীয় সংঘসূত্রে নিপাট ধ্বস্ত হাহাকারযুক্ত ক্ষয়ে- চিরকালের চলিষ্ণু মানুষের পদচিহ্ন! যেখানে পার্টিশন-প্রপঞ্চ প্রভাবক, আর সে প্রভাবনা একালেও- এই অদ্যাবধি একেবারে। আরও কথককে কথার টানে চিহ্নিত করি, সামলাতে পারি না- যখন হাসান আজিজুল হকের (জ. ১৯৩৯) আগুনপাখি (১৯৯৫)’র কথন-প্রস্তাব দেখতে থাকি। এ এক আলাদা সুর। পরে দেখব এ বাংলার আরেক শক্তিশালী কথক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে (১৯৪৩-১৯৯৭)। সেখানে আরও কমিটেড ও কঠোর রক্তঝরা কথনবিন্দু শিল্পশক্তি নিয়ে তা কঠোর ও দৃঢ়তর।

দুই

রাঢ়বঙ্গের শিল্পী হাসান আজিজুল হক লেখেন : ‘আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরো বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর জায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আর আমি কি করব? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলাদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ। এর চেয়ে নির্মম মানবিক সত্য আর কি হতে পারে।’ [আগুনপাখি] অন্যস্বরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লেখেন : ‘গোলমালের আগে মেট্রিক পাস করলো। তহন তোমার দাদায় যায় ‘না, পাকিস্তানে ভর্তি করুম না, কলকাতায় পাঠায়া দেই, দিদির বাড়ি থাইকা কলেজে পড়বো।’ নয়টা মাস আগরতলা থাকলাম; দিদি না, জামাইবাবু না, কেউরে, ছায়াও দ্যাখলাম না। পাকিস্তান তো গেলো গিয়া’। আবার দেশভাগের ফলে নতুন স্বপ্নও দেখেছেন অন্য কোনো লেখক : ‘তখন সুবেহ সাদিক আলোয় পুব আকাশ আলোর বন্যায় নেয়ে উঠেছে, ঝলমল করে রেঙ্গে উঠেছে দিগন্ত। মনে মনে ভাবছি, ওই ওখানে ওই আলোর পারে সে দেশ- স্বপ্নের দেশ- সে আজাদ দেশ আমার। যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নাই, নাই অভুক্ত জন-মানব। গরিব কাঙ্গাল, রাজা-জমিদার সব সেখানে সমান, সব একই মানুষ!’ এভাবে নানাকৌণিক ভাবনার প্রচুর উদ্ধৃতি তুলে দেয়া যায়। সেটিই মূল কথা নয়, পার্টিশন যে একটি ‘প্রভাব’ সেটি নানাভাবে আবিষ্কার এবং তা জীবনের আবর্তসমেত অবমুক্ত করা অসম্ভব নয়, তা বিভিন্ন সময়ে নানা লেখকের রচনায় প্রকাশ হয়েছে। নামাঙ্করণ হয়েছে ‘সামনে নতুন দিন’ কিংবা ‘অনেক সূর্যের আশা’। এগুলো বেরয় পার্টিশন-উত্তর কালে, পূর্ব-বাংলায়। এগুলো লেখকের ‘স্বপ্ন’ধৃত শিরোনাম। স্বপ্নের ভেতরেই কলোনিয়াল, পোস্ট-কলোনিয়াল পুনর্গঠন নির্ণয়ন সম্ভব। বলতে চাই কথন তত্ত্বে। এইসব লেখককে একালের স্টাইলিস্টিক্স এড্রেসে। সেখানে শব্দ ‘সিমানটিক্সিটিক্যাল’ এ্যাপ্রোচে পুনর্গঠন করা অসম্ভব নয়। অর্থকে এক বাস্তবমুখীনতায় তৎপর করে তোলে ‘শৈলী’। পুনর্গঠন করে ‘ফর্ম’। তা দান করে উত্তর-উপনিবেশিক আখ্যা ও ব্যাখ্যা। হাসান আজিজুল হকের আত্মজা ও একটি করবী গাছে (১৯৬০) বলেন, আত্মজার যন্ত্রণাদগ্ধ অবস্থার কথা : ‘তোর বাপ কটো? এ্যাঁ, কটো বাপ? মা কটো? একটো তো? দ্যাশও তেমনি একটো।’- এই সত্যটি কীসের? আর তার ভাষাবুননি? ভাষার ভেতরের অর্থ? অসুবিধে হয় না পার্টিশানের ক্রিয়েশন কতদূর ভেতরে প্রোথিত, কিংবা কত নির্মম সত্যে তা পুনর্গঠিত- সেটি বুঝে নিতে। উদ্ধৃতি বাড়িয়ে লাভ নেই। বিশ্লেষণে খুঁজে নেয়া যেতে পারে, চরিত্রের বাস্তবতা। তাতে আত্মজা কিংবা ননী গোপাল কিংবা বাংলাদেশের লেখা চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৬) উপন্যাসে উন্মূল প্রোট্যাগনিস্ট ওসমান গণিসহ প্রত্যেককেই এক একটি প্রতীকী চরিত্র। তা সময়ের ও দেশভাগের। সেটি চিনে নিতে হয় এই একুশ শতকে। পুনঃপাঠের ভেতরে। তীক্ষ্ণ অনুভবে, নিঃশঙ্ক গহীন বাস্তবের আখরে। 

তিন

আমাদের আলোচনার কেন্দ্র : প্রকরণ বা ফর্ম- কথকের অবলম্বন, বিষয় যখন ‘পার্টিশন’। ফ্রেমে আঁটা জীবনের ছবি, সেটি সহজ-সারল্যের আখ্যান নয়। দুমড়ানো, কষ্টের হাহাকারের গড়া ইমেজ, গড়ানো-পেটানো সময়ের ফেড ছবি! ফ্যাকাশে, হলুদ, ক্লিশে জীবন। সে জীবনে চরিত্র দাঁড়াতে পারে না, তাতে মূল নেই- উন্মূল, শেকড়হীন, রিফিউজি- শরণার্থী ‘ব্যক্তি’। উপরে ছায়াশূন্য ভয়ঙ্কর ‘ছায়া’- সে ছায়ায় কোনো জীবন দেখা যায় না, নিদেনপক্ষে মৌল সব চাহিদা- তাও ‘সোনার হরিণ’- যেন পালিয়ে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়। এই প্রশ্নটি মানবতা ও মনুষ্যত্বকে কেন্দ্র করে ঠেলে দিল- উত্তর-উপনিবেশ (post-colonial) ধারণাটি। ধারণাটি আমরা আরোপ করতে চাই না। কিন্তু একালের সমীক্ষায় তলিয়ে দেখতে পারি। উপনিবেশ বা কলোনাইজার তো কলোনাইজদের ঠেলে ফেলে দিল, সবটুকু কেড়ে নিল- এমনকি মুখের ভাষাও। মনও। প্রান্তে ঠেলে দেওয়া জীবনের কী মন থাকে নিজের? থাকে না। সবটুকু পদ্ম-পাতার নীরে টলায়মান। অস্থির- এদিক-সেদিক। ফর্মটিও তেমন। পূর্ব-বঙ্গে তথা বাংলাদেশে লেখকদের হাতে এসব প্রশ্ন ভেতরে ভেতরে গড়ে ওঠে। স্বপ্নরেখাটি যেমন এক প্রকারে দূর থেকে দেখা যায়, কেউ কেউ দেখতে পায় আবার দেখতে দেখতেই মিলিয়ে যায়, পাকিস্তান কী কী দেবে করে, স্বপ্নাশা- পরে সবটুকু ফাঁকি, ফাঁকিস্তান আবার একই বিপরীতে হাহাকার, পদদলিত- অমানিষার ছায়ায় ঘেরা- ওই ভিটে, জমি, ভূমি, মানুষের কলারগ্রাসী কারুণ্য-জীবন। রবাহূতের অশনি ছায়া। পেছনের টান। পেছনের হাহাকার। সবটুকু হারানোর ক্লান্তি। জীবন নিয়েও এক অপ্রকাশের ভার, চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে পতিত জীবনের লেলিহান স্বাদ যেন। তো ফর্ম তো তেমনই হবে! কথক কোন স্টাইলে কথা বলবেন? রিয়েলিটি প্রকাশের শৈলিটি কেমন? এই উত্তর-উপনিবেশময় যে জীবন তার ফল কী? শুধুই কি কিছু প্রশ্ন আর জিজ্ঞাসা? কিন্তু জীবন এমন কেন? ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতি ঠিক এই র‌্যাডক্লিফের রেখায় বিভাজিত করে কী শান্তির সুখ পাওয়া গেল? ভূমি-ছাড়া, মাটি ছাড়া মানুষের থাকে কী? সে যেখানে পতিত হয়, সে পতন কী কোনো পুনর্বাসন? যদি তাকানো যায় ধুবুলিয়া ক্যাম্পের দিকে? কিংবা হিন্দু বা মুসলিমের আলাদা দেশের কথনে উঠে আসে আমার পূর্ব-পুরুষ বরিশাল কিংবা তার পূর্ব পুরুষ বারাসাত- কী তার অর্থায়ন? সে ফর্মে ভাষা কীভাবে সময়ের কথা বলবে? ‘একটিমাত্র দেশলাই কাঠি খরচ করলেই হু হু আগুন জ্বলবে, আগুন এগিয়ে যাবে ছাদে বরগায় শুকনো ধানের গোলায়- সরোজিনীর শুকনো হাড়ে। লাগিয়ে দিলে হয়, অম্বুজাক্ষ আবার ভাবলো, তারপর সরোজিনীকে জড়িয়ে ধরি, বুকে টেনে আনি- তারপর আমি, সরোজিনী, বাবা, সূর্য, বরুণ, কমল, ভ্যবলা, সবাই দাঁড়িয়ে থাকে, সর্বনাশ দেখি- শেষে ধ্বংস হয়ে যাই।’ (পরবাসী/ হাসান আজিজুল হক) এই কথক ফর্মে উত্তর-উপনিবেশ ধারণা কি সত্য হয়ে ওঠে না! ‘পার্টিশন’ বিষয়টিইবা কীভাবে নির্মমতার বাস্তবে দৃঢ়শীল হয়! সরোজিনীর জীবন কিংবা উন্মূল ওসমানের জীবন প্রায় একই দৃষ্টিকোণে (point of view) মোড়ানো। কথকের রঙ শুধু আলাদা। ইত্যাকাররূপে ফর্ম গড়ে ওঠে। সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর পৌঁছয়। স্মৃতি ও শ্রুতিও গ্রাস করে। ধরে দেয় তার ফর্ম। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র সেই তুলসী গাছের কাহিনিতে ‘তুলসী গাছ’। সে বাড়ে, যত্ন পায়, তাকে ঘিরে একবাড়ির কিছু উন্মূল মানুষের গল্প চলে। সেই গল্পের ভাষা, প্রতীকী তুলসী গাছটির কথা বলা, হারিয়ে যাওয়া অন্য পরিবারের হয়ে ততোধিক প্রশ্বাসের খবর দেওয়া, আবার সক্কলেই যখন পুলিশের কবলে পড়ে এই বাড়িটি ছাড়ছে- তখন তুলসী গাছ একা। যত্ন নেওয়া দূরের কথা, তার খবরও কেউ রাখেনি, মন থেকে ভুলে গেছে সবাই। তখন সে ঝিমোয়। মেসেজটি কী? স্মৃতিকণ্ঠী জীবনের কিছু মানুষের গৃহপ্রবেশ আবার গৃহত্যাগ কিংবা তাদের পূর্বের আরও পূর্বের কিংবা পরের সম্ভাব্য পরিণতি নির্মাণ করে ওই তুলসী গাছ। সে কিছু শেকড়ছাড়া মর্যাদাহীন, ভয়কাতুরে মানুষের সাক্ষী। এরকম আরেকটি সিরিয়াস গল্প খোঁয়ারি। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস খোঁয়ারির ঘোরে সমরজিৎকে পরিচয় করিয়ে দেন। পুরান ঢাকার একটি বহু পুরনো বাড়ি, সেখান থেকে সাতচল্লিশের পরে তাদের অবস্থান শিথিল হতে হতে একাত্তরের পরে আর থাকতে পারে না। ঠিক বিতাড়ন নয়, মাইনরিটি সাপ্রেশানের কারণে টেকা দায়। তখন সে খোঁয়ারিতে বলে : ‘বয়সের ভারবোধ তাকে একটু নীরব করে, কিংবা এই ক্লান্তির সুযোগে সে বাক্য গোছায়, কিন্তু ছিমছাম কথা তার মুখ পর্যন্ত আর আসে না, বলে, ‘কি কইছি? কইছি নিজেগো বসত- বাড়ি ভাড়া দিমু না, তো কি হইছে’? ‘নাঃ কি হইবো? সমরজিত খুব পরিণত দুঃখের হাসি ছাড়ে, ‘কি আর হইবো? মানুষ চিনো না, কারে কি কও’। ‘চিনুম না ক্যান, বেশি ছটফট করছে তো আছাদুল্লার পোলায়, খচ্চইরা ছ্যামরাটা। আসাদুল্লার বাপে, কত পইড়া রইছে এই বারান্দার মইদ্যে।’- অমৃতলাল আর সমজিতের কথনে আসাদুল্লার পোলার দাপট- বাড়িটা দখলে নেওয়ার জন্য। কিন্তু এ বাড়ি কতকালের, এই আসাদুল্লা তখন অমৃতলালের কাজ করে দিত, আশ্রয় পেত- আর এখন তারই দাপট! এভাবে পার্টিশনের ক্রিয়া ঘিরে ফেলে অত্যাচার ও নিপীড়নের অনুষঙ্গ হয়ে। সেটি অস্তিত্বের সংকটও। যা অস্তিত্বকেন্দ্রিক জিজ্ঞাসায় একালে তত্ত্বে প্রতিষ্ঠা করতে চাই মানবিক মূল্যবোধের নিরিখে- উত্তর-উপনিবেশ ভাবনায়। এরকম আরও অনেক গল্প লেখা হয়েছে। বঙ্গীয় অঞ্চলের একটি অংশ বাংলাদেশ। ‘বাংলাদেশ’ ভূগোলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের যে অস্তিত্বিক প্রকোপ সেটি উদ্বাস্তু জীবনই শুধু নয়, অসাম্য ও শ্রেণিগত ব্যবধানে; কিন্তু তার গোড়ার টানে বড় লেখকরা নিবিড় দৃষ্টিপাত প্রতিষ্ঠা করেছেন। ষাটে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, হাসান আজিজুল হক আর বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এ ছাড়া আরও অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু এই প্রধান লেখকগণের রচনায় কেন্দ্রীকতা গৃহীত হয়েছে পার্টিশনকে কেন্দ্র করে। তাদের গল্প-উপন্যাস নানাদিক স্পর্শ করেছে। জীবনের বিচিত্র অনুভব ছুঁয়েছে, আলিঙ্গন করেছে কষ্ট-বেদনা বা আনন্দের নানাবিধ দিক। কিন্তু মূল- ‘পার্টিশন’। বলতে চাই, পরিপ্রেক্ষিত তাদের পার্টিশন। সেটাই বহুমাত্রিক হয়ে বিচিত্র অভিমুখ অর্জন করেছে। তাই এই সিরিয়াস লেখকগণের ভাষায়- তথা কথনপ্রয়াসে গণ্য হয়েছে ‘বিবরণ’। সে বিবরণ- ন্যারেশন গড়ে দেয় বাস্তবতার প্রতীকী ইমেজ। সাহিত্য তো সেই শিল্পপ্রয়াস যা প্রস্তুত করে ইমেজের দাপট, চলচ্চিত্রায়ণ, সময়ের, কথকের, ভূগোলের এবং ওই পরিবেশের নৃ-ব্যবস্থাপনার। তার সমাজতত্ত্বটিও সেরূপেই বাঞ্ছিত। কথাগুলোর পেছনের সারসত্য এরকম : পশ্চিমবঙ্গের গোয়ালঘূর্ণি গ্রামের ওসমান, যে ইপিআরটিসির কর্মচারি হিসেবে ঢাকায় বাস করে এবং ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে যোগ দেয়। ক্রমশ মানসিক অস্থিরতায় সে হয়ে পড়ে সিজোফ্রেনিক। এর কারণ, সে উন্মূল চরিত্র। ঘুমঘোরে সে ছেড়ে আসা গ্রামের পিতার মৃত্যু সংবাদ শোনে, মায়ের বিলাপ কানে আসে- আর ক্রমশ একাকী হয়ে যায়। অবসাদে আক্রান্ত হয়। অন্য অনেক সমস্যা তাকে বিপর্যস্ত করে। এই বিপর্যস্ততার কেন্দ্র ‘পার্টিশন’। যদিও উপন্যাসের আখ্যানের মূল গতিস্রোত ঊনসত্তর অভিমুখি কিন্তু কেন্দ্রীয় চরিত্র উন্মূল ওসমান ব্যক্তিগতভাবে যে শূন্যতাক্রান্ত, বিবসাগ্রস্ত, ভীতগ্রস্ত ও মনঃপীড়ায় কাতর- তার কারণ শরণার্থী-সত্তা। এই শূন্যতাই তাকে ক্রমাগত সিজোফ্রেনিক সমস্যার দিকে নিয়ে গেছে। এরকম অস্তিত্বিক উন্মূলতার গল্প অনেক থাকলেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ নানাভাবে তার আখ্যানে পরোক্ষভাবে শারণার্থী-চেতনাকে কেন্দ্র করে তুলেছেন। উল্লেখ করেছি হাসান আজিজুল হকের এ চেতনায় বিক্ষত প্রত্যক্ষত কিছু রচনা। ব্যক্তিজীবনে রাঢ়বঙ্গের শেকড়চ্যূত এ লেখকের মর্মন্তুদ রচনা ‘আগুনপাখি’ ছাড়াও আছে ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’। অনেক গল্পেই- যেমন : ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘পরবাসী’, ‘খাঁচা’, ‘আবর্তের সম্মুখে’ কঠোর জীবনের ক্রন্দনধ্বনির আলেখ্যই নির্বিশেষে উৎকর্ণ হয়েছে, পাঠক সমীপে। এরকম লেখকদের সাহিত্যের ভাষাটি যেন গড়ে দিয়েছে পার্টিশন। এই পার্টিশনের ভেতর থেকেই পূর্ব-বাংলায় গড়ে ওঠা নগরে সদ্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম মধ্যবিত্ত মননে গড়ে উঠেছে বিকলাঙ্গ পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতর থেকে নতুনরূপে বাঁচার আকাক্সক্ষী ‘স্বপ্ন’। যদিও আবু ইসহাক (১৯২২-২০০৩) সূর্য-দীঘল বাড়ি (১৯৫৫) উপন্যাসে লিখেছেন- তার নায়িকা জয়গুণ ‘ভোট ও ভাতের যুদ্ধে হেরে গেল।’ আবার ‘সামনে নতুন দিন’ কিংবা ‘নোঙ্গর’ উপন্যাসে দেখা যায় নায়ক পাকিস্তানে নোঙ্গর করেছে- নতুন স্বপ্ন কাঁধে নিয়ে। আর সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮-১৯৮৬) অনেক সূর্যের আশা উপন্যাসে প্রতীকায়িত করছেন পাকিস্তানকে ‘অনেক সূর্য’ অভিধায়। পূর্ব বাংলায় এইসব স্বপ্নকাতর ‘মুসলিম’ লেখকরা পাকিস্তানকে একটি আশার আলোয় শিল্পায়িত করেছেন, যেখানে দেখা যায় ছিচল্লিশের দাঙ্গার পর, কলকাতা শহর থেকে তারা ফিরে আসছেন ঢাকায়। নতুন জীবন, নতুন রাষ্ট্রের প্রত্যাশায়। অস্তিত্বের যেন নতুন অনুসন্ধান। পার্টিশনের পর পরই কলকাতা-ফেরত মুসলিম লেখককুল এরকম স্বপ্নসাধ্য নিয়ে উত্তর-উপনিবেশকৃত সাধারণ ধারণা থেকে মূলত নব্য আর একটি উপনিবেশের খপ্পরে পড়ে। এবং সেটি দ্রুতই সত্য হয়ে ওঠে। স্বপ্নও অপসৃত হয়, খুব তাড়াতাড়ি। বিভাগোত্তর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই সে আশাভঙ্গের দোলায় নিপতিত হয় পূর্ব-বঙ্গের মানুষ। ওইসব লেখকরাও বিষয় পাল্টান। ফিরে আসেন সংগ্রাম ও দ্বন্দ্বমুখর জঙ্গমী জনজীবনে। কিন্তু বড় ও প্রসিদ্ধ লেখকরা পূর্ণায়ত জীবনমুখি হয়েই পার্টিশনকে চিরায়ত জীবনের রূপরেখায় বন্দী করেন। তাদের শিল্প-নির্ধারিত ভাষাশৈলিও গড়ে ওঠে তেমন প্রস্তরের ভেতর দিয়েই। কার্যত সত্তর বছর পরও বাংলাদেশের সাহিত্য পার্টিশনের সেই স্মৃতি ও শ্রুতির রেখা থেকে দূরবর্তী নয়। বরঞ্চ তার ভেতর থেকেই গড়ে উঠছে নানাকৌণিক জীবনের আখ্যানতত্ত্ব ও তথ্যের সীমানায়। 

চার

‘মুষ্টিমেয় কিছু আলোচনাকারী ও আলোচনার টেবিল, যেখানে ওপর তলার কিছু মানুষ বাঙলার শহর ও পল্লির লক্ষ লক্ষ লোকের ভাগ্য নিয়ে খেলা করেছে- সেখান থেকে অনেক দূরত্ব বজায় রেখে প্রদেশের ওপর ভিত্তি করে এই ঐতিহাসিক অনুসন্ধানটি সম্পন্ন করা হয়েছে। এখান থেকেই মূলত প্রদেশ-বিভাগের সপক্ষের শক্তি আন্দোলন পরিচালনা করে এবং এর ফলে দুর্দৈবে অভ্যস্ত এই প্রদেশটিতে যে নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয় ঘটে তা এখানকার সবাইকে ভোগ করতে হয়।’ (জয়া চ্যাটার্জি) এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রস্তাব থাকতে পারে। এবং সেটি অমূলক বলা যাবে না। আগেই বলেছি, পার্টিশন একটি ‘প্রপঞ্চ’। সুতরাং এ নিয়ে কথন নানা রকমের হবে, সন্দেহ নেই। বিচিত্র মাত্রিকতা গড়ে উঠবে। বিশেষত, ওই রেশ এখনো যখন ফুরোয়নি! বরং নতুনরূপে দানা বাঁধে। ফলে কথন পাল্টাবে, বক্তব্য রচিত হবে, দৃষ্টিকোণ বহুস্তরিক সীমা অধিকার করবে, তা আর নতুন কী! ফলে কথাকাররা পেরুবেন অনেক পথ। আখ্যানতত্ত্বে নতুন স্রোত কায়েম হবে, প্রমিত ভাষায় আসবে নতুন অর্থব্যাখ্যা। সেখানে কথাকারের কাজও হবে নতুন। ক্রিয়াও হবে সমস্যাজর্জর, স্মৃতিতাড়িত। বিপরীত প্রতিক্রয়াও গড়ে উঠবে; বিশেষত, এই একুশ শতকে। সুতরাং ‘পার্টিশন ভিউজ’ নতুন ‘পাখা’ অর্জন করবে, তার সমস্ত বাস্তবতাকে অন্তর্লীন করেই। তাতেও মানবিক দায়বোধ ও কর্তব্যবোধের নতুন রেখা তৈরি হতে বাধ্য। গড়ে উঠবে- শ্রেয়তর নতুন এলাকা, অন্তর পূর্ণ আপামর মানুষের জন্য। কথাসাহিত্যিক তখন আর গড়পড়তা থাকবেন না। তিনিই ঘুরে দাঁড়ান, তারই পরিস্রুত শব্দরাজীতে। যে শব্দরাজীর ভেতর ইমেজ আর চিত্রকল্পের সমকালিক গতিবিধির সম্ভাব্য পরিলেখ গড়ে ওঠে। বৈষম্যহীন, শ্রেণিহীনতা, বর্ণবাদমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, সেক্যুলার জনপদই তাতে প্রত্যাশিত হয়, পার্টিশনের স্মৃতিকে কেন্দ্রীকরণ করে। ঔপন্যাসিক বা গল্পকার তাই-ই বলবেন। মানুষ ও মনুষ্যত্বকে ফিরিয়ে শ্রেয়তর সত্যে একপ্রকার নির্মেদ জীবনেরই জয়গান তুলে ধরবেন, প্রচার করবেন। তাতেই তো লেখকের সার্থকতা! সেটি দেখা যাচ্ছে। সেজন্যই এই আলোচনার সঙ্গত কেন্দ্র ‘পার্টিশন’। অনিঃশেষ বিষয় হয়েছে এই পার্টিশন, আজ সত্তর বছর পরেও। কথাসাহিত্যে বিশেষ করে তার রূপরেখা চিহ্নিত হচ্ছে, নতুন করে, নতুন সম্ভাব্য চেতনায়। সে সার্থকতা বা সাফল্য তো আছেই কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা করপোরেট পৃথিবীতে প্রতিরোধ করতে, গড়পড়তা মানুষ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে এরকম কাজের শক্তি পুনরুদ্ধার করা। সেটি কথকরা কতটা করতে পারছেন, এক্ষণের প্রস্তাবনা- তা চিহ্নিত করাও জরুরি। শুধু তেলে মাথায় তেল দেয়া নয়, তাতে পণ্য ও পুঁজির সাগরেদরা আরও ফুয়েল পায়, আম্বানী-রুপার্ট মারডকরা দলে দলে এক হয়ে সাম্রাজ্যবাদের পসার জেঁকে বসান, মিডিয়া মোগলরা তা অধিক প্রচার করে সাধারণ মানুষদের ধাঁধিয়ে দিতে থাকবে, তখন উচ্চনিচু ফারাক আর শোষণের ত্রিশূল কতটা চক্রবৃদ্ধির স্বরূপ পাবে- তা অনুমান করা কঠিন। তাই ‘একজন’ হয়ে (একজনই বহুজন- বহুজন থেকে বহুদিকের সম্প্রসারণ) ওই বিপরীত শক্তির সম্ভাবনার কথা বলতেই হবে। লেখকই তা পারেন এবং পারবেন। বড় বড় লেখকরা পেরেছেনও। দস্তভস্কি, রবীন্দ্রনাথ এমন চিরকালের উদাহরণ। একালেও লেখকরা আছেন। ফলে পাটিশনের ট্রিটমেন্ট এখন অন্য পর্যায় থেকে আমলে নেয়ার পরিসর তৈরি হয়েছে। অন্তত, এই সত্তর বছর পর। আর এ কাজে ত্যাগ, হারানো শোক খোঁজাই মূল কথা নয়। ফিরিয়ে আনতে হবে মানবিক জীবন। মানুষের সামগ্রিক সর্বৈব চিহ্নিত সত্তার মূল্যবোধের সংজ্ঞার্থটি জরুরি। তবেই তা প্রয়োজনের শিল্প হয়ে ধরা দেবে। আখ্যানতত্ত্বেও তখন তৈরি হবে নতুন নিশানা। সাম্প্রতিক সময়ে উপন্যাসতাত্ত্বিক দেবেশ রায় এমন কথাই বলেছেন। এ সূত্রটি আমাদের লেখকদের আরও এগিয়ে নেবে। তবেই এখনকার ‘পার্টিশন’-আলোচনা বিষয় ও বিষয়ীর ফলপ্রসূ পারম্পর্যতা অর্জনে সক্ষম হবে। 

পাঁচ

সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে পার্টিশন নিয়ে যে কাজ, তাতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই সবচেয়ে আধুনিক। আমরা পার্টিশনকে কেন্দ্র করে যে মানুষের উপলব্ধ-ধারণা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তাতে তিনিই সবেচেয়ে বেশি অগ্রগামী। যে পাঠটি আখ্যানতত্ত্বে গৃহীত সেখানে বিবরণের দর্শনটি তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেছেন- বিশেষত ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ বা ‘খোঁয়ারি’র মতো গল্পে। যা তার অন্য রচনাগুলোতেও নানাভাবে পরোক্ষ পরিসর খুঁজেছে। তবে এমন ধরনের কাজ আরও এগোবে। পশ্চিবঙ্গের লেখকরা (রবিশংকর বল প্রমুখ পর্যন্ত) ইতিমধ্যেই বেশ এগিয়েছেন, প্রতিরোধ সেখানে বেশি- সেখানকার বাস্তবতায়। বাংলাদেশের বাস্তবতা বিগত পঞ্চাশ বছরে নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা। কারণ, সে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে ভিন্নতর সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। তবুও গ্লোবাল বিশ্বে কিছুই বিচ্ছিন্ন নয়। সে সারসত্য ও বাস্তবতা এখন এক লক্ষ্যাভিসারী। অন্তত বাংলা ভাষার বাঙালিদের ক্ষেত্রে। সংস্কারমুক্ত হয়ে আমাদের সেটি স্বীকার করতেই হবে। তবে আলাদা ভূখ-েও রচিত হোক পার্টিশনের মতো একটি বিষয়- যা অভিন্ন জ্ঞান-ধারণার ভেতর দিয়ে পুঁজি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নতুন ব্যক্তিমানুষ সৃষ্টির বার্তা বহন করবে, অপরাপর শৈলীতে, অভিনব সৃষ্টিশীলতায়। একুশ শতকের বিশ্বে এর বিকল্প আমরা কী ভাবতে পারি! কথাটি মজবুত বিশ্বাসে আস্থায় নেই দেবেশ রায়ের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে : ‘আমরা সফল হব কী না তা নির্ভর করে আমাদের লেখকদের আত্মবিশ্বাস, সম্মানবোধ ও শিল্পজ্ঞানের ওপর। রবার্ট ক্লাইভ যখন মুর্শিদাবাদে ঢোকেন তখন রাস্তার পাশে যত লোক দাঁড়িয়ে দেখছিল তারা প্রত্যেকে একটি করে ঢিল ছুড়লে সসৈন্য ক্লাইভ মারা পড়ত। টেকনোলজির আক্রমণ সেই আক্রমণের চাইতেও ভয়ঙ্কর। শিল্পসাহিত্যের বেলায় ভয়ঙ্করতর।’ পার্টিশন সেভাবেই আগামীর লেখালেখিতে প্রসিদ্ধকাম হবে কারও না কারও নেতৃত্বে। এবং সেটি অবশ্যই কোনো না কোনো শিল্পী বা লেখক নেতৃত্ব। কারণ পার্টিশন সেরকমই একটি প্রপঞ্চ যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম নানাভাবে বহন করে চলেছে। প্রসঙ্গপানে তা হবে যখন আরও প্রাসঙ্গিক- তখন এই নির্মম বাস্তবতাটি আর একাকী থাকবে না; অনেককেই আগ্রহী করে তুলবে- অনেককে ভাবাবে এবং গোটা মানবসমাজ সে শৈল্পিক প্রত্যক্ষতায় নির্বিবাদে সবকিছু পায়ে দলে সম্মুখে এগোবে, সন্দেহ নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //