দুর্বল রাজনীতি ফ্রাংকেনস্টাইন আমলাতন্ত্র

একের পর এক ঘটনায় সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা। তবে কোনো ভালো কারণে নয়, বরং নেতিবাচক ঘটনায়। 

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে এরকমই একটি খবরের শিরোনাম- ‘এক উপসচিবের বিরুদ্ধেই এক ডজন জিডি।’ খবরে বলা হয়, লোকমান আহমেদ নামে একজন উপসচিব থাকেন রাজধানীর বেইলি রোডের সরকারি অফিসার্স কোয়ার্টারে; কিন্তু তার ভয়ে অন্য বাসিন্দারা তটস্থ। নিরাপত্তাহীনতার কথা জানিয়ে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার চেয়ে এরই মধ্যে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেকে। এর মধ্যে রয়েছেন যুগ্ম সচিব, চিকিৎসক, ম্যাজিস্ট্রেট, অধ্যক্ষের মতো পদস্থ লোকজন। তার বিরুদ্ধে এরই মধ্যে যেসব জিডি করা হয়েছে, সেখানে এমনও অভিযোগ করা হয়েছে যে, তিনি সব সময় দা, লাঠি, ক্রিকেট ব্যাট হাতে কোয়ার্টার এলাকায় ঘোরাঘুরি করেন। এসব কারণে কোয়ার্টারের শিশু-কিশোররা নাকি অনেক সময় বাসা থেকে নিচে নামতে ভয় পায়।

প্রশ্ন হলো, একজন উপসচিব কী করে এমন ভয়াবহ হতে পারেন? এসব ঘটনার যদি অর্ধেকও সত্য হয়, তাহলে তার চাকরি থাকার কথা নয়। তিনি কী করে টিকে আছেন? তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর কি সঠিক তদন্ত হয়েছে? মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদের অসুস্থ মায়ের চিকিৎসায় ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব পালন বিষয়েও একটি খবর সম্প্রতি গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হয়। মায়ের প্রতি এমন নিবেদিতপ্রাণ সন্তানই আমাদের কাম্য; কিন্তু প্রশ্ন হলো, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের মায়ের চিকিৎসায় কি এরকম ব্যবস্থা আছে? নাকি যে সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের পয়সায় সচিবদের বেতন হয়, সেসব লোকের মায়েদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের বারান্দায় বারান্দায় দৌড়াতে হবে; একটা কেবিনের জন্য বা একটা সিটের জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকতে হবে! বাস্তবতা হলো, ২৪ কর্মচারী দূরে থাক, সরকারি হাসপাতালে পয়সা না দিলে একজন নার্স বা আয়ার কাছ থেকেও কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না। 

লোকমান আহমেদ বা রওনক মাহমুদের চেয়েও বড় পদের একজন কর্মকর্তা, পানি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবীর বিন আনোয়ার। তিনিও নানা সময়ে গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন। খবরে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে বহাল থেকেই তিনি তার এলাকায় ‘রাজনৈতিক শোডাউন’ করেছেন। কয়েকশ’ মোটরবাইক এবং কমপক্ষে ৪০টি গাড়ির বহর নিয়ে পুরো সিরাজগঞ্জে তিনি যে শোডাউন করেছেন, তা নিয়ে খোদ প্রশাসনেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই বিব্রত বলেও খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায়ও তাকে নিয়ে অনেক ধরনের তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি তিনি একটি রিসোর্টে অস্ত্র পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন- এমন একটি ছবিও দেখা যাচ্ছে। যদিও এই ছবিটা সত্য নাকি বানানো, তা নিশ্চিত নয় বা এই ছবির বিষয়ে তার কোনো বক্তব্যও গণমাধ্যমে আসেনি। 

সরকারের এই পদস্থ আমলাকে নিয়ে একটি সংবাদপত্রের শিরোনাম- ‘মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাসীন এক সচিব!’ শোনা যায়, তিনি প্রশাসনিক কাজে যতটা না, তার চেয়ে বেশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজে বেশি সময় ব্যয় করেন। ভবিষ্যতে তিনি সংসদ সদস্য হতে চান বলে এখনই মাঠ প্রস্তুতের কাজ করছেন- এমন গুঞ্জনও রয়েছে।

সরকারি চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরে অনেকেই রাজনীতিতে আসেন। এটি দেশের প্রচলিত আইনে কোনো বাধা নয়; কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকারি চাকরিতে বহাল থেকে কেউ রাজনৈতিক শোডাউন বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারেন কি না? এই সিনিয়র সচিবের বিষয়ে যেসব খবর গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসেছে, সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কি নিরপেক্ষ তদন্ত করে দেখেছে?

অস্বীকার করার উপায় নেই, সব সরকারের আমলেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের কিছু আমলা অতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তাদের কথাবার্তা ও আচার-আচরণ মাঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতাদেরও ছাড়িয়ে যায়। তারা এসব করেন মূলত ব্যক্তিস্বার্থে। কোনো দল বা দলের আদর্শের প্রতি অনুগত হয়ে নয়। বরং সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুখের ভাষায় বদলে যায়। কিছুদিন আগেই যে দলের স্তুতি গাইতে গিয়ে মুখে ফেনা তুলেছেন, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সেই দলের নেতাদের জেলে ঢোকানোর সমস্ত আয়োজন সুনিপুণভাবে করেন। তারপর তারা মোটা অংকের পেনশন নিয়ে অবসরে যান। কেউ কেউ সরকারের কোনো প্রকল্পের বড় দায়িত্বে বসেন। অনেকে পরিবারের সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার কোনো দেশে গিয়ে স্থায়ী হন। আবার দেশে থাকলেও আরাম-আয়েশের শেষ নেই। অনেকে রাজনীতিতে জড়িয়ে মন্ত্রী-এমপি হন; কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকারের সমস্ত কর্মকাণ্ডে অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতার সমালোচনা শুধু সরকারের বিরোধী শিবির থেকেই নয়, বরং সরকারের ভেতর থেকেও হচ্ছে।

গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সরকারের অতিমাত্রায় আমলা নির্ভরতার সমালোচনা করেন। তার সঙ্গে একই সুরে কথা বলেন আরও একাধিক সংসদ সদস্য; যার নেপথ্যে রয়েছে করোনা সংক্রমণ ও ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ে ৬৪ জেলায় একজন করে সচিবকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি।

স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে এক শোকসভায় তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ‘রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই।’ একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘বর্তমান রাজনীতি লুটেরাদের হাতে। আজকের রাজনীতি এমন সব বড়লোকের হাতে, যারা এ দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা করে না।’ 

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনিও বলেন, ‘আগে রাজনীতিবিদেরা রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। আর এখন রাষ্ট্রযন্ত্র জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করছে।’

সিনিয়র রাজনীতিবিদ ও এমপিদের এসব বক্তব্য এবং মানসিক যাতনায় এটি স্পষ্ট যে, তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় নিজেদের অবহেলিত বা বঞ্চিত মনে করছেন; কিন্তু এ প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই যে, সরকার কেন এভাবে অতিমাত্রায় আমলানির্ভর হয়ে গেল বা তাদের ভাষায় কেন রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতছাড়া হয়ে গেল? এখানে তাদের নিজেদের কোনো দায় নেই? এর কিছুটা উত্তর দিয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। 

সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে তিনি লিখেছেন, সংসদ সদস্যদের অদক্ষতার জন্যই আমলারা তাদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ পেয়েছেন। তাছাড়া নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া তথা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য আমলাতন্ত্রের অপব্যবহারকেও অনেকে দায়ী করেন। অর্থাৎ রাজনীতিবিদরা এখন আমলানির্ভরতার যে সমালোচনা করছেন, সেই সমালোচনার তীর কি তাদের নিজেদেরই বিদ্ধ করছে না?

সম্প্রতি আমলাতন্ত্র নিয়ে রসিকতার ছলে একটি নির্মম মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেছেন, ‘আমলাতন্ত্র সব সময়ই থাকবে। ফেরাউনও অত্যন্ত শক্তিশালী শাসক ছিলেন। তিনিও আমলাতন্ত্রের বাইরে যেতে পারেননি। আমলাতন্ত্রের বিকল্প বের করতে পারেননি। সোভিয়েতরা চেষ্টা করে বের করতে পারেননি। চীনারাও বের করতে পারেননি। এমনকি খলিফারাও বের করতে পারেননি।’ 

এই আইনপ্রণেতা আরও বলেন, ‘দেশে অসৎ আমলা, অসৎ ব্যবসায়ী এবং অসৎ কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদের সমন্বয়ে যে সিন্ডিকেট হয়েছে, এটি অত্যন্ত শক্তিশালী। এদের কাছে প্রধানমন্ত্রী জিম্মি, মন্ত্রিপরিষদ জিম্মি, সংসদ জিম্মি, এমপিরা জিম্মি এবং সর্বোপরি জনগণও জিম্মি।’

আমলাদের মধ্যে, বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনের কর্মচারীদের মধ্যে ‘স্যার’ ও ‘ভাই’ সম্বোধন ইস্যুতে এমন সব ঘটনা ঘটছে, যা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়, বরং এই ঘটনাগুলো আমাদের যে মূল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে তা হলো, সংবিধানের ভাষায় যে জনগণ প্রজাতন্ত্রের মালিক এবং যাদের করের পয়সায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন হয়, সেই জনগণই কেন তাদের সেবক সরকারি কর্মচারীদের ‘স্যার’ সম্বোধন করবেন?

অনেক সময় সরকারের আচরণেও মনে হয়, তারা বুঝি গণকর্মচারীদের কাছে জিম্মি। বিশেষ করে প্রতি বছর যখন ডিসি সম্মেলন হয়, তখন সেখানে ডিসিরা যেসব দাবি-দাওয়া তোলেন (এমনকি তারা বিচারিক ক্ষমতাও চান) তাতে মনে হয়, রাজনীতিবিদরা নন, বরং দেশটা আমলারাই চালান।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //