নাসিরুদ্দিন শাহরা ভাঁড়ে পরিণত হবেন

ভারতের নাসিরুদ্দিন শাহরা অবুঝের মতো কথা বলছেন। তারা ভারতের রাজনীতি না নিজের ধর্ম- কোনটার সংস্কার চান, সেটাই পরিষ্কার নন। তিনি যে ধারণা দিয়েছেন তা কংগ্রেস-প্রগতিবাদীদের রাজনীতি; যা এখন পরাজিত ও মৃত। জন্ম থেকেই তিন দেশ ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে এটাই অশান্ত ও দুর্বল করে রেখেছে।

কংগ্রেস-প্রগতিবাদীদের রাজনীতি ভারতেই আজ মৃত। কংগ্রেসের মুছে যাওয়া আর বিজেপির দু’বার বিজয়ই এর প্রমাণ। হিন্দুত্ববাদের বিজেপি হয়ত আবার জিতবে বা জিতবে না, কিন্তু কংগ্রেসের রাজনীতি শেষ ও বিলুপ্ত, এটা আর ফিরে আসবে না, তা আমার কথা নয়। গত নির্বাচনে রাহুল গান্ধী নিজেই সফট হিন্দুত্ববাদের পক্ষে ভোট চেয়ে তা প্রমাণ করেছেন। ভারতে প্রধান দুই দলের এখন একটাই রাজনীতি- হিন্দুত্ববাদ। 

কংগ্রেসের পতন হয়েছে আর হিন্দুত্ববাদ বা হিন্দুজাতিবাদ উদাম হয়ে বিজেপি নামে ক্ষমতাসীন। অথচ নাসিরুদ্দিনরা যা নাই, যা মৃত, সেই কংগ্রেস-প্রগতিবাদীদের অলীক সেক্যুলার ভারতে ফেরার দাবি করছেন! গত কয়েকদিন তার ফেসবুক ইউটিউবে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু বক্তব্য প্রচার করছেন সেই পরিপ্রেক্ষিতেই আজকের লেখার প্রসঙ্গ। 

মনে রাখতে হবে, রামমোহনের ব্রাহ্ম সমাজেরই পরিণতি হলো- এক হিন্দুজাতি রাষ্ট্র, হিন্দু নেশন স্টেটের ধারণা কল্পনা। এরই বাস্তব রূপ হলো ১৮৮৫ সালে জন্ম নেয়া প্রথম ব্রিটিশ অনুমোদিত রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ বা সংক্ষেপে কংগ্রেস। বলাই বাহুল্য অবিভক্ত ভারতে হিন্দুদের যদি হিন্দুজাতি রাষ্ট্র বা হিন্দুত্ববাদ গড়ার দিকে ঠেলে দেয়া হয়, তবে এটাই আসলে মুসলমানদেরও তাদের জাতিবাদের দিকে ঠেলে দেয়া হবে...

আফগানিস্তানের কাবুলে গত ২০ বছরের পশ্চিমা জবরদখলের সমাপ্তি ও তালেবান ক্ষমতা দখল শুধু পশ্চিমা দেশ ও জোটকেও নয়, এশিয়ার ভারতকেও প্রভাবিত করেছে ও ক্রমেই অস্থির হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ইতিমধ্যে আরএসএস-বিজেপির মোদি সরকার আট বছরে পা দিয়েছে। লাগাতার ইসলামবিদ্বেষ ও মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোই যাদের ভোট পাবার কৌশল ও রাজনীতি। সঙ্গে এটাও প্রমাণিত যে তাদের নির্বাচন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্ট এই হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে উঠে দাড়ানো ও কনস্টিটিউশনালি বাধা দেবার মুরোদ রাখে না। এরা বলতেই পারেনি, এই হিন্দুত্ববাদ কনস্টিটিউশনের চোখে অবৈধ, ভারত-রাষ্ট্র এটা সমর্থন করতে পারে না। এর এক নম্বর কারণ হলো, এতে ভারত এক চরমতম নাগরিক বৈষম্যের দেশ হিসেবে হাজির হচ্ছে। অথচ ভারতের কনস্টিটিউশনাল প্রতিষ্ঠানগুলো যেন মোদির হিন্দুত্ববাদের পক্ষে সাফাই ন্যায্যতা সরবরাহদাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্টা কোনো কোনো চিফ জাস্টিস মোদির সঙ্গে ‘ডিল’ করেছেন এমন অভিযোগও আছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে, ফল হয়নি। 

আমাদের এই উপমহাদেশে প্রগতিবাদীরা দুটি শব্দ-ধারণা ব্যবহার করে থাকেন ‘সেক্যুলার’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’। প্রথমত এই শব্দ দুটির বাড়তি ব্যবহার প্রমাণ করে যে ‘আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র’ সম্পর্কে কোনো মৌলিক ধারণা তাদের নাই। অথচ কোনো কনস্টিটিউশনে ‘সেক্যুলার’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ শব্দদুটি না থাকলেও ওই রিপাবলিক রাষ্ট্র এক আদর্শ রাষ্ট্র হতে পারে। রাষ্ট্রে নাগরিক মাত্রই সমান, এই সমান অধিকারে ‘সাম্য’ বৈশিষ্টের রাষ্ট্র হওয়া সম্ভব। দুই, তারা মূলত কায়েম করতে চেয়েছিল এক হিন্দু-আধিপত্যের রাষ্ট্র, ফলে অসাম্য অধিকারের এক হিন্দুজাতি রাষ্ট্র বা হিন্দু নেশন স্টেট। 

অবিভক্ত বাংলার ভাষায় বললে, এটাই জমিদার-হিন্দুর আধিপত্যের হিন্দুজাতি রাষ্ট্রর কল্পনা, যা আসলে একই সঙ্গে বাঙালি বলতে মুসলমানরা বাঙালি নয় দাবি করে। এতে এরা বরং পুরনো বর্ণপ্রথা মানে হিন্দু জাতপ্রথাটাকেই ফিরে ভাল করে জমিদারদের হাত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে, এটাই ব্রাহ্মণ্য-শ্রেষ্ঠত্ববাদ বা ব্রাহ্মণ্যবাদ। অথচ এই হিন্দুজাতি রাষ্ট্রের ধারণাটাকেই তারা প্রগতিবাদী এবং ‘সেক্যুলার’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলে ট্যাগ লাগিয়ে পেশ করে থাকে। 

মূলত অবিভক্ত ভারতে উনিশ শতকের শুরু থেকেই সুনির্দিষ্ট করে ১৮১৫ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই উপমহাদেশে কখনো আধুনিক রাষ্ট্র ও ‘অধিকারভিত্তিক রিপাবলিক রাষ্ট্র’ ধারণাগুলো আসেনি; কিন্তু কেন সুনির্দিষ্ট ১৮১৫ সাল? কারণ ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া আমলের অবিভক্ত ভারতে বাংলার রাজা রামমোহন রায় প্রথম ‘রাষ্ট্র ও রাজনীতি’ ধারণাটি নিয়ে আসেন। তিনি ‘আত্মীয়-সভা’ নামে নিয়মিত আলোচনা চর্চার আসর শুরু করেছিলেন ১৮১৫ সালে। এছাড়া ১৯৩৫ সালের কমিউনিস্ট নেতৃত্বে থাকা সেক্রেটারি পিসি জোশী ও ইতিহাসের প্রফেসর ড. সুশোভন সরকারের চোখে রামমোহন ছিলেন ‘বাংলায় রেনেসাঁ’ আনার নায়ক। 

অবিভক্ত ভারতে কোনো কিছুকে ‘বাংলায় প্রথম’ বলে দেখালে এর অর্থ করতে হবে সেটি ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াতেও প্রথম। কারণ কলকাতার ‘ফোর্ট উইলিয়াম’ ছিল ব্রিটিশ কলোনি শাসকের হেড কোয়ার্টার। সেই কলকাতাকে রাজধানী করে তারা ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া শাসন করত। ফলে কেবলমাত্র বাংলা প্রেসিডেন্সিই সবচেয়ে বেশি ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এসেছিল। আর এখান থেকে রামমোহনের মাধ্যমে ইউরোপের রেনেসাঁর ধারণাও, বাংলার ভেতর দিয়ে সারা ব্রিটিশ-ইন্ডিয়াতে ছড়িয়েছিল। 

তবে সতর্ক থাকা ভালো যে, তাহলে ১৮১৫ সালের আগে কি ‘রাষ্ট্র ও রাজনীতি’ ধারণা আমাদের ছিল না? এক কথায় জবাব- হ্যাঁ, একেবারেই ছিল না। আর এক বাক্যের ব্যাখ্যা হলো, মোঘল আমলে মানে যা এক সম্রাট-সাম্রাজ্যের আমল, এটাই মূলত এক রাজতন্ত্র বা মোনার্কি শাসন ব্যবস্থা। আর রাজতন্ত্রে কোনো রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলের ধারণা থাকে না, থাকতে পারে না।  

এখন অবিভক্ত ভারতের যারা কমিউনিস্ট, প্রগতিশীল, বা ‘সেক্যুলার’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ বলে নিজেকে মনে করতেন আর এখন যারা তাদের পূর্বসূরি মানেন এরা সকলে একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজে দেখতে পারেন, প্রশ্নটা হলো- একদিকে তারা মনে করেন রাষ্ট্র থেকে ধর্ম আলাদা করতে হবে, এটা তাদের আধুনিক রাষ্ট্র বোঝার প্রধান ও কেন্দ্রীয় পয়েন্ট। তাহলে এই প্রশ্নের জবাব দিন- কমিউনিস্টদের চোখে যে রামমোহন বাঙ্গলায় রেনেসাঁ আনার আদিগুরু, সেই রামমোহন ১৮১৫ সালে নিজেই সবকিছুর আগে ব্রাহ্ম নামে এক নতুন ধর্ম ও ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ চালু করেছিলেন কেন?

কেন? কারণ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ- এই তিন দেশের প্রগতিবাদীরা মনে করেন রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা রাখতে পারলেই তাদের অলীক কল্পনার ‘সেক্যুলার’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ এক কাম্য রাষ্ট্র হবে। 

মনে রাখতে হবে, রামমোহনের ব্রাহ্ম সমাজেরই পরিণতি হলো- এক হিন্দুজাতি রাষ্ট্র, হিন্দু নেশন স্টেটের ধারণা কল্পনা। এরই বাস্তব রূপ হলো ১৮৮৫ সালে জন্ম নেওয়া প্রথম ব্রিটিশ অনুমোদিত রাজনৈতিক দল ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ বা সংক্ষেপে কংগ্রেস। 

বলাই বাহুল্য অবিভক্ত ভারতে হিন্দুদের যদি হিন্দুজাতি রাষ্ট্র বা হিন্দুত্ববাদ গড়ার দিকে ঠেলে দেয়া হয়, তবে এটাই আসলে মুসলমানদেরকেও তাদের জাতিবাদের দিকে ঠেলে দেয়া হবে। হয়েছেও তাই। কংগ্রেসের জন্মের ২০ বছরের মধ্যে মুসলিম লীগ বলে আলাদা দল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। যা পরে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করেছিল। পববর্তীতে কংগ্রেস তো বটেই বিশেষত কমিউনিস্টরা ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ার জন্য জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের ওপর সবদোষ চাপিয়ে প্রপাগান্ডা করে চলেছে। অথচ সবার আগে হিন্দুজাতি রাষ্ট্রের ভারতের কল্পনা ও এর ভিত্তিতে কংগ্রেসের জন্ম তারা দিয়েছে, এই খবর তারা লুকিয়ে রাখে। 

আমাদের আদিপাপ বা সমস্যা হলো, রামমোহনের মাথায় যে আধুনিক রাষ্ট্র কল্পনা সেটা ছিল এক জাতিরাষ্ট্রের কল্পনা। যেখানে আবার জাতি মানে ধর্মীয় জাতি; কিন্তু সেকালের ভারত হিন্দু-মুসলমান ধর্মের ভারত আর অসংখ্য জাতে বিভক্ত হিন্দু ধর্ম বলে আগে তিনি এক নতুন ব্রাহ্ম ধর্ম চালু আর তাতে সবাইকে দীক্ষিত করে এরপর এক ব্রাহ্ম ধর্মীয় ভারত জাতিরাষ্ট্র ছিল তার কল্পনা; কিন্তু ১৮৭২ সালের মধ্যে ব্রাহ্ম সমাজ তিন টুকরো হয়ে যায়। আর তাতে পরবর্তীতে বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের হাত ধরে ব্রাহ্মের বদলে হিন্দুজাতি রাষ্ট্রের ধারণা তারা প্রবল করেন। এই আইডিয়াতেই ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্ম হয়েছিল। 

তাহলে একালে নাসিরুদ্দিনরা কী চাইছেন? তারা বলছেন তাদেরকে ওই হিন্দুজাতিবাদের কংগ্রেসের সরকার বা জমানাটা ফিরে এনে দিতে, যে হিন্দুজাতিবাদের কংগ্রেস চেহারা লুকাতে ‘সেক্যুলার’ ও ‘অসাম্প্রদায়িক’ জামা গায়ে দিয়ে ঘুরত। আমরা নাসিরুদ্দিনদের খুশি করতে এখন চাইলেও সেই কংগ্রেসকে ফিরে আনতে পারব না। কারণ সে মৃত আর সে জায়গায় স্বরূপে আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদ কায়েম হয়েছে। কংগ্রেস আর জাগবে না। সে ইতিমধ্যে সফট হিন্দুত্ববাদে চলে গেছে। 

আসলে নাসিরুদ্দিনদের খেয়াল করলে দেখতেন তারা আসলে কংগ্রেসের হিন্দুজাতি ধারণার ভেতরে যে মার্জিনালাইজও চাপা পরে থাকা (কথিত সেক্যুলার) ‘মুসলমান’ ধারণা তৈরি হয়েছিল সেখানে ফেরত যেতে চাইছেন। কিন্তু সেটা তো নিজগুণেই এখন মৃত! অথচ মিছাই বুঝেছি ভাব ধরে বলছেন- তারা ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ চান না। অথচ ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ তো দেউলিয়া পশ্চিমের এক অস্পষ্ট রাষ্ট্র ধারণা, যা একটা সোনার-পাথরের বাটির মতো ধারণা। তাই, নাসিরুদ্দিনদের জন্য অপেক্ষা করছে এক করুণ পরিণতি! ১৯৪৮ সালে খুন হবার আগে গান্ধীর পরিণতি এমনটাই হয়েছিল। তিনি তখন দাঙ্গায় অস্থির অসহায় হয়ে শেষে দুই ধর্মকে এক হতে বলতেন। অর্থাৎ রাজনীতি না, ধর্মকেই বদলাতে হবে! এক হতে হবে এমন দাবি! 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //