অতিমারিতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ও জরুরি কিছু বিষয়

এ মুহূর্তে আপাত এক স্বস্তির খবর এই যে, অনেক প্রতীক্ষার পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলারও উদ্যোগ-আয়োজন চলছে।

আশা করা যায়, অক্টোবর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ চালু হবে। শঙ্কা নিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে সন্দেহ নেই। যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্রসহ কিছু কিছু দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর করোনা সংক্রমণ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে নতুন বিপত্তি দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কীভাবে টিকাদান কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা যায়, তা নিয়েও গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বোঝা যায় অচিরেই শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রম শুরু করা যাবে। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর আমাদের এখানে সংক্রমণের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সে ব্যাপারে এখনি নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও, এটা স্পষ্ট যে, আমাদেরও বেশ একটা লম্বা সময় সংক্রমণের এই ওঠা-নামার মধ্য দিয়েই যেতে হবে, সংক্রমণ যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। এ বছরের মধ্যে ১০/১১ কোটি মানুষকে টিকা প্রদানসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ, বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও শিক্ষকদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে পাঠদান করা গেলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখা কঠিন হবে না। আর অনির্দিষ্টকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখারও অবকাশ নেই। গত দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তার অভিঘাত এখনো পুরোপুরি বোঝা যাবে না। এই নেতিবাচক অভিঘাতের পুরোটা বুঝতে হয়তো পাঁচ/দশ বছরও লেগে যেতে পারে। বাস্তবে শিক্ষার্থীদের গোটা একটা প্রজন্মের জীবন থেকে প্রায় দুই বছর হারিয়ে গেছে। এই হারানো সময় কীভাবে ফিরিয়ে আনা যাবে, এই ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে আনা যাবে- এখন সেটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পাঠদান পদ্ধতি, সিলেবাস ও প্রচলিত শিক্ষা কার্যক্রমে কীভাবে গুণগত রূপান্তর আনা যাবে, জরুরি ভিত্তিতে এই ব্যাপারে মনোযোগ দেওয়া দরকার। 

করোনার এই দুর্যোগে বড় সংকট তৈরি হয়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের এক উল্লেখযোগ্য অংশের ঝরে পড়ায়। ইউনেস্কো করোনা অতিমারির কারণে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের এই সংখ্যা কত, তা নির্দিষ্টভাবে জানতে হয়তো আরও সময় লাগবে; কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, এই অতিমারি ও সরকারের অদূরদর্শিতায় এখানে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ঝরে পড়েছে। গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, করোনার এই দুর্যোগে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, শিশুশ্রমও বেড়েছে। অনেককে অসময়ে, অকালে শিক্ষাজীবন চুকিয়ে দিয়ে বাধ্য হয়ে নানা ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ও কষ্টকর পেশায় যুক্ত হতে হয়েছে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কয়েকজন শিশু শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর জানা যায়। পরিবারের নিদারুণ আর্থিক কষ্টের কারণে এই শিশুদের কারখানায় কাজ নিতে হয়েছিল। অনুমান করা কঠিন নয় যে, নানাভাবে ঝরেপড়ার এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। 

ঝরেপড়া এই শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে ফিরিয়ে আনা এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সবার এখন এটা মনোযোগের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত। 

এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সরকারের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল; কিন্তু করোনার দীর্ঘ ১৮ মাসে এই ব্যাপারে সরকার, বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কোনো মনোযোগ দেখা যায়নি। বলা হচ্ছে করোনা দুর্যোগ সামাল দিতে সরকার ইতিমধ্যে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা সহায়তা দিয়েছে। এর বড় অংশই পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। প্রণোদোনার প্যাকেজ বরাদ্দ দেখেও রাষ্ট্র আর সরকারে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পর্কে খানিকটা অনুমান করা যায়। শিক্ষা খাত এই প্রণোদনায় পুরোপুরি উপেক্ষিত। অথচ প্রতিদিন শুনতে হয় ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। দুর্যোগকালে এই মেরুদণ্ড ঠিক রাখার ব্যবস্থা কি! প্রকৃত প্রস্তাবে অভাবি ও স্বল্পআয়ের পরিবারসমূহের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিকল্পিতভাবে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা গেলে লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে ঝরেপড়া থেকে রক্ষা করা যেত। এটা কি খুব কঠিন কাজ ছিল, না। তাহলে এই ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভাবি পরিবারসমূহ কেন প্রণোদনা সহযোগিতায় অগ্রাধিকারে এলো না, কারা এই জরুরি প্রশ্নের উত্তর দেবেন, বোঝা মুশকিল। 

এই অতিমারিতে হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন, অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কোচিং সেন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণে নতুন করে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যাও বেড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান আবার চালু করা যাবে কি-না, তারা ন্যূনতম কোনো আর্থিক সাহায্য পাবে কি-না তাও অনিশ্চিত; কিন্তু এসব বিষয় এখন সরকারের বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।

সম্প্রতি সরকার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পাঠদান, সিলেবাস, পরীক্ষা পদ্ধতি ও বিভাগ নির্বাচন সংক্রান্ত প্রচলিত পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসার ঘোষণা দিয়েছে। এটাকে বহুল প্রতীক্ষিত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই পদক্ষেপের ইতিবাচক দিক সম্পর্কে সম্যক জানতে-বুঝতে হয়তো আরও সময় লাগবে; কিন্তু যেটা আরও জরুরি তা হচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের শিক্ষা দর্শন কী হবে, বাংলাদেশে কি একইসঙ্গে পাঁচ/ছয় পদ্ধতির শিক্ষা পদ্ধতি চলতে থাকবে, শিক্ষার সুযোগ অধিকার না হয়ে কি আর ১০টি বেচাকেনার পণ্যের মতো বাণিজ্যিক ও মুনাফাকেন্দ্রিক পণ্য হয়ে থাকবে? জাতীয় পর্যায়ে এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলির যৌক্তিক মীমাংসা ব্যতিরেকে নতুন উদ্যোগসমূহ আখেরে বড় কোনো ফল দেবে না। কারণ বিদ্যমান অসম ও বৈষম্যমূলক শিক্ষা পদ্ধতি সামাজিক অসাম্য ও বৈষম্য কেবল আরও বাড়িয়ে তুলছে। আবার অন্যদিকে সামাজিক বৈষম্যও শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য প্রকট করে তুলছে। 

আর আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে বাস্তবে নৈতিক শিক্ষা বলে সিলেবাসে কিছু নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রমেরও কোনো বিকল্প নেই। এসব বিষয়ে গভীর মনোনিবেশ ও অগ্রাধিকার ছাড়া শিক্ষা ব্যবস্থার বিদ্যমান অচলায়তন থেকে বেরিয়ে আসার অবকাশ নেই।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী, ওয়ার্কার্স পার্টি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //