দেশভাগ ও প্রাসঙ্গিক কথকতা

প্রথম কাশ্মীরে যাওয়া এখনো মনে আছে। সে একটা বলার মতো কাহিনিই বটে। সবে সবে সাংবাদিকতা করছি। কলকাতার এক জনপ্রিয় সাপ্তাহিকে লিখি। সম্পাদক দুম করে বলে বসলেন পরশু তোমাকে কাশ্মীর যেতে হবে। আমি বলছি ১৯৭৮ সালের কথা। সেবার কলকাতায় বিপুল বন্যা। সারাশহর জলেজলময়। রাস্তা দিয়ে নৌকা চলছে। অধিকাংশ রেলপথ জলে ডুবে গেছে বলে বেশিরভাগ ট্রেনও বন্ধ। সপ্তাহে একদিন পাঠানকোর্ট অবধি জম্মু তাওয়াই যাচ্ছে। তখন গা দিয়ে পুরোপুরি কলেজের গন্ধ যায়নি। সম্পাদক স্বয়ং ডেকে এমন এক গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন, তা না করার প্রশ্নই ওঠে না। মা একটু কিন্তু কিন্তু করলেন। আমি ওসবে কান না দিয়ে রওনা হলাম কাশ্মীরের পথে। তখনো কিন্তু কাশ্মীর চমৎকার শান্ত। ট্যুরিস্টদের স্বর্গ। তাকে নিয়ে বাঙালিদের যত আলোচনা সবটুকুই শ্রীনগর, ডাললেক, চিনারের সারি আর বেশ কয়েক মাইল দূরের পহেলগাঁও, ইত্যাদি। কাশ্মীরের বাতাসে তখনো কোথাও কোনো বারুদের গন্ধ নেই। কোথাও মিলিটারি বুটের কর্কশ আওয়াজ শোনা যায় না। লালচক, নিশাদবাগ যেখানেই যান দলবেঁধে বঙ্গ সন্তানদের অসম্ভব ভুল হিন্দিতে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে দেখবেন। 

জম্মু এক্সপ্রেস নামেই। এ এক্কেবারে মালগাড়ির চেয়েও ঢিমেতালে চলছে। অজুহাত অবশ্য একটা আছে। তা হলো বৃষ্টিতে লাইন খারাপ। পাঠানকোর্ট নামতেই চোখে পড়ে নেতাজী সুভাষ ভোজনালয়। ভারতের যে কোনো শহর মফস্বলে গান্ধীজী, আম্বেদকর ও নেতাজীর স্ট্যাচু আপনি পাবেনই। তবে পাঞ্জাব পাঠানকোর্ট অমৃতসর, ভাতিন্দা সব জায়গায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি একটু বেশি পক্ষপাত আপনার চোখ এড়াবে না। উত্তর-পূর্ব ভারতের আনাচে-কানাচে বা দক্ষিণভারতেও নেতাজী জনপ্রিয়তায় গান্ধীজীকে সমানে টেক্কা দিয়েছেন। জওহরলাল নেহরু বা লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মূর্তি কিন্তু তুলনায় কম। বরং ঢের বেশি পরবর্তী সময়ে ইন্দিরা ও রাজীব গান্ধীর স্ট্যাচু। তখন খেয়াল করিনি এখন বোঝার চেষ্টা করি যে এই মূর্তি দৃশ্যমান হওয়ার পেছনেও আছে রাজনীতি। গান্ধী জাতির জনক। তার ওপর হিন্দু মহাসভা সমর্থক নাথুরাম গডসের হাতে খুন হয়েছেন, ফলে চরম দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে কোণঠাসা করতে গান্ধী আইকনকে ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের দরকার ছিল। নেতাজী তার ক্যারিশমাটিক ইমেজের জন্য জনমনে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছিলেন। অদ্ভুতভাবে গুজরাট ছাড়া আর কোথাও নেই এদেশের ‘লৌহমানব সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল’। অথচ বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা। তবু তিনি সেভাবে বিজ্ঞাপিত হননি কেন তা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা তোলা দরকার। আসলে ভারতের এই গোটা রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত না বুঝলে আপনি আজকের কাশ্মীর বা উত্তর পূর্ব ভারতের সংঘাত অসন্তোষ কিছুই বুঝতে পারবেন না। মূর্তিতো এক একটা প্রতীক মাত্র। পেছনে রয়েছে মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব, যা দেশের রাজনীতি অর্থনীতি এবং অবশ্যই সমাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা পাবার দিন থেকেই।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে মুখে যাই বলুন না কেন, বল্লভ ভাই প্যাটেলের দৃষ্টিভঙ্গি বরাবরই চরম দক্ষিণপন্থী। আজকের ভারতে তাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির আইকন প্যাটেল। গান্ধী নন। নন আম্বেদকরও। মনুবাদী ভারত আজ নেহরুর আপাত ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ক্রমেই গণতন্ত্রের বদলে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে। আপনার মনে হতে পারে কাশ্মীর নিয়ে লিখতে লিখতে এমন মনুবাদ-টনুবাদ নিয়ে বকছিলেন! আসলে কোনো কিছু আলাদা নয়। ইতিহাসের নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে না জানা অনেক তথ্য এমনভাবে ঢুকে পড়বে, যা কাশ্মীর কেনো গোটা উপমহাদেশের অনেক চেনা পাঠকেই বদলে দিতে পারে। এই স্ট্যাচু বিন্যাসের দিকে তাকালে যেমন বোঝা যায় ধর্ম নিরপেক্ষ ভারত কীভাবে সংঘপরিবারের হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে উঠছে। কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ঘটা করে রামমন্দিরের শিলান্যাস বা নানা নতুন নতুন আইন করে বিরোধী শক্তিকে দমন করা, সব একসূত্রে বাঁধা। ১৯৯০ সালে লাল কৃষ্ণ আদবানির রামরথ যাত্রার মধ্যে দিয়ে যার সূচনা। ’৯২-এ ঐতিহাসিক অনুপম স্থাপত্য বাবরি ভাঙা তা আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। ২০০২ এর গুজরাত গণহত্যার পর তার প্রকাশ্যে অনুমোদন এবং আজ খুল্লামখুল্লা রণহুঙ্কারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করে তোলা। ১৯২৫-এ রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা সংক্ষেপে আর এস এসের জন্মলগ্নে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সংঘ চালকরা, যা আর এসএসের লিখিত এজেন্ডায় ঘোষণা তাই এত বছর পরে বাস্তবে হতে চলেছে। নিঃসন্দেহে তার পেছনে মূল কৃতিত্ব হিন্দু হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্র ভাই মোদি ও দোর্দণ্ড প্রতাপ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শার। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করতে কাশ্মীরকে নানা অজুহাতে জেলখানা করতে হবে। গুজরাতে জেনোসাইড বা গণহত্যা জরুরি। জয়শ্রী রাম না বল্লে পিটিয়ে হত্যা করে সবক শেখানোর চেষ্টা হবে। এভাবেই একুশ শতকের ভারত পৌঁছে যাবে প্রাচীন অন্ধকার সময়ে। বহুত্ববাদী ভারত হয়ে উঠবে একমাত্রিক হিন্দু রাষ্ট্র। 

এ লেখা আপনি রিপোর্টাজ, ভ্রমণকাহিনি বা আদ্যন্ত ইতিহাসের এক কঠিন সময়কে ফিরে দেখা যা খুশি নাম দিতে পারেন। দীর্ঘ এই ধারাবাহিক কাশ্মীর কথনে শুধু কাশ্মীর নয় মাঝে-মধ্যেই ঘুরে ফিরে আসবে দেশভাগের আখ্যান, জিন্নাহ বনাম ভারতীয় জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্ব, একদা শের-ই কাশ্মীর শেখ আবদুল্লার আপোষহীন লড়াই অগ্রজ আখ্যান। বিস্তারিতভাবে বলব রাষ্ট্র কীভাবে সারাকাশ্মীরকে এক মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করেছে। কত কত ঘটনা যা বাইরের পৃথিবীর কাছে আমাদের শাসকরা চেপে রাখে। জানি না এ লেখা আমি শেষ করতে পারব কি-না। এখন এ ধরনের লেখা এদেশে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’। তবু ইতিহাস সমাজবিজ্ঞানের এক সাধারণ ছাত্র হিসেবে আজকের কাশ্মীরের আসল ছবিটা তুলে ধরতে চেষ্টা করব। পাঠানকোর্ট হয়ে জম্মু। সেখান থেকে ভোর ভোর বেরিয়ে সোজা সাধারণ এক বাসে শ্রীনগর। হয়তো ক্লান্ত ছিলাম বলেই প্রথম দর্শনে শ্রীনগর খুব একটা ভালো লাগেনি। কেমন যেন রুক্ষ। ধূসর। কাগজ বলে দিয়েছে যে প্রথম তিন দিন জাতীয় গেমস কভার করতে হবে। পরে অবশ্যই ওখানকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ইন্টারভিউ নিতে হবে। ছাপোষা একটা হোটেলে উঠলাম। গালভরা নাম জার্নালিস্ট। পকেট প্রায় ফাঁকা। কাউকেই চিনি না। অভিজ্ঞতাও নেই। কীভাবে কাজ শুরু করব তাইই জানি না, যা হোক তবু প্রথম তিন দিন খেলা নিয়ে কাজকর্ম মোটামুটি চলে গেল। রাজনীতি বিট কি হবে তা নিয়ে পড়লাম মহা দুঃশ্চিন্তায়। সেজন্যই কিনা জানি না সে রাতে আচমকাই ধুম জ্বর এলো। পরের দিন সকালে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লাম আমার বন্ধু মুদাসরের হাঁকডাকে। ওকে তখন দেবদূত মনে হচ্ছিল। কীভাবে ও খবর পেয়ে এলো তা আজও রহস্যময়। মুদাসরের সঙ্গে আলাপ কলকাতায়। ও ব্যবসার কাজে প্রায়ই শ্রীনগর কলকাতা করে। সমবয়সী। ফলে কীভাবে যেন আলাপ হতেই বন্ধু হয়ে গেল তাড়াতাড়ি। সেই মুদাসরকে আমি ভুলেই গেছিলাম। ও কোত্থেকে খবর পেয়ে ঠিক চলে এসেছে। এসেই হুকুম করল, ‘ব্যাগ গুছিয়ে হোটেল থেকে এখন সোজা আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। মা বলে দিয়েছে তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে।’ 

কলকাতার কিছু কিছু এলাকা থাকে যেখানে গেলে প্রথম দর্শনে মনে হবে এ ঠিক চেনা কলকাতা নয়। ইলিয়ট রোড, মার্কুইস স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট এরকম আরও অপরিচিত জনপদের অলিগলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনি কল্পনায় এক একশ’ বছরের শহরে পৌঁছে যাবেন। সম্পূর্ণ কসমোপলিটন বা মিশ্র জনবসতির এই এলাকায় মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি পাবেন আংলো ইন্ডিয়ান, ইহুদি ও চীনে সম্প্রদায়ের লোকজনকেও। এখানে বাড়ি ঘরের স্থাপত্য গড়পরতা শহরের মতো নয়। লম্বা বারান্দায় ঝারোখা বা কারুকাজ দেখলে বোঝা যায় যে এখানে এই শহরে একদিন প্রবল উপস্থিতি ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠীর। বললাম বটে কিছু কিছু এলাকা, আসলে কলকাতা সত্যি কথা বলতে কি একদিন মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রাধান্য ছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট, উপমহাদেশের জনবিন্যাস কতটা বদলে গেছিল তা বুঝতে আপনি অলিগলি ঘুরে বেড়ান। 

এটা খুবই দুঃখের যে দেশভাগ বা বাংলা ভাগের পর ওপার বাংলার ছিন্নমূল মানুষজনের কথা নিয়ে এপারে যত সাহিত্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, তার সিকির সিকিও হয়নি মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিয়ে। এটা ধরেই নেওয়া হয়েছে যে অধিকাংশ মুসলিম ওপারে চলে গেছিলেন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে। ফলে তাদের দীর্ঘশ্বাসের কোন আখ্যান লেখা তত জরুরি নয়। বাস্তবের ছবিটা অত সরল নয়। পুরনো দিনের ম্যাপ যদি দেখেন বা এখনও বেঁচে আছেন প্রাচীন কোন বয়োবৃদ্ধকে যদি পান, তাহলে বুঝতে পারবেন যে এ শহর থেকে কিভাবে উচ্ছেদ হতে হয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনকে। ৪৭এ যতটুকু যা হয়েছে তার তিনগুণ হয়েছে পঞ্চাশের দশকে ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ‘শত্রু’ বিবেচনায় প্রতিপক্ষ নিরীহ একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ওপর হামলার মধ্যে দিয়ে। টালা থেকে টালিগঞ্জ, শ্যামবাজার থেকে ঢাকুরিয়া, মানিকতলা, বাগমারি, বেলেঘাটা, ধর্মতলা, কুঁদঘাট, লেকটাউন, লেকগার্ডেন্স, যাদবপুর যেখানেই যান না কেন- একটু আধটু খোঁজ খবর নিলে জানতে পারবেন দেশভাগের আগে এই বিস্তীর্ণ এলাকায় হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানের বাসও ছিল সমানে সমানে। অনেক জায়গায় একটু বেশিই। এখন সেসব অতীত। যেতে যেতে চোখে পড়বে পরিত্যক্ত মসজিদ। সারা গায়ে অজস্র বটের ঝুড়ি নেমেছে। ইট খসে পড়েছে। কে বলবে একদিন এখানে মানুষজনের ভিড় ছিল। দরগার জমি দখল করে বাড়ি উঠেছে। একরের পর একর ওয়াকফ সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম ঢাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্যরা মাঝে-মধ্যে ছুটে আসেন হারিয়ে যাওয়া প্রিয় এক সদস্যের কবর খুঁজতে। 

কলকাতার বিদগ্ধ মহলের আলোচনায় প্রায়ই শুনতাম মুসলিম ঘেটোর কাহিনি। বলা হয়-ওরা সবাই এক জায়গায় সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে ভালোবাসে। মূল স্রোতে মিশতে চায় না। পারেও না। ফলে রাজাবাজার, মেটেবুরুজ, গার্ডেনরিচ, পার্কসার্কাস বা খিদিরপুর, মোমিনপুরের বাইরে কোনো মুসলিম জনবসতি চোখে পড়বে না। এটা একটা বিষয়। পাশাপাশি ‘মুসলিম ঘেটো’ নিয়ে ‘শিক্ষিত’ উচ্চ বর্গের বাবু ভদ্দরলোকদের মধ্যে নাক সিঁটকানো কম নেই। ভদ্রলোক মনে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা মানেই অপরাধপ্রবণ অঞ্চল। এভাবেই ’৪৭-পরবর্তী কলকাতা পুরোপুরি ভাগ হয়ে গেছে ওরা আর আমরায়। দেশভাগ নিয়ে চর্চা শুরুর পরে চেনা যাবতীয় বইপত্তরে এই বিপুল বদলে যাওয়া জনবিন্যাসের পেছনের কারণ খুব একটা খুঁজে পেলাম না। সাহিত্যেও উল্টো দিক নিয়ে লেখালেখি প্রচুর। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে বা কেয়াপাতার নৌকা পড়তে পড়তে আমরা স্বজন ব্যথায় কাতর হই। ঋত্বিক ঘটকের ছবি দেখতে দেখতে মন খারাপ হয়ে যায় উদ্বাস্তু যন্ত্রণায়। আমরা ফিরেও তাকাই না চিৎপুরের ধূসর বিবর্ণ, মোগল স্থাপত্যের শেষ চিহ্ন বশরি শাহ মসজিদ। শ্যামবাজারে একদা গমগমে মুসলিম বসতি। রিপন স্ট্রিটের আজাদ পত্রিকার অফিস।

আমরা বলি বটে দেশভাগের পেছনে একমাত্র কারণ ধর্মীয় বিভাজন। মুসলিম লীগ ও তার নেতা মহম্মদ আলি জিন্নার অবিমৃষ্যকারিতা ও একগুঁয়ে আচরণ। বাস্তবে এই একমাত্রিক কারণ ছাড়াও অর্থনীতির এক বড় ভূমিকা ছিল। বিড়লা ও অন্যান্য পুঁজিপতি হিন্দু জনগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় ধরেই স্রেফ একচেটিয়া বাজার দখলের স্বার্থে বঙ্গভঙ্গের আওয়াজ তুলছিল। দেশভাগের অন্যতম দ্বন্দ্ব ছিল রাষ্ট্রীয়চরিত্র ফেডারেল না অতিকেন্দ্রিক হবে তাই নিয়ে। কংগ্রেসের মধ্যে যে হিন্দুত্ববাদী অংশ এবং আর এসএস ও হিন্দু মহাসভার পৃষ্ঠপোষক ছিল বিড়লা ও অন্যান্য শিল্প গোষ্ঠীর। ফেডারেল কাঠামো হলে তাদের ভয় ছিল নব্য শিল্পপতি ইস্পাহানিদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হবে। ১৯০৫ সালে যে হিন্দু জমিদার ও ‘আলোকিত’ অংশ বঙ্গ ভঙ্গের বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছিল। ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে তারাই ১৯৪৭এ বাংলা ভাগে প্রবল ভূমিকা নিল। ভাগাভাগির প্যাটার্ন লক্ষ্য করলে বোঝা যায় প্রভাবশালী হিন্দু গোষ্ঠী চেয়েছিল যেনতেন প্রকারে তাদের শাসনাধীন জনপদে মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা। বিখ্যাত গবেষক জয়া চ্যাটার্জি লিখেছেন, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের মুসলিমদের মধ্যে বাঙলার মুসলিম ছিলেন তিনজনের মধ্যে একজন। যারা নতুন বাংলা চেয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম জনসংখ্যা কমিয়ে আনা। তবু ঘটনাচক্রে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লাখ মুসলিম থেকে যান। দেশভাগের পরে রাতারাতি মুসলিমদের অবস্থা ভয়ংকরভাবে পাল্টে গেল। অথচ ’৪৭-এর আগের দশ বছর অখণ্ড বাংলার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল মুসলমানদের ওপর। এমনকি হিন্দু প্রভাবাধীন এলাকাতেও সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবনে মুসলিম অধিকার নিশ্চিত ছিল। আচমকাই দেশভাগের পর মুসলমান সম্প্রদায় সবদিক দিয়েই সম্পুর্ন কোণঠাসা হয়ে পড়ল। ওপারের হিন্দুদের দেশত্যাগ ছিল অনেকটাই দাঙ্গার কারণে দলবদ্ধভাবে। ফলে তা নিয়ে সোরগোল হয়েছিল বেশি। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন সীমান্ত অতিক্রম করে অনেক বছর ধরে। কখনো ব্যাপকভাবে হলেও অনেক সময় আবার ধীরে ধীরে। গোপনে। যদিও বেশিসংখ্যক মুসলিম সীমান্ত পার হয়েছিলেন বাধ্য হয়ে। দাঙ্গার আগুনে সর্বস্বান্ত হয়ে। ১৯৫০ সালে নদীয়ায় সবচেয়ে বেশি মুসলমান একসঙ্গে বসতভিটে ছাড়তে বাধ্য হন। 

৪৭ সালের পরে পরেই যে হিন্দু উদ্বাস্তু নদীয়ায় আসেন, মূলত তাদের প্রতিহিংসার রাজনীতি ১৯৫০এ এক থেকে দুলাখ মুসলিম নর-নারীকে সীমান্তের ওপারে যেতে বাধ্য করে। মনে হচ্ছে নদীয়ার গ্রাম, রহমতপুরে একবার শুটিং করতে গিয়েছিলাম। সেখানে বহু পুরনো এক মসজিদের ছবি তুলছি। ভাঙ্গা জীর্ণ মসজিদ চত্বরে ঘুঘু চড়ছে। ঠুকঠুক করতে করতে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে এক বৃদ্ধ এসে হাজির। কত কথা, কত স্মৃতি। একসময় এই তল্লাটে শুধুই ছিল মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস। এখনো মনে আছে তখন কত ছোট আমি। শেষবারের মতো নামাজ পড়ার পরে আমার আপনজনরা সবাই একে একে সীমান্ত পেরিয়ে ওপারের কুষ্টিয়ার দিকে চলে গেল। আব্বা কিছুতেই গেলেন না। বললেন, দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না। সেই থেকে শুধু আমরা, একটি পরিবার এখানে এখনো টিকে আছি। অত বড় মসজিদ চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেল। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড় অংশ দেশভাগের আগে ছিলেন শহরের বাসিন্দা। এখন ছবিটি পুরোপুরি বদলে গেছে। ভারতের একমাত্র রাজ্য এই বঙ্গ, যেখানে অধিকাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস গ্রামে। কলকাতার মুসলিমরাও পুশব্যাকের দৌলতে কোনোরকমে সংলগ্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামভাঙ্গড়, হাড়োয়া, বেড়াচাপা, ক্যানিং, দেগঙ্গা সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে। 

গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হওয়ার পেছনে আর একটি কারণ নিঃসন্দেহে ইসলামফোবিয়া বা বিদ্বেষ। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছে মুসলিম সম্প্রদায়ের গ্রহণ ও বিশ্বাসযোগ্যতা এতটাই কম যে এখনো কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য শহরে বাড়ি কেনা ও ভাড়া পাওয়া বেশ কঠিন। ফলে একসঙ্গে থাকা যা চিহ্নিত হয়ে আছে সংঙ্কীর্ণ মুসলিম ঘেটো হিসেবে তা মোটেও শখ নয়। অনেকটাই নিতান্তই বাধ্য হয়ে। নদীয়া থেকে সবচেয়ে বড় সংখ্যক মুসলমান দেশভাগ করতে বাধ্য হলেও অন্যান্য জেলাও খুব পিছিয়ে ছিল না। নদীয়ার পরের স্থানটিই কলকাতা। অথচ এই শহরে মুসলিম সুপ্রিমেসি দীর্ঘদিনের। ব্রিটিশদের যে একাধিক ইমারত তার অধিকাংশ জমিই ছিল মুসলিম ওয়াকফ বোর্ডের। কলুটোলার কাছে ছিল কাজীর বিচারালয়। এ দেশে সুপ্রিম কোর্টের আগে কাজীর বিচারই ছিল সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়। সীমান্তের বিভিন্ন জেলা পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, মালদা চব্বিশ পরগনা থেকেও বড়সংখ্যক মুসলমান ওপারে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। বর্ধমান, হুগলিও ৪৭-এর পরে নিরাপদ ছিল না। মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিমকেও ভয়ংকর দাঙ্গার শিকার হয়ে ঢাকায় চলে যেতে হয়েছিল। বিশিষ্ট সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকও রাজশাহী গেলেন বর্ধমান থেকে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে আমাদের সব ইন্টেলেকচুয়ালেরা তাদের দেশভাগ চর্চায় কখনো মুখ খোলেন না তা আবারও মনে করিয়ে দেব। কয়েক বছরের মধ্যে শহর এলাকা থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো কমে যায় কলকাতায়। মোট জনসংখ্যার অর্ধেক কলকাতা থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়। এই সংখ্যাটি নদীয়ায় চার ভাগের তিনভাগ। জলপাইগুড়ি শহরে নব্বই শতাংশের বেশি। সোজা কথা দেশভাগের পরে সারা রাজ্যেই শহরে মুসলিম উপস্থিতি বিপুল কমে গেল। ১৯৩১ থেকে ১৯৫২ সাল অবধি নাগরিক মুসলমানের হার ছিল মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। মোটামুটি ষাট সাল অবধি ছবিটা এক থাকলেও, ’৬৪/৬৫-এর পাকিস্তান যুদ্ধের আগে পরে পরিস্থিতি খারাপ হতে হতে ১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শহরে মুসলিম জনসংখ্যা এসে দাঁড়ায় দশজনে একজন মাত্র। ওই বছরের আদমশুমারিতে স্বীকার করা হয় যে পশ্চিমবঙ্গের সবকটি পৌর এলাকায়, বিশেষ করে কলকাতা ও আশপাশের এলাকায়, হুগলি নদীর পশ্চিম তীরের শহরগুলোতে জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ধর্ম বিভাজন এলাকার জনবিন্যাস পুরো পাল্টে দিয়েছে। সেইসঙ্গে বদলে গেছে স্থানীয় অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতিও। অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের অধিকাংশই এদেশে থাকা আর নিরাপদ মনে না হওয়ায় পূর্ব বাংলার পথে পা বাড়ালেন। এপারে যে বিরাটসংখ্যক মুসলিম থেকে গেলেন তারা নিতান্তই গরিব। তাদের সেরকম আর্থিক সামর্থ্য বা যোগাযোগ ছিল না যে ওপারে গিয়ে থিতু হতে পারবে। দেশভাগের পর যেসব মুসলিম এপারে থাকলেন তাদের দীর্ঘ সময় ধরে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা সয়ে টিকে থাকতে হয়েছে। তখন পশ্চিমবঙ্গে পরিবেশ ছিল চরম মুসলিমবিরোধী। ফলে মুসলিম সম্প্রদায়ের এগিয়ে থাকা অংশ বুঝে গেলেন যে এদেশে থাকতে গেলে নিঃশর্ত সমর্পণ ছাড়া উপায় নেই। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে লক্ষ্ণৌ এ এক মুসলিম কনফারেন্সে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করতে গিয়ে অধিকাংশ মুসলিম নেতা সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন যে, এই মুহূর্তে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেওয়াই সঠিক পথ। সেই থেকে দীর্ঘদিন কংগ্রেসের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সম্পর্ক গভীর ছিল। এখনো নানারকম পরিবর্তনের পরেও মালদা মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ভোট রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রভাব যথেষ্ট। 

ষাট-সত্তর দশকের পর থেকে মুসলিম শ্রমজীবী অংশের বড় দলের সমর্থন বাড়তে থাকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি। সাতাত্তর সালে বামপন্থীরা এ রাজ্যের ক্ষমতা দখলের পেছনে গরিব কৃষকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনাচক্রে তাদের বড় অংশই মুসলিম। বামদের নীতি আদর্শ থেকে সরে আসা ভালোভাবে নেয়নি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন। ফলে ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত হয়। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি পরিবেশ দেশভাগের সময়ের মতো। নব্য হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি সমুদ্রের শক্তিশালী ঢেউয়ের মতো মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। খোদ শাসক দলের নেতারা প্রকাশ্যে খোলাখুলিভাবে অত্যন্ত কুৎসিত ভাষায় একটি সম্প্রদায়কে যেভাবে আক্রমণ করছে, তা যে কোনো শুভ বুদ্ধির লোকের কাছেই যথেষ্ট নিন্দের। ছুতো নাতায় মুসলিমদের ওপর হামলা বাড়ছে। জেলায় জেলায় কান পাতলেই শুনতে পাবেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিষাদ ও আতঙ্ক এক চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। একদিকে তাদের বলা হচ্ছে ঘুষপেটিয়া। অনুপ্রবেশকারী। অপরদিকে নতুন করে খুঁচিয়ে তোলা হয়েছে পুরনো শত্রু সম্পত্তি আইন। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান যুদ্ধের পরে এই আইনটি করা হয়। বলা ছিল যে কেউ পাকিস্তানের নাগরিক হলে সম্পত্তি এনিমির। 

মুশকিল হচ্ছে উপমহাদেশের ভাগ কখনো সরল প্রক্রিয়ায় চলতে পারে না। এক ভাই চলে গেছেন। অন্য ভাই যাননি। কিংবা বাড়িওয়ালা চলে গেলেও অনেক দিনের ভাড়াটে থেকে গেছেন। তিনি নিয়ম মেনে নিয়মিত ভাড়া জমা দিয়ে গেছেন ডালহৌসির দ্য কাস্টোডিয়ান অব এনিমি প্রপার্টি ফর ইন্ডিয়ার অফিসে। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু রোডের এই অফিস আবার দেশভাগের আগে ছিল মেসার্স ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান। রাজ্যে সব মিলিয়ে এরকম শত্রু সম্পত্তি আছে ৯৪০০টি। তার মধ্যে কলকাতায় প্রায় একশ’। ২০১৬ সালে নরেন্দ্রমোদি সরকার আইন সংশোধন করে জানিয়ে দিয়েছেন যে শত্রু সম্পত্তি কোনোভাবেই কেউ কিনতে বা বেচতে পারবেন না। আত্মীয় বা ভাড়াটে থাকলেও তাকে অবিলম্বে চলে যেতে হবে। আসলে সরকার পুরো ‘এনিমি প্রপার্টি’ একসঙ্গে বিক্রি করতে চাইছে। তাতে এক লপ্তে টাকা আসবে এক লাখ কোটি। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের এও এক নতুন চাপ। এর ওপর আবার নাগরিকত্ব প্রমাণ কর, অমুক সার্টিফিকেট দাও, জমির দলিল কই, হাজার রকমের ঝঞ্ঝাটতো আছেই। দেশভাগের গবেষণায় পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠীর যাপন কখনো নির্মোহ ইতিহাস লেখে না। এখন এই লেখা লিখতে বসেও সত্যিই মনে হচ্ছে সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী ফের একবার ১৯৪৬/৪৭এ ফিরে এসেছে। বলা যায় ৪৭ এর পরের অবস্থা যেন ফাঁস হয়ে একটা সম্প্রদায়ের ওপরে ক্রমেই চেপে বসেছে। অদ্ভুত সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। দেশভাগ রাতারাতি একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সবদিক দিয়েই কেমন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে তুলল তা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা হওয়া দরকার। সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক যে ছবি দেশভাগের আগে ছিল তা সম্পূর্ণ বদলে গেল। শুধু মুসলমানের হাল খারাপ হলো তাও নয়, সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতির অবনতি ঘটল। ইদানীং যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে এ বাংলার রূপকার বলে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মাতব্বরেরা গর্বের সঙ্গে প্রচার করেন, তাদের ভাবা দরকার যে একদা যে পশ্চিমবঙ্গ শিল্প বাণিজ্য, অর্থনীতিতে ছিল সামনের সারিতে কিভাবে ধীরে ধীরে তাদের পিছিয়ে দেওয়া হল। বাংলা ভাগ দু’পাড়ের সমাজ অর্থনীতিতেই চরম ক্ষতি করে দিল। পাট শিল্পের কথাই ধরুন। চটকলগুলো সব পড়ল এপারে। পাটচাষিরা অধিকাংশ আগের মতোই থেকে গেলেন পূর্ববঙ্গে। ফলে এ পাড়ের পাট শিল্প যা ছিল, এ বঙ্গের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ তা ক্রমেই মুখ থুবড়ে পড়ল। এরকমভাবে একের পর এক অন্যন্য শিল্পেও আঘাত আসতে লাগল। এর পেছনে ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিশালী অবাঙালি লবির ষড়যন্ত্র। দেশভাগের অন্যতম কারিগর জনসংঘ ও হিন্দুমহাসভার পৃষ্ঠপোষক ছিল এই অবাঙালি পুঁজিই। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাকে কোণঠাসা করা। দুর্বল রাজ্য কোনোদিনই কেন্দ্রের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা নেবে না। এই অঙ্ক গো বলয়ের বানিয়াদের মাথায় ছিল। ফলে স্বাধীনতার দিন থেকেই রাজস্ব ও মাসুল সমীকরণ নীতি এমনভাবে নির্ধারিত করা হতে লাগল যাতে পশ্চিমবঙ্গের একদার সমৃদ্ধি চিরতরে বিদায় নিতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতার দু’বছর পরে ১৯৪৯ সালে রাজ্যে বিধানসভায় শরৎ চন্দ্র বসু সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, -পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। তার আর্থিক সংকট বিপজ্জনক পৌঁছেছে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আর এক লক্ষ্য ছিল গো-বলয়ের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বাঙালি মননে চারিয়ে দেওয়া। এই আশঙ্কা থেকেই শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম অখণ্ড বাংলার ডাক দিয়েছিলেন। আজ এত বছর পরে পশ্চিমবঙ্গে যখন নতুন করে চরম সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি সংখ্যা গরিষ্ঠজনের মনে চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন গেল গেল রব তোলার আর কোনো মানেই হয় না। এই পরিস্থিতি কোনো আকস্মিক বিষয় নয়। এর জন্য হিন্দুত্ববাদীদের পাশাপাশি তথাকথিত লিবারেল, ধর্ম নিরপেক্ষদের দায়ও কিছু কম নয়।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম জনগোষ্ঠী কখনো একমাত্রিক নয়। পূর্ববঙ্গের মুসলমান মূলত ধর্মান্তরিত। কৃষিনির্ভর সমাজের বাসিন্দা। উৎস এক হওয়ায় নিম্নবর্গের হিন্দু ও ধর্মান্তরিত মুসলিম পড়শি দীর্ঘ সময় ধরে একসঙ্গে বসবাস করায় এক ধরনের বন্ধন তৈরি হয়েছিল। ফলে নোয়াখালী বাদ দিলে স্বাধীনতার পরে পরেই কিন্তু ওপারের পরিস্থিতি মোটের ওপর শান্ত ছিল। এটা পাল্টাতে লাগল ১৯৫০ সালের পর থেকে। বরিশাল, ঢাকা, খুলনায় বিরাটসংখ্যক মানুষ দাঙ্গার পর পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় নতুন করে আসতে লাগলেন। এখন মনে হয় দাঙ্গার পেছনে শুধু ধর্ম নয়, অন্যান্য আরও বেশ কিছু কারণ ছিল। ১৯৫০ সালের আগে পরে পাকিস্তান রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভারতের মতো পাক শাসককরাও বাংলাকে অর্থনৈতিক শোষণের মৃগয়া ভূমি হিসেবে বেছে নিয়েছে। পূর্ববঙ্গের বিরোধী দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে উঠেছে। বামপন্থীরাও সোচ্চার কৃষক শ্রমিক শোষণের বিরুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে শাসকদের ত্রাস হয়ে প্রবল ভূমিকায় সক্রিয় হয়েছেন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। মওলানার রাজনীতির শ্রেণি মিত্র সমাজের অন্তজ অংশ। কুমোর, কামার, জেলে, কাহার, মুচি, মেথর, মাঝি ও কৃষকেরা। তাদের সবাই মুসলিম ও নিম্নবর্গের হিন্দু। ফলে পাক শাসকরাও ব্রিটিশ নীতি ভাগ করো ও শাসন কর নীতি বেছে নিলেন। ফলে দাঙ্গা নামে হিন্দু-মুসলিম হলেও এর পেছনেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। ঠিক পশ্চিমবঙ্গেও মুসলিম সম্প্রদায়কে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে সক্রিয় ভূমিকা নিল শাসক কংগ্রেস। কংগ্রেসের একটা অংশ সিদ্ধান্ত নিল সাফ সাফ মুসলিমদের বলে দেওয়া- যে হয় তোমরা এদেশের মূলস্রোতে থাক, না হয় দেশ ত্যাগ কর। লীগ পন্থী এলিট মুসলিমদের অনেকেই এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাতারাতি কংগ্রেস হয়ে গেলেন। কংগ্রেসের সবাই অবশ্য লীগ ভক্তদের এভাবে ভোলবদল মেনে নিলেন না। কংগ্রেসের মধ্যে ছিল নানাগোষ্ঠী উপগোষ্ঠী। অতুল্য ঘোষ ও বিধান রায় অনুগামীরা চেয়েছিলেন মুসলিম সমর্থকদের কাছে টেনে বড় সংখ্যক মুসলিম ভোট নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসতে। তাহলে ক্ষমতার রাজনীতিতেও তাদের প্রাধান্য বাড়বে। প্রভাবশালী মুসলিমরা অনেকেই এভাবে কংগ্রেসের সহায়তায় রাজনীতির মূলস্রোতে গা ভাসালেন। বর্ধিষ্ণু মুসলমানেরা সেই থেকেই বংশপরম্পরায় কংগ্রেস অনুগত। যা আজও মালদা মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে টিকে আছে। সাধারণ মুসলমানেরা টিকে থাকার জন্য নানান অবলম্বন করতে বাধ্য হলেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পড়শি হিন্দুদের সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হলেন। হিন্দুদের মনোরঞ্জনে তারা প্রকাশ্যে গরু জবাই বা ধর্মীয় অন্যান্য আচরণ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এমনকি মসজিদের সামনে দিয়ে হিন্দুদের দলবদ্ধভাবে বাজনা বাজানোর যে রীতি ছিল বিতর্কিত তাও বাধ্য হয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন মেনে নিলেন; কিন্তু এসব আনুগত্য বা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হলো। হিন্দুদের উগ্র অংশ এই মেনে নেওয়াকে নিজেদের বিরাট বিজয় ধরে নিয়ে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ছুতোয় নাতায় বিপদে ফেলতে সক্রিয় হলো। আগেই বলেছি যে পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের মধ্যে অসংখ্য ভাগ আছে। এখানকার পুরনো বাসিন্দাদের অনেকেই দূর দূরান্ত থেকে এখানে একদা ভাগ্যান্বেষণে এখানে এসে পাকাপাকিভাবে থিতু হয়ে স্থানীয় মুসলিম হয়ে গেলেন। ইরান-ইরাক তো বটেই তখন কলকাতা ব্রিটিশ রাজধানী হওয়ায় পশ্চিম ও উত্তর ভারতের মুসলিমরাও এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে করতে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে গেলেন। পশ্চিমবঙ্গে আজও সংখ্যায় কম হয়েও আশ্চর্যজনকভাবে মুসলিম সম্প্রদায়ের কর্তৃত্ব বা রাশ নিজেদের হাতে রেখেছেন এই অবাঙালি মুসলমানেরাই। আটাশ ঊনত্রিশ শতাংশ মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ অবাঙালি মুসলমান। তবু সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে কীভাবে যেন তারাই সামনের সারিতে। এ অবস্থার পেছনেও কিছুটা নিশ্চিত দেশভাগ দায়ী। ’৪৭, ’৫০ এবং ’৬৪ সালের দাঙ্গা বাঙালি মুসলমানের কোমর পুরোপুরি ভেঙে দিল। সে বাস্তুচ্যুত হলো। নগরজীবন থেকে গ্রামে সরে যেতে বাধ্য হলো। তথাকথিত উন্নয়নের মূলস্রোতে থেকে সে চিরকালের জন্য নির্বাসিত হলো। শুনতে খারাপ লাগলেও এটা সত্যি যে হিন্দু ও মুসলিম দুটি পাড়া পাশাপাশি থাকলেই না বলে দিলেও সাদা চোখে আপনি বলে দিতে পারবেন কোনটা সংখ্যাগুরুর বা কোনটা সংখ্যালঘুর। এই অবহেলা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমনে চারিয়ে গেছে দীর্ঘদিন ধরেই। এখন ক্রমেই তা পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চরম বিদ্বেষের চেহারা নিচ্ছে। দেশভাগের পর শহর কলকাতা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে অন্তত ষাট-সত্তরটি মসজিদ। তার মধ্যে আমি দেখেছি অনেক মসজিদ দখল করে ছোট দোকান বা সিমেন্টের গোডাউন অবধি হয়েছে। কবর স্থান দখলের ঘটনাও ঘটছে। নদীয়া ও অন্যান্য অনেক জেলায় দাঙ্গার সময় অনেক মুসলিম প্রাথমিকভাবে ওপারে পালিয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু সেখানে জায়গা পছন্দ না হলেই দলে দলে সপরিবারে বাসায় ফিরে এসে টের পান কোথাও আর ফেলে আসা অতীত টিকে নেই। ওপারের উদ্বাস্তুরা ফেলে আসা সম্পত্তি দখল করেছে। স্বাভাবিকভাবেই তখন তারা সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় পরিচিত, চেনাজানা পরিবারের পাশাপাশি নতুন করে ঘর বাঁচতে আশ্রয় নেয়। তার ফলেই কিছু এলাকায় মুসলিম জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। তখন থেকেই মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে অথবা অনুপ্রবেশ ঘটছে এই গুজবটি সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হাওড়া বা কলকাতাতেও মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি প্রশাসনের একাংশের সাহায্যে পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুরা দখল করে। 

এভাবেই মুসলিম ঘেটো জন্ম নিতে থাকে। যার জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের চেয়ে বড় ভূমিকা হিন্দু সম্প্রদায়ের, এই সত্যটা মেনে নিতে হবে। কালিয়াচক বা মেটেবুরুজের ঘেটো চিহ্নিত এলাকা নিয়ে দিনের পর দিন মিথ্যে বলে বলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমনে এমন এক তীব্র ঘৃণার জন্ম দেওয়া হয়েছে, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো সম্পর্ক নেই। অনেক প্রগতিশীলও বলে থাকেন কালিয়াচক বা মেটেবুরুজের রাস্তায় নাকি প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পতাকা ওড়ে। আমি বহুবার ওসব এলাকায় গিয়ে বিষয়টি যাচাই করতে গিয়ে অবাক হয়েছি শিক্ষিত মানুষের অজ্ঞতা দেখে। ওয়াজ মেহফিলের ধর্মীয় সবুজ পতাকাকে তারা পাকিস্তানের বলে ধরে নিয়েছেন। এটা আসলেই পরস্পর সম্প্রদায়কে না জানার ফল। এই না জানা বা না জেনে অপর সম্প্রদায়কে ঘেন্না করা বহুগুণ বেড়ে গেছে বিরানব্বই সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর থেকে। মুসলিম মনে কেবল ঘৃণা নয়, জন্ম নিয়েছে ভয়ংকর এক ভয় ও আতঙ্ক এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমনের এক অংশ হয়ে পড়েছে চরম মুসলিমবিদ্বেষী। 

                   লেখক : তথ্যচিত্র নির্মাতা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //