ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স নিয়ে ভাবতে হবে

উন্নত জীবনের ঢেউ বিশ্বজুড়ে মানুষকে স্পর্শ করছে। ফলে প্রত্যাশা বাড়ছে, ভোগের আকাঙ্ক্ষাও। আর তা পূরণে মানুষকে বাধ্য হয়ে খাটতে হচ্ছে অনেক বেশি। যে কারণে মানবিক সংযোগে চিড় ধরছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও মাখামাখি কমে যাচ্ছে। জীবনযাপনের উন্নত উপকরণ সংগ্রহ করেই খুশি হচ্ছে মানুষ; কিন্তু জীবনটা যন্ত্র নয়। তাই মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন জীবন অবসাদ, বিতৃষ্ণা ও ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে। এ জন্য বিশ্বজুড়ে Work-Life Balance-এর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। জীবনের সঙ্গে কাজের ভারসাম্য বিনষ্ট করা যাবে না। 

জাতিসংঘের অঙ্গ-সংগঠন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এক যৌথ গবেষণায় দেখিয়েছে ২০১৬ সালে ১৯ লাখ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী ‘কাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগ ও তার অভিঘাত।’ রয়টার্সের এক প্রতিবেদন ‘WHO/ILO joint estimates of work-related burden of disease and injury 2000-2016’  জানিয়েছে কাজ সম্পর্কিত বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছে শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণের মধ্যে ছিল ফুসফুসের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহে ৪ লাখ ৫০ হাজার, স্ট্রোকে ৪ লাখ এবং হৃদরোগে ৩ লাখ ৫০ হাজার। ১৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩ লাখ ৬০ হাজার কর্মী কাজের সময় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই গবেষণায় ১৯টি পেশাগত ঝুঁকিকে কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কর্মস্থলে বায়ুদূষণ, হাঁপানি, ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানের উপস্থিতি, শোরগোল উল্লেখযোগ্য। নানা ধরনের গ্যাস, ধোঁয়া, শিল্প-কারখানা থেকে নিঃসৃত ক্ষুদ্র কণার কারণে পেশাজীবীদের জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্ম সম্পর্কিত রোগ ও অভিঘাত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চাপের মুখে ফেলে দেয়, উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে এবং পরিবারের আয়ের ওপর বিপর্যয়কর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে আশার কথা, ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে চাকরিস্থলে বিভিন্ন রোগে ও অভিঘাতে মানুষের মৃত্যু-পূর্ববর্তী বছরগুলোর চাইতে ১৪ শতাংশ কমে গেছে; কিন্তু নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরির তাগিদের ফলে আরও জোরদার হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রস আধানোম গেব্রিয়াসুস এবং আইএলও মহাপরিচালক গাই রাইডার বলছেন স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ কর্মক্ষেত্র তৈরির নীতি নির্ধারণে আরও মনোযোগী হতে হবে সবাইকে। 

জাতিসংঘ ও এর শ্রমবিষয়ক সংস্থা আইএলও শ্রম অধিকার, শোভন কাজ, উপযুক্ত কাজের পরিবেশের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে কাজ করে চলেছে। আইএলওর মতে, যে কর্মসংস্থান শ্রমিকের ন্যায্য আয়, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত উন্নতির সম্ভাবনা, পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে, তা-ই ডিসেন্ট জব বা শোভন চাকরি। শোভন কাজ অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছে দেয়, সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিত করে, অর্থনীতিতে গতি আনে ও টেকসই উন্নতি ত্বরান্বিত করে। আপাতত ব্যয়বহুল মনে হলেও দীর্ঘস্থায়ী উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করার জন্য শোভন চাকরি সংবলিত কর্মস্থল বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

দীর্ঘমেয়াদি কোভিড সংক্রমণে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই সময়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেককে তাদের নির্ধারিত চাকরি হারাতে হয়েছে। ফলে অনেক কর্মজীবীকে এই সময়ে কর্মহীন থাকতে হয়েছে অথবা পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠান পুনরায় খুললে কর্মহীন মানুষ ভিড় জমাতে পারেন পুরনো কর্মস্থলে চাকরি ফিরে পেতে। কর্মীর চাকরি লাভের এই প্রতিযোগিতাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে না নিলে অহেতুক দীর্ঘ কর্মঘণ্টা অথবা কম পারিশ্রমিকে বাধ্য করার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। অনুরূপ ঘটনা শ্রমশক্তির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হতে পারে এ কথা ভুললে চলবে না। 

করোনাকালে মহামারির আক্রমণ এড়াতে ‘ওয়ার্ক ফর হোম’ ব্যবস্থা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। বড়সংখ্যক কর্মজীবী এই পদ্ধতিতে নিরাপদে চাকরি করেছেন এবং পরিবারকেও সুরক্ষায় সক্ষম হয়েছেন। অনেকে বলছেন এই পদ্ধতির সুবিধা বাড়ির পরিবেশে আরামে কাজ করা যাচ্ছে, যাতায়াতের সমস্যা নেই বা ফরমাল ড্রেসে নিজেকে প্রেজেন্টেবল রাখার ঝামেলাও সহ্য করতে হচ্ছে না। তবে, বাড়িতে থেকে কাজ শুরু করার পর বেশিরভাগ চাকরিজীবী একাধিক সমস্যায় পড়েছেন। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় সমস্যা ওয়ার্ক লাইফ ব্যালেন্স করার বিষয়টি। বাড়িতে সব কাজ সামলে, সবার মাঝে অফিসের কাজে মনোনিবেশ করাটা সমস্যার বলেই এখন মনে করছেন অনেকেই। একদিকে বসের হুকুম, অন্যদিকে সংসারের কাজ সুন্দর করে সেরে ফেলা এক নাগাড়ে বেশি দিন সম্ভব হয় না। 

কেউ কেউ বলছেন প্রথম দিকে তারা ভালোই ম্যানেজ করেছেন। গৃহস্থালির কাজে সময় দিতে পারায় গিন্নি খুশি, সংসারেও অপার শান্তি। উল্টো চিত্রও আছে। যখন তখন ঘর সংসারের কাজে সময় দিতে গিয়ে ল্যাপটপের সামনে অনুপস্থিত থাকায় বসের তিরস্কারের মুখোমুখি হয়েছেন এমন ঘটনাও কম নয়। নারী কর্মীদের ক্ষেত্রেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। কর্তারা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’কে মামুলি বিষয় ধরে নিয়ে অফিস চলাকালীন অযথা তাদের গৃহকর্মে সম্পৃক্ত করেছেন। কর্মীদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, অনলাইনে কাজ করার জন্য ফাঁকি দিচ্ছেন এই অনুমানে দৈনিক ‘অফিসটাইম’ একটু-একটু করে বেড়েই চলেছে। কাজ সম্পাদনে প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলেও পাশে সহায়ক সহকর্মীদের অনুপস্থিতি, ঘরে কাজ করার পৃথক জায়গা না থাকা এবং বিশেষ করে ইন্টারনেট নেটওয়ার্কজনিত সমস্যায় নাজেহাল হতে হচ্ছে তাঁদের। 

সব কাজ একদম সঠিকভাবে হবে এবং কোনো কাজে ভুল থাকবে না, এটি সুপারভাইজার এবং কর্মী দু’জনেরই প্রত্যাশা; কিন্তু বাসায় বসে কাজ করে কাজের মান রক্ষা করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। পাশাপাশি বাড়িতে বসে কাজ করলে প্রিন্টার বা অন্যান্য দরকারি জিনিস না-ও থাকতে পারে, সেটিও বিবেচনায় রাখা জরুরি। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে যা আছে তা দিয়েই মানিয়ে নিতে হবে। 

বাড়ি থেকে অফিস যাওয়া ও বাড়িফেরা, এই দুইয়ের মাঝে রিফ্রেশ হওয়ার সুযোগ থাকে। এটি প্রাত্যহিকজীবনে প্রয়োজন। বাড়িতে যদি পরিবেশ বা সুযোগ থাকে তাহলে কাজের জন্য আলাদা জায়গা তৈরি করলে ভালো। কাজের সময় সেখানেই বসে কাজ করলে অফিসের মতো অনুভূতি হতে পারে। পাশাপাশি অন্যান্য কাজ বা সাংসারিক প্রয়োজনে মন চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। 

তবে এটি অনস্বীকার্য যে, শিক্ষাক্ষেত্রে যেমন প্রাতিষ্ঠানিকতার গুরুত্ব রয়েছে কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রেও অফিস বা কর্মক্ষেত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। কাজকে ব্যক্তিজীবন যাত্রা থেকে পৃথক করতে হবে। তা না হলে কাজের সময়কাল সীমারেখা হারাবে এবং কর্মীর স্থায়ী প্রভাবে বিপর্যস্ত হবেন। তবে বড় কথা হলো, কাজ অফিসে বা বাসা থেকে হোক, সীমারেখা বলবত করা বিধেয় এবং তার বিকল্প নেই। কর্মীকে সুস্থ থেকে প্রতিষ্ঠানের উন্নতি কার্যকর করার ভূমিকা উপযোগী করতে চাইলে Work Life Balance কার্যকর ও তার কর্মঘণ্টা উপযুক্তভাবে নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন ছাড়া গতি নেই। মালিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি ছাড়া এক্ষেত্রে পরিবর্তন সম্ভব নয়।

লেখক- কথাসাহিত্যিক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //