সংগঠনের নামে বিভক্তি

স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় সরকার পরিচালনার কৃতিত্ব বর্তমান সরকারের। সম্প্রতি প্রচারমাধ্যমে সরকারি দলের বহু সংগঠনের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে।

তালিকাটি এ রকম- ১. জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, ২. জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, ৩. আওয়ামী প্রচার লীগ, ৪. আওয়ামী সমবায় লীগ, ৫. আওয়ামী তৃণমূল লীগ, ৬. আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, ৭. আওয়ামী মোটরচালক লীগ, ৮. আওয়ামী তরুণ লীগ, ৯. আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, ১০. আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, ১১. আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, ১২. আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, ১৩. আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, ১৪. আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ১৫. আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, ১৬. আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, ১৭. বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, ১৮. বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, ১৯. বঙ্গবন্ধু একাডেমি, ২০. বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, ২১. ওলামা লীগ, ২২. বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, ২৩. বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, ২৪. বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, ২৫. বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, ২৬. বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, ২৭. বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, ২৮. বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, ২৯. বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, ৩০. বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ, ৩১. বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, ৩২. বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, ৩৩. বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, ৩৪. বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, ৩৫. বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, ৩৬. আমরা মুজিব সেনা, ৩৭. আমরা মুজিব হব, ৩৮. চেতনায় মুজিব, ৩৯. বঙ্গবন্ধুর সৈনিক লীগ, ৪০. মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, ৪১. নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী, ৪২. দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ৪৩. ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ৪৪. ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, ৪৫. নৌকার নতুন প্রজন্ম ৪৬. ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ৪৭. ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, ৪৮. ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, ৪৯. বাংলাদেশ আওয়ামী পর্যটন লীগ, ৫০. ঠিকানা বাংলাদেশ, ৫১. জনতার প্রত্যাশা, ৫২. রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি, ৫৩. জননেত্রী পরিষদ, ৫৪. দেশরতœ পরিষদ, ৫৫. বঙ্গমাতা পরিষদ, ৫৬. বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব পরিষদ, ৫৭. আমরা নৌকার প্রজন্ম ৫৮. আওয়ামী শিশু যুবক সাংস্কৃতিক জোট, ৫৯. তৃণমূল লীগ, ৬০. একুশে আগস্ট ঘাতক নির্মূল কমিটি, ৬১. আওয়ামী প্রচার লীগ, ৬২. সজীব ওয়াজেদ জয় লীগ, ৬৩. বাংলাদেশ তথ্য প্রযুক্তি লীগ, ৬৪. আওয়ামী শিশু লীগ, ৬৫. আওয়ামী তৃণমূল লীগ, ৬৬. আওয়ামী তরুণ প্রজন্ম লীগ, ৬৭. আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ, ৬৮. বাংলাদেশ জনসেবা লীগ, ৬৯. আওয়ামী শিশু-কিশোর লীগ, ৭০. অভিভাবক লীগ, ৭১. উদ্যোক্তা লীগ, ৭২. আওয়ামী অনলাইন লীগ এবং ৭৩. বিশ্ব আওয়ামী অনলাইন লীগ। 

সংবাদ মাধ্যম থেকে সংগৃহীত সরকারি দল আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আশায় সক্রিয় থাকাদের এ তালিকার নাম ও সংখ্যা যে নির্ভূল এমন দাবি করা যাবে না। সাধারণ জনগণ বিশ্বাস করে অনুসন্ধান গভীরতা পেলে আরও বেশকিছু এমন সংগঠন পাওয়া যাবে। পতঙ্গ যেমন আলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনভাবে রাজনীতির ক্ষমতা দেখে ব্যক্তি মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ঝাঁপিয়ে পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় সকলেই নিজের ক্ষমতা পোক্ত করতে পদ-পদবির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। আকাক্সক্ষার তীব্রতা থেকেই ব্যক্তির উদ্যোগ, মই সৃষ্টির উদ্যোগ, ক্ষমতার বলয়ে অবস্থান নিশ্চিত করার উদ্যোগ, প্রাপ্তির দুয়ার খোলার উদ্যোগ সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে গড়ে উঠছে এমন সব সংগঠন; যারা লক্ষ্য উদ্দেশ্য এক রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে, আশা করা যায় না। কারণ মাঝে মাঝেই বিভক্তির চিহ্নস্বরূপ একাধিক ব্যানারও দেখা যায়, যদিও তাতে কারও কোনো সমস্যা হয় না। 

রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্রে স্বীকৃতি না থাকলেও দেখা যায় এ ধরনের সংগঠনগুলোর পরিচালনায় কোনো সমস্যা হয় না। কারণ প্রতিটি সংগঠনের খুঁটির জোরই কেবল শক্ত নয়, সবগুলোই পৃষ্ঠপোষকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পরিচালিত যা উভয়ের জন্য সৌভাগ্যের দুয়ার খুলে দিয়েছে। তাই রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত সংগঠনগুলোর শাখা প্রশাখা যেমন বিস্তৃত, তেমনি এসব সংগঠনের সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার উচ্চপদস্থ পেশাজীবীদের সম্পৃক্ততাও দেখা যায়। পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দলে পদ হারানো নেতা ও সাবেক মন্ত্রীদের। এদের প্রতি সদয় হয়ে বর্তমান কিছু নেতা ও মন্ত্রীকেও সংগঠনগুলোকে অনুপ্রাণিত করতে দেখা যায়। 

সংগঠনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণের চাইতে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ রাখতেই তারা বেশি ব্যস্ত থাকেন। ফলে সভা-সমাবেশে প্রচার প্রচারণার কার্যক্রমের আড়ালে ভাগ্য পরিবর্তনের খেলা দেখা যায়। সরকার অনেক সময় হেলেনা জাহাঙ্গীর, দর্জি মনিরদের নিয়ন্ত্রণহীন কার্যক্রমকে আইনের আওতায় আনে। যদিও আইনের আওতায় আসারা বাদে পৃষ্ঠপোষক ও সহযোগীরা সবাই ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়। এক মুখরোচক সংবাদে সারাদেশে যখন মুখরিত ঠিক তখনই অন্য একটি মুখরোচক সংবাদ সামনে এসে দাঁড়ায়। সাধারণ জনগণ পুরনোটা ভুলে নতুন সংবাদ ডুবে যায়। হেলেনা জাহাঙ্গীর বা দর্জি মনিররা শুধু নয়; অন্য যারা অগঠনতান্ত্রিক কাজে নিয়োজিত তারাও পিছনে পড়ে থাকে। ফলে সময় আর সুযোগ বুঝে এরা দশকের পর দশক ধরে থাকে সক্রিয়। সারাদেশ যে শুভেচ্ছা দিতে বিশাল বিশাল ছবিসহ ফেস্টুন, ব্যানারে ছেঁয়ে আছে- তা এ সক্রিয়তাকে জানান দেবারই অংশ। তবে এতে সবচাইতে বিপদে আছে সড়কের পাশের গাছগুলো। এক একটি গাছ ৮/১০ জনের শুভেচ্ছা বাণী ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকে। দেশের কোনো পরিবেশবাদীর সাহসে কুলায় না এ গাছগুলোকে রক্ষা করার। তবে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ এসব ব্যানার ফেস্টুনের জন্য কর ধার্য্য করলে তা প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে। 

দেশের যে কোনো রাজনৈতিক দল তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণের জন্য বহুবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করার অধিকার রাখে, তবে তা অবশ্যই হতে হবে গঠনতন্ত্রের মধ্যে থেকে। ‘দেশ ও রাজনীতি’ প্রবন্ধে ড. আহমদ শরীফ এক জায়গায় লিখেছেন, “... শাসননীতি ছিল একটিই- বিনা বাঁধায় ও বিনা নিয়ন্ত্রণে দুষ্ট লোককে ও লুব্ধ মানুষকে যথেচ্ছ চলতে দেয়া। এর অপর নাম ঘুষে বশ করা নীতি। এর শোভন ইংরেজি নাম হতে পারে ‘Policy of non-interference’ বা  ‘Policy of least resistance’। দুর্নীতিবাজকে দুর্নীতির সুযোগ দেয়া, খুনিকে খুন করতে দেওয়া, বাটপারকে রাহাজানি করতে দেয়া, জুয়াড়ীকে জুয়া খেলার সুযোগ দেওয়া, আমলাকে ঘুষ নেওয়ার প্রশয় দেওয়া, রাজনীতিককে আখের গোছানোর সুযোগ দেওয়া এর নাম ঘুষ নীতি, তাই দুষ্টমাত্রই ছিল এ রাজত্বে তুষ্ট। এ নীতির মূল কথা- দুর্জনেরে রক্ষা করো, দুর্বলেরে হানো।” প্রাতঃস্মরণীয় এ ব্যক্তিত্বের উপলদ্ধি এ পর্যন্ত উপেক্ষিতই রয়ে গিয়েছে। শাসননীতির প্রাগুক্ত মূল্যায়ন আজও চলমান, বরং এতে বর্তমান কালে ২/৪টা নতুন পালক যুক্ত হয়েছে। দশকের পর দশক ধরে লালন করা এ নীতি সাধারণ জনগণ দেখে আসছে। কারণ এ নীতির ফলাফল হিসেবে পাড়া মহল্লায় বিশাল ব্যানার ফেস্টুন ঝুলিয়ে দিয়ে সংগঠনের নেতা এবং সরকারি দলের লোক হিসেবে বর্ষিত হুমকি-ধমকি আর চাঁদাবাজি সাধারণ মানুষকেই সহ্য করতে হয়। 

দলের গঠনতন্ত্রে কী আছে, কী নেই তা সাধারণ মানুষের বিবেচনার বিষয় নয়। সরকারি ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বেড়াজালে কে কতটা জড়াবে তা ব্যক্তি নির্ভর। সাধারণ জনগণের অন্যায়ের প্রতিকার করার অধিকারের স্বীকৃতিও শাসকশ্রেণিনির্ভর। তবে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ককে জাতির জনকের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়ার পর তাকে বিভিন্ন সংগঠনের নামে বিভক্তি অনিবার্যভাবেই দৃষ্টিকটু হয়ে যাচ্ছে  কি-না, তা বিবেচনার দাবি রাখে। সাধারণ মানুষ মনে করে রাষ্ট্রীয়ভাবে এখানে হস্তক্ষেপ আশু প্রয়োজন।  

লেখক- সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //