দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে দেশি খাদ্যশিল্প বাঁচানোর বিকল্প নেই

করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার আগেও ১ কেজি মোটা চাল ৩৪ থেকে ৪০ টাকায় কিনতে পেরেছে সাধারণ মানুষ। সেই চাল কিনতে এখন লাগছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। 

ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে চাল প্রতি কেজি এখন ৭০, ডাল ১৪০, সয়াবিন তেল ১৪০, চিনি ৮৫ টাকা। দেড় বছরের ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। একইভাবে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা লিটারের সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে সাড়ে ৩৭ শতাংশ। 

চাল-তেলের মতো আটা, চিনি, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস, তরল ও গুঁড়া দুধ, শাক-সবজিসহ কয়েকটি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের মানুষ চাপে পড়েছে। গত কয়েক মাসে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে করোনায় বিপর্যস্ত দেশ। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। বেতনও কমেছে অনেকের। নতুন চাকরির বাজারও নড়বড়ে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি। সব মিলিয়ে কঠিন সময় পার করছে স্বল্প আয়ের মানুষ। 

মহামারির শুরুর দিকে খাদ্য উৎপাদনকারী ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান যেমন মৎস্য, পোলট্রি ও ডেইরি ফার্মগুলো কিছুটা উৎপাদন স্বল্পতা ও আর্থিক ঝুঁকির মুখে পড়লেও তা ক্রমান্বয়ে কাটিয়ে উঠছিল; কিন্তু হঠাৎ করেই ফিড মিলের অন্যতম উপকরণ ‘সয়াবিন মিল’ ভারতে রফতানির উদ্যোগ নিলে এই শিল্প আবারও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, যার ফল ভোগ করতে হবে সাধারণ ক্রেতাকে।

সরকার সম্প্রতি ‘সয়াবিন মিল’ রফতানির সিদ্ধান্ত নিলে এর প্রতিবাদ করেন ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশন। প্রাণিখাদ্য তৈরির প্রধান উপকরণ ‘সয়াবিন মিল’ এর ‘কৃত্রিম সংকট’ সৃষ্টির অভিযোগ এনে এর রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন তারা। তাদের মতে, সরকার ‘সয়াবিন মিল’ রফতানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর উৎপাদনকারীরা এর দাম কেজিতে ১০ থেকে ১২ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে। উৎপাদনকারীরা স্থানীয় বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে বিধায় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় সয়াবিন মিল রফতানি বন্ধ ঘোষণা করে বাজারে দ্রুত সরবরাহ দেওয়ার দাবি জানান তারা। তা না হলে দেশের পোলট্রি, মৎস্যসহ প্রাণিসম্পদ খাতে খাদ্যের দাম বেড়ে যাবে। খামারিরা বড় ধরনের লোকসানে পড়বে। পোলট্রি ও গবাদিপশুর খাদ্যের পেছনেই খামারিদের সবচেয়ে বেশি খরচ করতে হয়, যা মোট খরচের ৬৫ দশমিক ৭০ শতাংশ।

বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা প্রাণিখাদ্যের প্রধান উপকরণ হলো ‘সয়াবিন মিল’, চালের গুঁড়া, গমের ভূষি, ডালের ভূষি ইত্যাদি। পোলট্রি ও গবাদিপশুর দেহ গঠনে অন্যতম খাদ্য উপকরণ ‘সয়াবিন মিল’। ডিম, মাছ, মুরগির খামারেও খাদ্যের পেছনে এর খরচ প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ। সুতরাং ফিডের দাম বাড়লে খামারিদের উৎপাদন খরচ বাড়বে। অন্যদিকে খরচের বিপরীতে পণ্যের নায্য দাম না পাওয়ায় বড় অংকের লোকসানের মুখে পড়তে হবে খামারিদের।

মূলত পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিখাদ্য তৈরিতে যে কাঁচামাল ব্যবহার হয়, তার মধ্যে ভুট্টা, সয়াবিন মিল, গম, আটা ময়দা, ভাঙা চাল, চালের কুড়া, ফিশ মিল, সরিষার খৈল, তৈল, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি অন্যতম। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় ভুট্টা ও ‘সয়াবিন মিল’। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ খাতের প্রধান যোগানদাতা হিসেবে পোলট্রি, ডেইরি ও মৎস্য চাষ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে দীর্ঘকাল থেকে। যা দেশের গ্রামীণ পরিবারের গৃহস্থালি কাজের আয়বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। একইসঙ্গে ডিম, দুধ এবং মাংস সরবরাহের মাধ্যমে দেশের প্রোটিন ঘাটতি পূরণে দেশীয় পুঁজি এবং উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা এই শিল্পটি দেশের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখছে। 

বেসরকারি পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত শ্রম সাধনায় এসেছে সাফল্য, ঘটেছে নীরব বিপ্লব। পর্যাপ্ত পরিমাণে সরকারি সহযোগিতা না থাকায় সম্ভাবনাময় শিল্প হওয়া সত্ত্বেও অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দেশের এই শিল্পটি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৌরাত্ম্যে সম্ভাবনাময় পোলট্রি শিল্পে দেশি উদ্যোক্তারা অস্তিত্ব হারাতে চলছে। সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকার সুযোগে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিশেষ করে পোলট্রি শিল্পে কর্তৃত্ব ও আধিপত্য বিস্তার করছে। ইতিমধ্যে শিল্পের ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বিদেশি ৭টি কোম্পানি। এর মধ্যে ভিএইচ গ্রুপ, গোদরেজ, সেগুনা, টাটা এবং অমৃত গ্রুপ এই পাঁচটি ভারতীয় কোম্পানি। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের সিপি এবং চীনা কোম্পানি নিউ হোপ দাপটের সঙ্গে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। ফলে ভবিষ্যতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি দেশি কোম্পানিগুলো জিম্মি হয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

আবার বিদেশি কোম্পানিগুলো ৩ শতাংশ সুদে ব্যাংক ঋণে ব্যবসার সুযোগ পেলেও দেশীয় ব্যবসায়ীরা ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছে। বিদেশি সাতটি কোম্পানি বাংলাদেশে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারবে কিংবা লভ্যাংশ নিয়ে যেতে পারবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। বিদেশি কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাজার দখলের কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো বাজার হারাচ্ছে। খামারিদের ব্যয়ের ৭০ শতাংশই পোলট্রি ফিডে০

 যা বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এই আমদানিতে ট্যাক্স ফ্রি সুবিধা না পাওয়ায় আরও বিপাকে রয়েছে পোলট্রি শিল্প। সমস্যা এতো প্রকট না হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খাদ্যমূল্য ও রোগ সংক্রমণ ইত্যাদি কারণে ফিশারিজ এবং ডেইরি খাতেও খামারিকে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেই পরিস্থিতিতে যদি প্রধান উপকরণ খাদ্যের মূল্য বেড়ে যায় তবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা পড়বে সন্দেহ নেই। প্রকারান্তরে ভুগতে হবে সাধারণ ক্রেতাকে।

অতীতে কখনো ভারতে সয়াবিন সিড কিংবা সয়াবিন মিল রফতানি হয়নি, বরং ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সয়াবিন মিল আমদানি করা হয়েছে। এখন যখন দেশে ১৮ থেকে ২০ লাখ মেট্রিক টন ‘সয়াবিন মিলের’ চাহিদার রয়েছে; এর ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ দেশেই উৎপাদিত হয়। বাকি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আমদানি করতে হয়। সেই সময়ে এসে কেন সয়াবিন মিল রফতানির প্রয়োজন হলো! গত কয়েক দশকে আমরা পাট, চিনিসহ বহু সম্ভাবনাময় শিল্প হারিয়েছি। যার প্রত্যক্ষ প্রভাব হয়তো জনগণের ওপর পড়েনি। তবে খাদ্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকলে জনসাধারণের জীবনধারণ আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

লেখক- কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //