হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা

এবারও কি পার পেয়ে যাবে প্রকৃত অপরাধীরা

এক

৯০ দশকের শেষে ও তার পরের দশকে ধর্ম-সংঘাতগুলোর পরপরই রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ প্রায় সব ছাত্র সংগঠনকেই প্রতিবাদী সভা-সমাবেশে ও সম্প্রীতি রক্ষামূলক কর্মসূচি নিয়ে মূখর ও সক্রিয় হতে দেখেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে জোর আওয়াজ ওঠা মিছিল ছিল একটি স্বাভাবিক দৃশ্য। বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজ, ধর্মসমাজ এবং সাংবাদিক মহলও থাকত সরব।

এবার চারিদিক সুনসান। বাম সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে প্রতিবাদ মিছিল করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো যেন ঘোস্ট সিটি! সচেতন জনগণের বেশিরভাগ যেন অনেকটাই সুনিশ্চিত এটি ‘ডীপ পলিটিক্স’-এর প্রথম অংক। না বুঝেশুনে এই গেইমের স্কেইপগোট হতেই যেন সবার আপত্তি, দ্বিধা, ভয়, সংশয়! 

দুই

দুঃখিত। সত্য শোনাতে খারাপ শোনালেও সত্য সত্যই। আল্লাহ না করুন আগামীতে সংঘাত হলে সেটি এবারেরটির চাইতেও বহুগুণ ধ্বংসাত্মক হবে।

কারণ? গত দুই দশকে আগের সংঘাতের চাইতে পরেরটি বেশি ধ্বংসাত্মক, তার পরেরটি আরো বেশি ধ্বংসাত্মক হয়েছে। সম্প্রীতি না বেড়ে প্রতিটি ঘটনা শেষে পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। অথচ সম্প্রীতির জন্য হাহাকারসহ আবেদন-নিবেদন-আহবানও আগের সংঘাতটির চাইতে পরেরটিতে বেশি ছিল। আরো পরেরটিতে আরও বেশি ছিল। তবুও…

জিজ্ঞাসা আকারে খানিকটা আলোকপাত করা হলে আরেকটু স্পষ্ট হবে বিষয়টি।

ক) অতীতের যতগুলো সংঘাত হয়েছে- আজও, একবারও, মুল শয়তান বা মূল সূত্র, যে বা যারা সজ্ঞানে সর্বপ্রথম বদমায়েশিটির বীজ রয়ে গেছে, সে বা তারা কখনোই কেন ধরা পড়েনি? কী সেই সুগভীর রহস্য? মূল হোতা/ হোতারা কি কখনো চিহ্নিত হয়েছে? তার/তাদের কি শাস্তি হয়েছে?

খ) একটিও ন্যায়বিচার বা সুবিচার কি হয়েছে? দরকার ছিল ন্যায়বিচার। ফেলে দেয়া হয়েছে লাশ! আরও ক্রোধ, সম্প্রীতিহীনতা ও জিঘাংসার রাস্তাই তৈরি করা হয়ে গেল না? [প্রতিবারই এখানে-সেখানে অসংখ্য ধরপাকড় হয়েছে। ধরা হয়েছে দ্বিতীয় পর্যায়ের উস্কানিপ্রাপ্ত সক্রিয়দের। প্রতিক্রিয়ারতদের। মুল ক্রীড়নক কেন সবসময়ই অধরা থেকে যায়? এবারও কেন…?]

গ) সম্প্রীতি সরকারি হাতকড়া, লাঠি বন্দুকের মুখ দিয়ে আসার বিষয় কি? কখনোই নয়! গুলি করে হত্যা, ধর-পাকড় ইত্যাদির মাধ্যমে সম্প্রীতি অর্জন? কবে, কোথায়, কোন দেশে কে এভাবে অর্জন করতে পেরেছে?

তিন

সব শেষ কথা, ন্যায়বিচার না থাকলে, জনগণকে স্বাভাবিক নিয়মসিদ্ধ গণতান্ত্রিক উপায়ে কথা বলতে না দিলে, সমাবেশ করতে না দিলে, উল্টা-পাল্টা ধরপাকড় করলে বিকৃত পথেই তারা প্রতিকার খুঁজবে। বিকৃতি বাড়বে। বিকৃতভাবেই রাগ-ক্ষোভ-জ্বালা-প্রতিবাদ প্রকাশ্য হবে। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণ ‘সাপ্রেশন টু ভেভিয়েশন’ [যত বেশি অবদমন, তত বেশি বিপথগমন] শুধুই কথার কথা নয়, একটি প্রমাণিত বাস্তবতা। 

বেশি ভয় পাইয়ে দেয়া বেশি বিপজ্জনক। সাপ বেশি ভয় পেয়ে গেলে ভয়ের চোটেই প্রাণঘাতী ছোবল দিয়ে বসে সে রকম। তাকে ভয় না পাওয়ালে, অনিরাপদ না ভাবালে সে সুরসুর করে পাশ কেটে চলে যায়। ছোবল দেয় ভয়ে, মনের আনন্দে নয়!

চার

সংখ্যালঘুত্বের যন্ত্রণা সীমাহীন। অনিরাপদ বোধ করা তাদের নিত্যসঙ্গী। নিত্যদিনের কখন কি হয় না হয়! ‘আমরা মাত্র অল্প ক’জন মানুষ, বিপদ এলে কীভাবে সামাল দেব’ এই মনোদৈহিক আত্মবিশ্বাসহীনতা তাদের কুরে কুরে খায়। তাদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অভিবাসীদের মাঝেও এই ভয়টি প্রকট। সেজন্য তারা একসঙ্গে থাকা পছন্দ করে। 

ইবনে খালদুন কয়েকশত বছর আগেই ‘আসাহবিয়্যাহ’ বা ‘গোত্রসংহতি’র কথা লিখেছিলেন। বেদুইনরা মরুভুমিতে অন্য বেদুইন ডাকাতদলের দ্বারা যেন আক্রান্ত না হয়, সেজন্য কাফেলায় চলে। জিপসিরা, ইহুদিরা, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা পরস্পরের সঙ্গে বেশ ভাব-সংহতি, যোগাযোগ রেখে চলে।

কারণ একটিই। আপেক্ষিক নিরাপদ বোধ করার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তিটি জিইয়ে রাখা। প্রবাসে গেলে আমরা বাঙালিরা যেমন অন্য বাঙালিরা কোথায় আছে খুঁজে বের করি। যেসব এলাকায় বাঙালি বেশি সেসব এলাকাতেই বসত গাড়ি। বিদেশে এ নিয়ে অনেক বিদেশি প্রায়ই কথা তোলেন। তারা অভিযোগ করেন এরকম পকেটে পকেটে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে থাকলে ডাইভার্সিটি (বহুমিশ্রণ) ও ইনক্লুশন (অন্তর্ভূক্তিকরণ) কীভাবে হবে? বিশ্বনাগরিক কীভাবে হওয়া সম্ভব হবে? 

কিন্তু বিদেশিদের মাঝেও যাদের বোধশক্তি উন্নত ও সমস্যার গভীরে যেতে পারেন- তারা আপত্তি তোলেন না। তারা জানেন এই একতাবোধকে অতো সাদাকালো হিসেবে ভাবা ভুল। মানুষ যাতে নিরাপদ ও স্বস্তিবোধ করে, তাতেই মনোযোগী হবে-এই মানবস্বভাবে অস্বাভাবিকতা কিছু তো নেই।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিজেদের মধ্যে যথেষ্ঠ সংহতি বজায় রাখলেও সংখ্যাগুরুর সঙ্গে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করেন-এই অনুযোগটি অনেকের কাছেই শুনেছি। আশা করি তারা বুঝতে পারছেন যে কারণটি মনস্তাত্বিক ও বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাসঞ্জাতও। একই বিষয় তাদের ভারতপ্রীতি বিষয়েও। ভারতের মুসলমানের মাঝেও পাকিস্তানপ্রীতি ও বাংলাদেশপ্রীতি থাকা স্বাভাবিক। আশ্রয় মিলুক না মিলুক, তারা মনে করেন বিপদে পড়লে স্বধর্মীয়দের কাছেই আশ্রয় মিলবে।

বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে আরো কিছু অনুযোগ বিভিন্ন মহলে শুনেছি। যেমন তারা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের দ্বারাই সবচাইতে বেশি পীড়িত ও ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দলটির অন্ধ আনুগত্যে তাদের কমতি নেই। এই ঊষ্মাটি অনেকেরই। অনুযোগের পেছনে কারণটি যেমন রাজনৈতিক, তাদের দলটির প্রতি আনুগত্যও রাজনৈতিক। তার পেছনে ইতিহাসও আছে। দলটির নীতিমালা তাদের সাংবিধানিক সুরক্ষা দেবার কথা যতোটা বলে, মানুক না মানুক, অন্যরা তো ততোটা বলে না। সেখানেই একাত্মতার বীজ লুকানো।

আরেকটি দরকারি মানবিকবোধ আত্মপরিচয় বা আইডেন্টিটি টিকিয়ে রাখা। অভিবাসী হলে সেটি ভাল বোঝা যায়। আমরা বাঙালি বা বাংলাদেশি এই পরিচয় যেন হারিয়ে না যেতে পারে, সেজন্য আমরা নানা রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়াই। নিজেদের স্বতন্ত্র উপস্থিতি-পরিচিতি জানানোর সব চেষ্টাই করি। দেশে হয়তো নিস্পৃহ ছিলেন, কোনো কিছুতেই জড়াতেন না, এমন মানুষেরাও অভিবাসে নানা উৎসবে-আয়োজনে নিত্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরও স্বপরিচিতি টিকিয়ে রাখার উপায় উৎসব-পার্বণ টিকিয়ে রাখা। শুধু টিকিয়ে রাখাই নয়, আরো নতুন নতুন উৎসব উদ্ভাবণ করা। এই মনোজাগতিক তাগিদটি কারও ক্ষতির কারণ নয়, সংখ্যালঘুদের আতবিশ্বাস ও আত্মপরিচিতি টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন। আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্যও প্রয়োজন। এতে প্রণোদনা দেয়া রাষ্ট্রেরই শুধু নয়, জনগণেরও দায়িত্ব।

সংখ্যালঘুরা যখন অভিমানে, অসহায়ত্বে কোনও একটি উৎসব বর্জন করার বা পালন না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন, তখন সেই লজ্জার ও গ্লানির দায়ভার সকলের ওপরেই বর্তায়। রাষ্ট্রপক্ষের কাজ হওয়া উচিত এই সত্যগুলোকে জনসমাজে উপস্থাপনের। টিভি-মিডিয়া, পাঠ্ক্রম-ভাবনা সবই তো সরকারের হাতে। তবু কেন দাঙ্গা লাগে? তবু কেন আমাদের সম্প্রীতির ঘাটতি এতোটাই বিধ্বংসী।

আমাদের ভাবনাকেন্দ্রে বদল আসুক। খোলা হাওয়া নামুক। সবার সুমতি হোক!  

লেখক : অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়    

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //