তিন বছরে অধ্যাপক!

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতিবিদদের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। তারাও নিয়মিত সংবাদ শিরোনাম হন। তবে গবেষণায় সাফল্য নয় বরং নানারকম বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ যে গবেষণা, সেই গবেষণায় চুরি, একাডেমিক ভাষায় যাকে বলা হয় প্লেজারিজম বা চৌর্যবৃত্তি সেই অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একজন অধ্যাপক। তার নাম আবুল মনসুর। পড়ান গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। এর আগে এই বিভাগেরই আরও দু’জন শিক্ষক একই অভিযোগে অভিযুক্ত শুধু নন বরং শাস্তিও পেয়েছেন। তবে অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে আবুল মনসুরের পার্থক্য হলো, তিনি চাকরিতে যোগদানের পরে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অধ্যাপক হয়েছেন।

গণমাধ্যমের খবর বলছে, তিনি ২০০৮ সালের ২৫ মার্চ প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সাত মাস ২২ দিনের মাথায় ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। এরপর এক বছর দুই মাসের মাথায় সহযোগী অধ্যাপক এবং এক বছর ৯ মাসের মাথায় তিনি অধ্যাপক হন। দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মতো এত কম সময়ে আর কেউ অধ্যাপক হয়েছেন কি-না সন্দেহ।

স্বাভাবিক পদোন্নতির কিছু শর্ত থাকে। তার মধ্যে একটা বড় শর্ত হলো একাডেমিক গবেষণা। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক বিবেচনাও কাজ করে। মনসুর কোন যোগ্যতার বলে এত দ্রুত অধ্যাপক হলেন, সেটা জানা কঠিন। তবে তার এই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অধ্যাপক হওয়ার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ফেসবুকে লিখেছেন: ‘প্রভাষক পদে ৩ বছর, এরপর সহকারী অধ্যাপক। সাত বছর পরে সহযোগী এবং ১২ বছর পরে পূর্ণ অধ্যাপক হওয়া যায়। তবে পিএইচডি থাকলে একজন প্রভাষক এক বছর পর সহকারী অধ্যাপক হতে পারেন। মানে ১০ বছরের আগে কোনোভাবেই অধ্যাপক হওয়া সম্ভব নয়, যদি না রাষ্ট্র তাকে উপহার দেয়।

তবে অধ্যাপক পদটি এমন যে, এটি চাইলেই কাউকে উপহার হিসেবে দেওয়া যায় না।’ প্রশ্ন হলো, আবুল মনসুর কী করে তিন সাড়ে তিন বছরের মধ্যে অধ্যাপক হলেন? তার সেই আশ্চর্য প্রদীপের কী নাম? একাডেমিক গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি নিয়ে তদন্তের পাশাপাশি তার অধ্যাপক হওয়ার এই রহস্যটাও উন্মোচন করা দরকার। সেইসঙ্গে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত করে দেখা দরকার, এ রকম ঘটনা আরও আছে কি-না।

অধ্যাপক আবুল মনসুরের চুরির প্রসঙ্গে আসা যাক। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তিনি ২০১৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদায়নের জন্য নিজের ১০টি গবেষণামূলক লেখা জমা দেন। এগুলোর একটিতে অনেকাংশ হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত আরেকজন শিক্ষকের লেখা থেকে। গবেষণাকাজে কারও লেখা এরকম হুবহু নিজের নামে চালিয়ে দেওয়ার নামেই চৌর্যবৃত্ত যেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

স্মরণ করা যেতে পারে, গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগেরই আরেক শিক্ষক সামিয়া রহমান, যিনি মূলত টিভি তারকা হিসেবেই পরিচিত, তার পদাবনতি হয়। তাকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে নামিয়ে সহকারী অধ্যাপক করা হয়। সেইসঙ্গে তার গবেষণা প্রবন্ধের সহলেখক অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজানকে শিক্ষা ছুটি শেষে চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর দুই বছর পদোন্নতি ছাড়া একই পদে থাকতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী? এই প্রশ্ন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর ভিসি ও শিক্ষকদের নানারকম নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ফলে সামনে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যতগুলো কাজ, তার অন্যতম হচ্ছে গবেষণা; কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (যেমন- কৃষি, বুয়েট ইত্যাদি) বাদে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় সারা বছর কী গবেষণা হয়; কতজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী মৌলিক গবেষণা করেন; সেসব গবেষণা দেশ ও মানুষের কল্যাণে কতটুকু কাজে আসে- এসব নিয়ে সংশয়ের শেষ নেই। আবার গবেষণাকে যেহেতু ওই অর্থে খুব সিরিয়াস কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বড় অংশই যেহেতু ক্লাস ও ল্যাবের বাইরেই নানাবিধ কর্মকাণ্ডে অধিকতর সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, ফলে গবেষণায় কে যে কার লেখা চুরি করে মেরে দিচ্ছেন, সেটা অনেক সময়ই জানা যায় না। আবার যেসব শিক্ষক রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী তাদের গবেষণা ঠিক আছে কি-না; তিনি চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছেন কি-না সেসব অনেক সময় খুঁজেও দেখা হয় না, যতক্ষণ না বিষয়টা তৃতীয় কারও অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে।

গবেষণাকাজে প্লেজারিম বা চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো নীতিমালা আছে কি-না; না থাকলে কবে করা হবে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, যে শিক্ষকদের বলা হয় মানুষ গড়ার কারিগর; যাদের কাছ থেকে মানুষ সর্বোচ্চ নীতি- নৈতিকতা প্রত্যাশা করে; যারা তার শিক্ষার্থীদের সৎ ও নীতিবান হওয়ার ছবক দেন, সেই শিক্ষক নিজেই যদি তার গবেষণায় চুরি করেন, তাহলে তার নিজের নৈতিকতা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? একজন চোর কী করে অন্যকে চুরি না করার পরামর্শ দেন?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //