বিজ্ঞাপনমুক্ত বিদেশি চ্যানেল

ক্লিনফিড বা বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেল চালানোর শর্ত দীর্ঘদিন ধরে পরিপালিত হয়নি; সম্প্রতি এই শর্ত পরিপালনের নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়।

কিছু চ্যানেল ক্লিনফিড থাকা সত্ত্বেও সেগুলোসহ সব বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ায় জনসাধারণ ও তথ্য মন্ত্রণালয় পরিবেশক এবং কেবল অপারেটরদের ওপর কিছুটা ক্ষুব্ধ। তবে বিজ্ঞাপন ছাড়া বিদেশি চ্যানেল থাকা, না থাকা নিয়ে সরকার এবং চ্যানেল পরিবেশকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ক্লিনফিড চ্যানেলের সঠিক সংখ্যা সরকারের কাছেও ছিল না; ক্লিনফিড চ্যানেলের তালিকা প্রকাশ করার পর সরকার পুনরায় তা সংশোধনও করেছে।

পরিবেশকদের অভিমত হচ্ছে, দু’একটি ছাড়া প্রায় সব চ্যানেলে বিজ্ঞাপন রয়েছে, তাই বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার করে তারা কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। ভারতীয় চ্যানেলের মালিকরা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে বিজ্ঞাপনমুক্ত কন্টেন্ট সরবরাহ করলেও আমাদের জন্য তা করতে সম্মত হচ্ছে না; বাংলাদেশে মার্কেটের আকার ছোট বিধায় ফিডক্লিন করে দেওয়ার খরচ তারা বহন করতে চাইছে না।

২০০৬ সালের কেবল টিভি আইনে একটি ধারায় উল্লেখ রয়েছে, যেসব বিদেশি চ্যানেল বাংলাদেশে ডাউনলিঙ্ক হবে সেই সব চ্যানেলে কোনো বিজ্ঞাপন থাকতে পারবে না। অধিকাংশ বিদেশি চ্যানেল আমরা পয়সা দিয়ে কিনে দেখি, বিনে পয়সায় নয়; পয়সা দিয়ে কেনা চ্যানেলে বিদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন দেখব কেন- যৌক্তিক কথা। এসব বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপনদাতা আমাদের কোনো পয়সা দেয়নি, বিজ্ঞাপন থেকে সরকার কোনো ট্যাক্সও পায়নি, অথচ বিনা খরচে বাংলাদেশের ১৭ কোটি দর্শকের কাছে বিদেশি পণ্যের প্রচার হয়ে গেছে, তাদের সেবা ও পণ্য কেনার জন্য আমরা উদ্বুদ্ধ হয়েছি, আমাদের দেশে তাদের পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের দেশের কোনো উৎপাদককে এই অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনোদিন প্রতিবাদ করতে দেখলাম না। 

ক্লিন ফিড থাকার অপরিহার্যতা আইনে থাকা সত্ত্বেও এতদিন যাবত বিদেশি চ্যানেল পরিবেশকরা আইনটিকে গুরুত্ব দেয়নি। অবশ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও নীরব ছিল, কোনো কারণে তারা চোখ বুঁজে ছিল প্রশ্ন করা দরকার। দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় ক্লিনফিড চ্যানেল দেখানো হয় বহু পূর্ব থেকে; কিন্তু আমাদের দেশে ক্লিনফিড নীতির বাস্তবায়ন করতে সরকারগুলো এতদিন গড়িমসি করেছে। যদিও এখন দু-একটি করে কলকাতার চ্যানেল এই শর্ত পূরণ করেই সম্প্রচার শুরু করেছে।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এই একটি বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে গণঅসন্তোষ হয়নি, সরকার গণমাধ্যমকে পরোক্ষভাবে বন্ধ করতে চাইছে এমন অভিযোগও কেউ করছে না। সরকার চাচ্ছে ক্লিনফিড চ্যানেল, আর দেশীয় চ্যানেলগুলো চাচ্ছে বিদেশি চ্যানেল বিশেষ করে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার আমাদের দেশে একেবারেই বন্ধ হয়ে যাক। কারণ তারা প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে চায় না, তারা চায় প্রতিযোগিতাবিহীন একচেটিয়া ব্যবসা। ভারতীয় চ্যানেল থাকলে দেশীয় চ্যানেলগুলোর দর্শক থাকে না এবং এ জন্য দেশীয় চ্যানেলগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই চ্যানেলগুলোর মালিকরা আরেকটি অভিযোগ করে থাকেন এবং তা হচ্ছে, ভারতে যেহেতু আমাদের চ্যানেলগুলো দেখানো হয় না, সেহেতু আমরাও তাদের চ্যানেল দেখাব না। কথাটি সত্য নয়। আমাদের চ্যানেলগুলো দেখানোর ব্যাপারে ভারত সরকারের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই; ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখাতে আইনগত বাধা না থাকলেও ভারতীয় সরকারের অত্যধিক চার্জ আরোপের কারণে সেখানকার কোনো ডিস্ট্রিবিউটর বাংলাদেশের চ্যানেল দেখাতে আগ্রহী হয় না। অপরদিকে ভারতীয় চ্যানেল বাংলাদেশে সম্প্রচারে সরকারের নির্ধারিত চার্জ অনেক কম। 

ব্যবসায়িক স্বার্থ ছাড়াও বাংলাদেশে ভারতীয় চ্যানেল সম্প্রচারের ঘোরবিরোধী একটি শ্রেণি রয়েছে। ২০১২ এবং ২০১৪ সালে ভারতীয় চ্যানেল সম্প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে রিট করা হয়েছিল। কিছু মানুষ এখনো পাকিস্তানের বিভাজনে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে মেনে নিতে পারছে না এবং পাকিস্তানের বিভাজনের জন্য তারা ভারতকেই দায়ী করে থাকে। পেঁয়াজের দাম বেড়ে গেলে এরা সরকারের সমালোচনা করে থাকে সত্য; কিন্তু ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা এরা পছন্দ করে না। ভারতের যে কোনো ক্ষতি এদের উদ্বেলিত করে, আনন্দ দেয়।

ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া হলে এই শ্রেণির লোকগুলো যারপরনাই খুশি হয়; চীনের সঙ্গে বাণিজ্য-বৈষম্য ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হলেও তাদের কোনো উচ্চবাচ্য থাকে না। তাদের আরেকটি ধারণা, ভারতীয় চ্যানেলগুলো থাকায় বাঙালির সংস্কৃতি আজ বিপন্ন; তাই এগুলো বন্ধ থাকলে দেশি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে, বিদেশি ভারতীয় সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে আমরা মুক্তি পাব।

খিলাফত যুগে তুরস্কের রাজ-বাদশাহর অন্দরমহলের কুরুচিপূর্ণ আচরণ সংবলিত সিনেমার বিরুদ্ধে এরা কিন্তু একটি কথাও বলে না। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, এরা ভারতীয় সংস্কৃতি যেমন পছন্দ করে না তেমনি বাঙালির সংস্কৃতিও বিশ্বাস করে না, এদের বিশ্বাস ও আস্থা স্থবির ধর্মীয় সংস্কৃতিতে। 

উল্লিখিত বিভিন্ন কারণে ভারতীয় চ্যানেলগুলোর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা রয়েছে, অসংখ্য ব্যাঙ্গাত্মক কৌতুকের ছড়াছড়িও দেখা যায়। অবশ্য রুচিশীল দর্শকরাও সিরিয়াল সমৃদ্ধ ভারতীয় চ্যানেলগুলো পছন্দ করে না, পছন্দ করার কোনো যুক্তিসম্মত কারণও নেই। প্রায় প্রতিটি সিরিয়াল টানতে টানতে অসহনীয়ভাবে দীর্ঘায়িত করা হয়। শাশুড়ি-বউমার ঝগড়া, তৃতীয় ব্যক্তির সংসার ভাঙার কূটনামি প্রায় প্রতিটি সিরিয়ালে লক্ষ্য করা যায়; উদ্ভট কল্পনার অসংলগ্ন কাহিনীর বিন্যাসে প্রতিটি সিরিয়াল একঘেয়েমিতে ভরা। কাহিনীর কোনো অগ্রগতি নেই, বিকাশও নেই, লাটিমের মতো একই বৃত্তে ঘুরপাক খায়। এই কারণে মধ্যখানে দু-একটি পর্ব মিস করলেও দর্শকদের পরবর্তী পর্বগুলো বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। 

ভারতীয় চ্যানেলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগই থাকুক না কেন, বাংলাদেশে টিভি চ্যানেলের মান উন্নত না হলে দর্শক কমতেই থাকবে। দর্শক যেখানে বিজ্ঞাপনও সেখানে যাবে। তাই ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হলেই যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন দেশি চ্যানেলগুলো পাবে এমন নিশ্চয়তাও নেই। ভারতীয় চ্যানেল বন্ধ হওয়ার পর গৃহিণীরা ভারতীয় চ্যানেলের প্রোগ্রামগুলো ইউটিউব থেকে ডাউনলোড করে মোবাইল বা ল্যাপটপে দেখছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে এদের থামানো যাবে না। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশেও একক কোনো সংস্কৃতি নেই, অঞ্চলভেদে সংস্কৃতির ভিন্নতা সুস্পষ্ট।

পৃথিবীর কোনো জাতি, উপজাতির সংস্কৃতিই স্থির নয়, আবর্তিত হচ্ছে। সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে তো এখনো মানবজাতির উলঙ্গ থাকার কথা, কাঁচা মাংস খাওয়ার কথা, গাছের বাকল পরার কথা, তাঁবুতে বসবাস করার কথা। শার্ট, প্যান্ট, টাই, স্যুট, শাড়ি, ব্লাউজ, লিপিস্টিক আমাদের সংস্কৃতি নয়; কিন্তু এখন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিনোদনমূলক প্রোগ্রামগুলো তৈরি করার ক্ষেত্রে মেধার চর্চা অপরিহার্য।

লেখক- সাবেক নির্বাহী পরিচালক
বাংলাদেশ ব্যাংক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //