রফতানি আয়ের উৎস পাট নিয়ে তথ্য পর্যালোচনা

সোনালি আঁশ পাট। এক সময় ছিল প্রধান অর্থকরী ফসল। সময়ের বিবর্তনে আগের অবস্থান নেই; কিন্তু পাট এখনো রফতানিযোগ্য পণ্য। গত অর্থবছরে এই খাত থেকে উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে।

পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ এক যুগের রেকর্ড ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬.১৪ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। এটি হঠাৎ কোনো অর্জন নয়। রফতানির একটি ধারা পাট ও পাটজাত পণ্য অবদান রাখছে দীর্ঘদিন ধরে। এই ধারাটিকে বেগবান করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে পাট সম্পর্কিত কিছু প্রকাশিত তথ্য সংগ্রহ করেছি। পাঠক বিচার করবেন, পাট খাত কি উপেক্ষিত থাকবে, না একে সমর্থন জোগানো উচিত?

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই বছর সাড়ে আট লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে কম-বেশি ৯০ লাখ বেল (১৮২ কেজিতে এক বেল)। প্রতি বিঘায় গড়ে ৯ মণ পাট চাষ হয়েছে। বেশিরভাগ স্থানে প্রতি মণ পাট বিক্রি হয়েছে তিন হাজার টাকার ওপরে।

বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ৭ দশমিক শূন্য ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ হয়েছিল। সেই বছর মোট উৎপাদন হয়েছিল ১৫ দশমিক ২৬ লাখ টন। সে হিসাবে এই বছর উৎপাদন দাঁড়াতে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টন।

বাজারে এই বছর চালের দাম গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছেছে। বর্তমানে চালের দাম অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে; কিন্তু সেই দামকেও টেক্কা দিয়েছে পাট। এই বছরের শুরুর দিকে মজুদ পাটের দাম ছয় হাজার টাকার ওপরে বিক্রি হয়েছে। পাটকাঠি থেকে উচ্চমূল্যের অ্যাকটিভেটেড চারকোল উৎপাদন করে বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপিয়ারের কালি, আতশবাজি ও ফেসওয়াশের উপকরণ, ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্ল্যান্ট, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠির অর্ধেকও যদি সঠিকভাবে চারকোল উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। 

এ ছাড়া পাট কাটিংস ও নিম্নমানের পাটের সঙ্গে নির্দিষ্ট অনুপাতে নারিকেলের ছোবড়ার সংমিশ্রণে প্রস্তুত করা হয় পরিবেশবান্ধব এবং ব্যয় সাশ্রয়ী জুট জিওটেক্সটাইল, যা ভূমিক্ষয় রোধ, রাস্তা ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদীর পাড় রক্ষা ও পাহাড়ধস রোধে ব্যবহৃত হচ্ছে। জিওটেক্সটাইলের অভ্যন্তরীণ বাজার এখন ৭০০ কোটি টাকার। 

ভেষজ হিসেবে পাটপাতা বহুল ব্যবহৃত একটি উপাদেয় শাক এবং শুকনো পাট পাতার পানীয় ‘চায়ের বিকল্প’ হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) পাটের পাতা দিয়ে অর্গানিক চা উৎপাদন শুরু করে এবং বর্তমানে ঢাকার উত্তরায় গুয়ার্ছি অ্যাকুয়া এগ্রোটেক নামক একটি প্রতিষ্ঠান পাটের পাতা দিয়ে তৈরি অর্গানিক চা জার্মানিতে রফতানি করছে। সম্প্রতি পাটের পাতা থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন সবুজ চা উৎপাদন বড় পরিসরে শুরু করতে জামালপুরের সরিষাবাড়িতে একটি কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। 

আঁশ ছাড়াও কেনাফ বীজ থেকে ভোজ্যতেল এবং মেস্তার মাংসাল বৃতি (শাঁস) থেকে জ্যাম, জেলি, জুস, আচার, চা ইত্যাদি প্রস্তুতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পাটে প্রায় ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ সেলুলোজ রয়েছে। পাট থেকে পাল্প তৈরি করে পুনরায় সেলুলোজ রি জেনারেট করে ভিসকস তৈরি করা সম্ভব। আর এই ভিসকস তৈরি করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করবে।

পাটের ব্যবহার এখন বহুবিধ। পাট দিয়ে শাড়ি, লুঙ্গি, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, বাহারি ব্যাগ, খেলনা, শোপিস, ওয়ালমেট, আল্পনা, দৃশ্যাবলি, নকশিকাঁথা, পাপোশ, জুতা, স্যান্ডেল, শিকা, দড়ি, সুতলি, দরজা-জানালার পর্দার কাপড়, গহনা ও গহনার বক্সসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য দেশে ও বিদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোতে পাটজাত পণ্যের রফতানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বের গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনস্যুলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন পাটের জাতের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্যগুলো যুক্ত করতে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে যার চাহিদা রয়েছে। 

বাংলাদেশের পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, সারা বিশ্বে এখন প্লাস্টিক বা সিনথেটিক ফাইবার বাদ দিয়ে ন্যাচারাল ফাইবারের একটা ডিমান্ড তৈরি হয়েছে। নানা ধরণের পণ্য তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে পাটে বিনিয়োগ হয়েছে, যারা পাট দিয়ে পণ্য তৈরি করে বিদেশে রফতানি করছে। ফলে এই খাতে একটা প্রতিযোগিতার বাজার তৈরি হয়েছে। তারা কৃষকের কাছ থেকে বেশি দামে পাট কিনছে। তাই পাটের চাহিদাও বাড়ছে, দামও বেড়েছে।

গত বছরের আগে পাটের সর্বোচ্চ মূল্য উঠেছিল আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা; কিন্তু গত বছর সর্বোচ্চ ছয়-সাত হাজার টাকা দরেও পাটের মণ বিক্রি হয়েছে। পাট খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, প্রতিবেশী ভারতেও পাটের বড় একটি বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতে কাঁচা পাট রফতানির পাশাপাশি অবৈধ পথেও পাট পাচার হয়ে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

পাটজাত পণ্য রফতানিকারকরা বলছেন, পাটের এত দাম বৃদ্ধির কারণ একটি অসাধু মহল পাট মজুদ করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আরেকটি কারণ, আমাদের পাশের দেশে বেশ কিছু পাট চলে গেছে। যে কারণে আড়াই হাজার টাকার পাটের মণ ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত এসব পাটের কাঁচামাল ভারতেই সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় এবং বিদেশি ক্রেতারা এই পণ্যগুলো ভারতের কাছ থেকে কিনে থাকে। বাংলাদেশে পাট দিয়ে পাট সুতা, দড়ি, বস্তা, প্যাকিং সরঞ্জাম, ব্যাগ বা থলে, হাতে বাছাই করা আঁশ, পাটজাত কাপড় বহুদিন ধরে তৈরি হয়।

পাটের তৈরি টব, খেলনা, জুট ডেনিম, জুয়েলারি, ম্যাটস, নারী-পুরুষের জুতা স্যান্ডেল, বাস্কেট, পাটের শাড়ি, পাঞ্জাবি ও পাটের তৈরি গৃহস্থালি নানা সরঞ্জামের বিদেশে চাহিদা তৈরি হয়েছে। প্রধানত আমেরিকা ও ইউরোপীয় দেশগুলোয় এই জাতীয় পণ্য রফতানি করা হয়। আফ্রিকান দেশগুলো বস্তা ও পাটজাত দড়ি বেশি রফতানি হয়। পাটের আঁশের পাশাপাশি পাটখড়ি পার্টিকেল বোর্ড, কম্পোজিট, সেলুলয়েডে ব্যবহার হয়।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এক যুগের রেকর্ড ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে ১১৬.১৪ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে। পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় গত বছর পাটজাত পণ্য রফতানি বেড়েছে ৩১ শতাংশ বেসরকারি খাত পাটপণ্য তৈরি ও রফতানি করলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকল লোকসানের কারণে গত বছরের পহেলা জুলাই থেকে বন্ধ রয়েছে।

অনেক কৃষক এই বছর আরও বেশি জমিতে পাট চাষে আগ্রহী হয়েছেন। তবে রফতানিকারকদের আশঙ্কা পাটের দাম এরকম বেশি থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বাংলাদেশের জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক বিবিসি বাংলাকে বলছেন, পাটের বেশি দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের প্রোডাক্টের দাম বাড়াতে হয়েছে, কিন্তু রফতানির আকার বাড়েনি। ফলে তারা সুইচ করে অন্য প্রোডাক্টে চলে যাচ্ছে। দামটা এরকম ওঠানামা করলে ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি হবে। পাটের দাম একটি স্থিতাবস্থায় বেঁধে দেওয়া সম্ভব হলে কৃষক ও ব্যবসায়ী- উভয়েই লাভবান হবে।

পাঠক লক্ষ্য করবেন, পরিবেশসম্মত পণ্য হিসাবে পাটের বাজার শুধু ধরে রাখলেই হবে না, একে বিকল্প পণ্যের বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় রাখাটাও জরুরি। সেক্ষেত্রে পাটের সংগ্রহ মূল্য প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। না হলে কোনো বছরে বাজারমূল্যের উল্লম্ফন ও কোন বছরে দর পতন পাটচাষির জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

একটি ভারসাম্যমূলক পাটের অভ্যন্তরীণ বাজার তথা রফতানির উদ্যোগ এই অবহেলিত ক্ষেত্র থেকেও আমাদের জন্য রফতানি আয় যেমন নিশ্চিত করবে ঠিক তেমনি পাটচাষি ও পাটকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্যও সুবাতাস বয়ে আনতে পারবে- এতে কোনো সন্দেহ নেই।


লেখক- কথাসাহিত্যিক ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //