স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের বামপন্থীরা

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পরবর্তীতে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের বিশাল অবদানকে উপেক্ষা করার একটি প্রবণতা রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে অথবা মিডিয়ার প্রচারের ক্ষেত্রেও। 

বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল গোড়া থেকেই। মওলানা ভাসানী একদা মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তান-পরবর্তীকালে ভাসানীর যে উত্তরণ ঘটেছিল, তাতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী; শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী মানুষের সমর্থক ও প্রচারক এবং কমিউনিস্টদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। তাই পাকিস্তান আমলে ভাসানীই ছিলেন সব বামপন্থীর নেতা। ষাটের দশকে কমিউনিস্ট শিবিরে বিভক্তি ও বহুধা বিভক্তি এসেছিল।

কমিউনিস্টদের কোনো কোনো অংশের সঙ্গে ভাসানীর সম্পর্কের অবনতিও হয়েছিল। আবার কমিউনিস্টদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তত্ত্বও উপস্থিত করেছিল। এ সব কারণে বুর্জোয়া ইতিহাসবিদ ও লেখক এবং মিডিয়ার পক্ষে সহজ হয়েছিল বামপন্থীদের সম্বন্ধে একটি নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরে ইতিহাসের বিকৃতি সাধন করা। ভাষা আন্দোলনের পেছনেও ছিল আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট পার্টি। সামনের কাতারে থেকে যারা ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পরবর্তী জীবনে তাদের অধিকাংশ বামপন্থী শিবিরের সঙ্গেই ছিলেন।

স্বায়ত্তশাসনের প্রসঙ্গটি প্রায় প্রথম থেকেই উত্থাপিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে এককভাবে যার অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৪৮ সালেই মওলানা ভাসানী প্রথম পূর্ব পাকিস্তানের আইন পরিষদে প্রদেশের জন্য অধিকতর ক্ষমতার দাবি উত্থাপন করে বলেন, ‘ব্রিটিশের শাসন মানি নাই, এবারও কেন্দ্রের হুকুমদারি মানবো না।’ ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়েছিল, সেই দলের সেই সময়ের কর্মসূচিতেও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি গুরুত্বসহকারে স্থান পেয়েছিল। পরবর্তীকালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগেই দলটির নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং জনগণেরও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উত্তরণের ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই রকম একটার পর একটা পথ অতিক্রম করেই চব্বিশ বছরের মাথায় এসে জনগণ প্রস্তুত হয়েছিল, সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে- যে পাকিস্তানের জন্য একদা এই দেশের জনগণই ভোট দিয়েছিল।

স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ও তার কমিউনিস্ট বন্ধুরা বরাবরের মতোই দৃঢ় ছিলেন; কিন্তু সোহরাওয়ার্দী বললেন, পাকিস্তানের সংবিধানে নাকি ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে। জনগণকে বোকা বানানোর এবং জাতীয় স্বার্থকে বিকিয়ে দেওয়ার এটা ছিল অনৈতিক কৌশল। সেই সময় বিখ্যাত কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী যে ঐতিহাসিক ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেছিলেন সেটাই ছিল প্রথম প্রকাশ্য বিচ্ছিন্ন হওয়ার হুমকি। যদি ঐতিহাসিকভাবে বিচার করতে হয়, তাহলে দেখবো যে, এটাই ছিল প্রথম স্বাধীনতার ডাক; কিন্তু স্বাধীনতার জন্য সময় তখনো প্রস্তুত ছিল না। এর ঠিক ১০ বছর পর ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে ব্যাখ্যা করে খুবই র‌্যাডিক্যাল ছয় দফা পেশ করেছিলেন, তখন তা সারাদেশে অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। অথচ ১৯৫৬ সালে দুর্ভাগ্যক্রমে সেদিনের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান উপরোক্ত দুটি প্রশ্নেই সোহরাওয়ার্দীর সমর্থনে দাঁড়িয়েছিলেন। ফলে ভাসানীকে ত্যাগ করতে হলো নিজের হাতে গড়া দল এবং তিনি গঠন করলেন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ছয় দফা দেওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে দৃঢ় ছিল না। অন্যদিকে ভাসানী ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের দাবিতে ছিল অবিচল। ষাটের দশকে আন্তর্জাতিকভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হলে, আমাদের দেশেও তার প্রভাব পড়ে; কিন্তু কমিউনিস্টদের সব অংশ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার ছিলেন।

১৯৬৬ সালে আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। সুখেন্দু দস্তিদার-মহম্মদ তোয়াহা-আবদুল হকের নেতৃত্বাধীন মার্কসবাদী লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসে (১৯৬৭) গৃহীত কর্মসূচিতে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার’ শ্লোগান তোলা হয়েছিল। এই প্রথম কোনো একটি পার্টি তার লিখিত দলিলে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিল। মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি ষাটের দশকে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল; কিন্তু সেখানে বলা ছিল, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে একইসঙ্গে বিপ্লব হবে না। তার মানে প্রকারান্তরে কমিউনিস্টদের উভয় অংশেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বতন্ত্রভাবে বিপ্লবের কথা ভেবেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য স্বাধীন হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই, এমন ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন বামপন্থীরাই। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবি তুলে ধরার পর আওয়ামী লীগের তরুণ অংশের মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে।

১৯৬৮-৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়ও জাতীয়তাবাদী চেতনার উল্লম্ফন ঘটেছিল; কিন্তু তখনো প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ডাক আসেনি। অবশ্য সেই সময় কমিউনিস্টদের বিভিন্ন অংশ এবং তাদের ছাত্র সংগঠনসমূহ স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার স্লোগান তুলেছিলেন। সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন বাংলার স্বাধীনতাকে মূল কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ১৯৭০ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের একাংশের নেতৃত্বে পল্টনের জনসভা থেকে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র কর্মসূচি প্রকাশ্যে উত্থাপন করা হয়েছিল। এটাই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিল। এর জন্য উক্ত সভায় বক্তৃতা করার অপরাধে সামরিক আদালত কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননকে সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল, তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার করে। একইভাবে মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাহ এক বছর কারাদণ্ডের সাজা লাভ করেছিলেন।

১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনো পরিপূর্ণভাবে লেখা হয়নি। এ কথা ঠিক, এ যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল আওয়ামী লীগের হাতে। ইতিপূর্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র বিজয়ের কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়টি তখনেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। তারাই গঠন করেছিল প্রবাসী সরকার। আর শেখ মুজিব তখন পাকিস্তানে আটক থাকলেও যুদ্ধরত মানুষের জন্য তিনিই ছিলেন সব অনুপ্রেরণার উৎস।

কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগের একক অবদান বলে চিত্রিত করার যে প্রয়াস দেখা যায়, তা সর্বৈব ভ্রান্ত! এই মুক্তিযুদ্ধে অনেকগুলো স্রোত ছিল। বামপন্থীদের একটি ক্ষুদ্র অংশ যুদ্ধ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তত্ত্ব হাজির করেছিল এবং আন্তর্জাতিকভাবে চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এই দুই কারণে বামপন্থীদের বিশাল অবদান কিছুটা খাটো হয়ে গিয়েছিল। বুর্জোয়া লেখকরাও এ কথাকে সামনে এনে বামপন্থীদের ভূমিকাকে অস্বীকার করার সুযোগ পেয়েছেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যে নানাবিধ স্রোত ছিল তার সবটার খবর প্রবাসী সরকার জানতো না এবং সরকারি মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণেও সবটা ছিল না।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর থেকে বিভিন্ন জায়গায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছোট ছোট সশস্ত্র বাহিনী গড়ে ওঠে। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। মার্চের শেষ সপ্তাহেই প্রথমে থানার রাইফেল নিয়ে এবং পরে পশ্চাৎপসরণরত বাঙালি সৈনিক ও ইপিআর সদস্যদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র সংগ্রহ করে শিবপুরে গঠিত হয়েছিল মুক্তিফৌজ। তখনো প্রবাসী সরকার গঠিত হয়নি; কিন্তু সে জন্য নরসিংদী জেলার শিবপুরের মুক্তিকামী তরুণরা অপেক্ষা করেননি। মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে শিবপুরের এই মুক্তিযুদ্ধ ছিল অসম সাহসী এক যুদ্ধ, যার পরিচালনায় ছিলেন বামপন্থীরা। এ রকম বামপন্থীরা এবং অন্যরাও বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে সশস্ত্র যুদ্ধ সংঘটিত করেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত লিপিবদ্ধ করে ইতিহাস রূপে তুলে ধরা হয়নি।

১৯৭১ সালের ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় যুদ্ধরত কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দল এবং গণসংগঠনসমূহ মিলিত হয়ে গঠন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। এ সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণাপত্র তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করেই সমন্বয় কমিটি সরকারকে সহযোগিতা যেমন করবে, তেমনি স্বতন্ত্রভাবেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবে। 

এ সমন্বয় কমিটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দল ছিল ন্যাপ (ভাসানী) ও ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ যার নেতৃত্বে সারাদেশে ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটি এলাকা ছিল। প্রধান ঘাঁটি ছিল নরসিংদী জেলার শিবপুরে। সীমান্ত থেকে বহু দূরে ও রাজধানীর নিকটস্থ এ শিবপুরে অসংখ্য যুদ্ধ হয়েছে এবং অনেকে শহীদ হয়েছেন। এ অঞ্চলের বামপন্থী বিপ্লবীরাই ডিসেম্বরে নরসিংদীতে অবস্থিত পাকিস্তানের মিলিটারি ক্যাম্প দখল করেছিলেন। শিবপুরের যুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এই যুদ্ধ সম্পর্কিত একটি বই রচনা করেছেন হায়দার আনোয়ার খান জুনো- ‘একাত্তরের রণাঙ্গন-শিবপুর।’ এ বইটিকে একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে ধরা যেতে পারে এবং বামপন্থীদের অধীনস্থ ঘাটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ ও প্রশাসনিক সামাজিক ব্যবস্থা কেমন ছিল, তার একটা ধারণাও পাওয়া যেতে পারে।

শিবপুর থেকে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। এ ছাড়া ভারতের কলকাতা ও আগরতলা থেকেও মুক্তাঞ্চলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা হয়েছিল। সমন্বয় কমিটির যুদ্ধ কৌশল ছিল দ্বিবিধ। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাঁটি গড়ে যুদ্ধ করা। সেক্ষেত্রে প্রধানত শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্রই ছিল আমাদের অস্ত্র সংগ্রহের প্রধান উৎস। আমরা ভারত সরকারের কোনো রকম সাহায্য পাইনি। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে আমাদের কর্মীদের ঢুকিয়ে দেওয়া। কারণ মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুট করার ক্ষেত্রে বাম কমিউনিস্ট ন্যাপ কর্মীদের বাদ দেওয়ার নির্দেশ ছিল। তবে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নুরুজ্জামান (তিনি নিজেও মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন), মেজর জলিল, মেজর মনজুর আহমেদ প্রমুখের যথেষ্ট সহযোগিতা আমরা পেয়েছিলাম। তারা বামপন্থীদের ঘাটি এলাকায় অস্ত্র সরবরাহ পর্যন্ত করেছিলেন। বামপন্থীদের পক্ষে সবচেয়ে আন্তরিক ছিলেন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামান।

বামপন্থীদের আরেক অংশ মনি সিংহের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলিতভাবে বাহিনী গড়ে তুলেছিল, যা ছিল সরকারি মুক্তিফৌজ থেকে স্বতন্ত্র। ভারত সরকার তাদের স্বতন্ত্রভাবে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রীর কারণে ভারত সরকার এটা করতে বাধ্য হয়েছিল। সিপিবির মনজুরুল আহসান খান এই বাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলেন, যার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের সাতজন সদস্য বেতিয়ারার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।

বামপন্থীদের অন্যান্য অংশের মধ্যে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিসেনারা বরিশাল ও ঢাকার কয়েকটি অঞ্চলে সাহসী যুদ্ধ করেছেন। যুদ্ধ সম্পর্কে মূল্যায়নে ভ্রান্তি থাকলেও ইপিসিপি-এর বিভিন্ন অংশও বিচ্ছিন্নভাবে সাহসী যুদ্ধ করেছেন। যেমন- নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ এলাকায় যথা- চর জঙ্গলিয়া ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে ঘাঁটি এলাকা তৈরি হয়েছিল মহম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে। সশস্ত্র তৎপরতা রামগতি ও সুধারাম থানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

দেবেন শিকদার, আবুল বশারের নেতৃত্বাধীন বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বিএম কলিমুল্লাহর নেতৃত্বে চাঁদপুরে এক বিশাল বাহিনী ও ঘাটি এলাকা গড়ে উঠেছিল। ঢাকায় যুদ্ধরত ক্রাক প্লাটুনেও ছিলেন বামপন্থী ছাত্র কর্মীরা। কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটির অধীনস্থ বরিশাল অঞ্চলের যুদ্ধ (অধ্যাপক আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন), কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অঞ্চলের যুদ্ধ, বাগেরহাটে রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ ও বিশাল গেরিলা বাহিনী এবং সাতক্ষীরার তালা থানায় কামেল বখতের নেতৃত্বাধীন গেরিলা সংগ্রাম বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। 

এ ছোট নিবন্ধটি লিখতে লিখতে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল কামেল বখতের বুদ্ধিদীপ্তি ও তারুণ্যে ভাস্বর চেহারাটি। তিনি ছিলেন সাতক্ষীরার তালা অঞ্চলে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির সংগঠক। তালায় তার নেতৃত্বে বিশাল মুক্ত অঞ্চল গড়ে উঠেছিল। নভেম্বরের কোনো এক সময় তিনি এসেছিলেন কলকাতায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এবং তালার পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্ট করতে। ঠিক হয়েছিল আমিও যাব তালায়। দিন তারিখ ঠিক হয়েছিল। যাওয়ার পথ জানা ছিল; কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখের আগেই আরেকটি খবর এলো। কামেল বখত নিহত হয়েছেন। শোনা গেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো অংশ ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল বিশ্বাসঘাতকতা করে। এ রকম আরও অনেকের কথাই মনে পড়ছে। সব নাম লেখা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও সব নামই সংরক্ষিত হওয়া দরকার। বেশি দেরি হলে শহীদদের নামও হারিয়ে যাবে।

মুক্তিযুদ্ধে যার যা অবদান তা যেন আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখি। বামপন্থীদের ভূমিকাসহ সবার ভূমিকাকেই ইতিহাসের পাতায় স্থান দিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অবিকৃত ইতিহাস তুলে ধরার কাজটিই হবে ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সৎ রাজনীতিবিদদের কর্তব্য।

লেখক : বাম রাজনীতিবিদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //