ছোটদের আন্দোলন আর বড়দের অপপ্রচার

বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে এই অজুহাতে ডিজেল আর কেরোসিনের দাম বাড়ানো হলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে অসহায়ত্বের চেয়ে বেশি। তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে আবার বাড়িয়ে দেওয়া হলো বাসের ভাড়া। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ করলেন; কিন্তু সরকার কোনো প্রতিবাদ বা যুক্তিকেই গ্রাহ্য করলেন না। যথারীতি অস্বাভাবিক হারে বাসের ভাড়া বেড়ে গেল। 

তেলের দাম বাড়লে বাসের ভাড়া কত বাড়তে পারে তার একটা হিসাব করে বিশেষজ্ঞরা বললেন, পরিচালনা ব্যয়ের ২৫ শতাংশ জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভর করে। সে হিসাবে জ্বালানি তেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়লে পরিবহন ব্যয় ৬ থেকে ৭ শতাংশ বাড়তে পারে; কিন্তু বাড়ানো হলো ২৭ শতাংশ। 

সাধারণ মানুষ শুনলেন হিসাবের কথা, রাস্তায় মিছিল দেখলেন কিন্তু নিজেরা পথে নামলেন না। শুধু জ্বালানি তেল আর বাসভাড়া বৃদ্ধি নয়, দেশে গণতন্ত্রহীনতা, অর্থনীতিতে লুণ্ঠন, কর্মহীন মানুষের অসহায়ত্ব, দুর্বৃত্তদের আধিপত্য, দ্রব্যমূল্যের আঘাত, গণমানুষের অধিকারহীনতা, নির্বাচনি সহিংসতা, শ্রমিকের মজুরি ও চাকরির অনিশ্চয়তা, নারীর নিরাপত্তাসহ কত সমস্যা! আন্দোলন চলছে মানুষ অংশগ্রহণ করছে না। শাসক শ্রেণির পোয়াবারো। যাই বলুক আর যাই করুক না কেন, কোনো প্রতিরোধ নেই।  

এই ঘাড় গুঁজে সব মেনে নেওয়ার অসহনীয় পরিবেশে দমকা হাওয়ার মতো নেমে এলো শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি পরিবহনে হাফ পাস চাই। হাফ পাস আমাদের অধিকার। এর আগে সড়কে সহপাঠীর মৃত্যুর প্রতিবাদ করতে গিয়ে শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন। কয়েকদিনের সেই আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা দেখিয়ে দিয়েছিল কীভাবে সড়কে শৃঙ্খলা আনা যায়। শৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজন নিরপেক্ষতা। কেউ আইন ভেঙে রেহাই পাবে না এই দৃঢ় মানসিকতা থাকলে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়- সেই দৃষ্টান্ত দেখিয়েছিল তারা। এবারের আন্দোলনেও তারা তাদের যুক্তি তুলে ধরেছে। তাদের আন্দোলন প্রথমে ৯ দফা পরে ১১ দফার আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। 

একটু খেয়াল করলে বোঝা যাবে শুধু হাফ পাস নয়, শিক্ষার্থীরা ভেবেছে অনেক বিষয় নিয়ে। তাদের দাবিগুলো যেমন- 

১.সড়কে নির্মম কাঠামোগত হত্যার শিকার নাঈম ও মাইনুদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পথচারি পারাপারের জন্য পদচারি-সেতুনির্মাণ করতে হবে।

২. সারাদেশে সব গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ পাস সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। হাফ পাসের জন্য কোনো সময় বা দিন নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে না। বর্ধিত বাসভাড়া প্রত্যাহার করতে হবে। সব রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।

৩. গণপরিবহনে ছাত্রছাত্রী এবং নারীদের অবাধ যাত্রা ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

৪. ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালককে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএ’র দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৫. সব রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করাসহ জনবহুল রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

৬. বাসগুলোর মধ্যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা বন্ধে এক রুটে এক বাস এবং দৈনিক আয় সব পরিবহন মালিকের মধ্যে তাঁদের অংশ অনুয়ায়ী সমানভাবে বণ্টন করার নিয়ম চালু করতে হবে।

৭. শ্রমিকদের নিয়োগ ও পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। চুক্তি ভিত্তিতে বাস দেওয়ার বদলে টিকিট ও কাউন্টারের ভিত্তিতে গোটা পরিবহনব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।

৮. গাড়িচালকের কর্মঘণ্টা একনাগাড়ে ছয় ঘণ্টার বেশি হওয়া যাবে না। প্রতিটি বাসে দু’জন চালক ও দু’জন সহকারী রাখতে হবে। পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৯. যাত্রী-পরিবহন শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

১০. ট্রাক, ময়লার গাড়িসহ অন্যান্য ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে।

১১. মাদকাসক্তি নিরসনে গোটা সমাজে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চালক-সহকারীদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্ট ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। 

শিক্ষার্থীদের এই দাবিগুলো বিবেচনায় নিলে একটা সামগ্রিক সমাধানের পথে পা ফেলা যাবে। 

অন্যদিকে হাফ পাসের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলাকালেই ঢাকায় তিনটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি গুলিস্তানে চাপা দেয় নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানকে। উত্তর সিটি করপোরেশনের আরেকটি ময়লার গাড়ি পান্থপথে সংবাদকর্মী আহসান কবীর খানকে চাপা দেয়। আর রামপুরায় দুই পরিবহনের দুটি বাস প্রতিযোগিতা করে চালাতে গিয়ে মাইনুদ্দিন ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে চাপা দেয়, সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। জানা গেছে, দুই সিটি করপোরেশনের গাড়ি যারা চালাচ্ছিলেন, তারা কেউ সিটি করপোরেশনের লাইসেন্সধারী চালক নন। তারা বৈধ প্রতিষ্ঠানের অবৈধ গাড়ি চালক! 

একদিকে আন্দোলন, অন্যদিকে সড়কে মৃত্যুর মধ্যে বলা হয়েছে, সরকারি বাসে হাফ ভাড়ার বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থা (বিআরটিসি); কিন্তু বেসরকারি বাস মালিকদের হাফ ভাড়া ঘোষণার বিষয়ে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হবে না। তাহলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা কীভাবে আশ্বস্ত হবে? তাই তারা দাবি তুলেছে প্রজ্ঞাপনে অর্ধেক ভাড়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে হাফ ভাড়ার জন্য বেশকিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে মালিক সমিতি। শিক্ষার্থীদের নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অর্ধেক ভাড়ার সুবিধা দেওয়া হবে। সরকারি, সাপ্তাহিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মৌসুমি ছুটির সময় অর্ধেক ভাড়া কার্যকর হবে না।

ফলে কিছু নতুন জটিলতা তৈরি হবে। কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির বিষয়টি একটু ভিন্ন প্রকৃতির। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বার্ষিক ছুটির তালিকা অনুযায়ী, সাপ্তাহিক ছুটি বাদে বছরে স্কুল-কলেজে ৮৫ দিনের ছুটি থাকে। বছরে ৫২টি শুক্রবার রয়েছে। সেই হিসাবে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৩৭ দিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকে। বছরে তিনটি পরীক্ষার জন্য ৩৬ দিন সময় নির্ধারণ করা রয়েছে। সেই সময়ে শ্রেণিভেদে আরও কিছুদিন ছুটি পায় শিক্ষার্থীরা।

আবার রাজধানীসহ দেশের বড় বড় বেসরকারি স্কুল-কলেজে সাপ্তাহিক ছুটি থাকে দুইদিন। সেক্ষেত্রে ৮৫ দিনের সরকারি ছুটিসহ তাদের বছরে মোট ছুটি থাকে ১৮৯ দিন। এসব স্কুল-কলেজ ৩৬৫ দিনের মধ্যে খোলা থাকে ১৭৬দিন।

স্বায়ত্তশাসিত বলে ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির তালিকা করে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল। সে ক্ষেত্রে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে কিছু ভিন্নতা হয়। তবে সাধারণত গড়ে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটিসহ কমপক্ষে ১৩৭ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। ফলে ছুটির বিষয়টি বেশ জটিল। 

আর বিআরটিএ’র এই ব্যাখ্যা কতটা যৌক্তিক এ ব্যাপারে আইনজীবীদের ব্যাখ্যা হলো, সরকারের সংস্থা হিসেবে জনগণের স্বার্থ রক্ষায় পরিবহন মালিক সমিতিকে তাদের ঘোষণা লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে দিতে বাধ্য করতে পারে বিআরটিএ। এই লিখিত ঘোষণাকে বিবেচনায় নিয়ে বিআরটিএ প্রজ্ঞাপন জারির ব্যবস্থা নিতে পারে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হকের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত এসেছে, সেই ঘোষণা দেওয়ার এখতিয়ার পরিবহন সমিতিকে কে দিয়েছে? নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিআরটিএ হচ্ছে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ। তাই ঘোষণা বিআরটিএ থেকে আসা উচিত। 

তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা ভাড়ার তালিকা হতে পারে। বাসে দুই তালিকা ঝোলাতে যদি সমস্যা হয়, তাহলে এক তালিকাতেই ছাত্রদের জন্য আলাদা কলাম করে ভাড়া উল্লেখ করে দিলেই সমস্যা চুকে যায়। 

এই যে হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে এলো তাদের ধমক দিয়ে, মেরে, মামলা দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া যাবে; কিন্তু এর ফল বর্তমানের জন্য কিংবা ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে কখনোই ভালো হবে না। ছাত্ররা ঘরে থাক, তোমাদের কাজ পড়াশোনা করা এই উপদেশ দেওয়া ভালো; কিন্তু ছাত্ররা যখন বাইরে অনিয়ম আর অরাজকতা দেখে, দেখে তার শিক্ষার খরচ ক্রমাগত বাড়ছে, খেয়াল করে মা-বাবার চিন্তাক্লিষ্ট মুখ, যখন দেখে মুনাফা শিকারির অসহায় শিকারে পরিণত হচ্ছে মানুষ, তখন প্রতিবাদী হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

এই প্রতিবাদী তরুণরাই তো অতীতে আশার আলো জ্বালিয়েছে এবং ভবিষ্যতেও তারাই দেশবাসীর ভরসা; কিন্তু শিক্ষার্থীরা দেখলেন ক্ষমতাসীন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা যুক্তি ভুলে কত অবলীলায় মিথ্যা বলছেন, কুৎসা করছেন। রাস্তায় আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা, তারা নাকি আদু ভাই, দুই বাচ্চার মা, অছাত্র। শিক্ষার্থীরা লাল কার্ড দেখাল, তাদের আর নিজেদের প্রমাণপত্র ঝুলিয়ে রাখল গলায়।

কেন্দ্রীয় সদস্য, বাসদ


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //