উন্নয়ন, উন্নতি ও রাজনীতি

আমাদের দেশে রাজনীতিকে উন্নয়নের অন্তরায় ভাবা হয় এবং এজন্য উন্নয়নবিদেরা রাজনীতিকে ক্রমাগত নানাভাবে আক্রমণ করে আসছেন। এই আক্রমণের মোকাবিলা করে রাজনীতিবিদেরা রাজনীতির মান উন্নত করতে পারছেন না।

রাজনীতির নিম্নগামিতার, দুর্বলতার ও রুগ্নদশার সুযোগ নিয়ে পরাশক্তি বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে অভিহিত করছে। বাস্তবে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণমূলক সব ব্যাপারে পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদীদের কর্তৃত্ব অব্যাহত গতিতে বাড়ছে। উন্নয়নের নামে বাইরের আধিপত্যবাদীরা অবাধে হস্তক্ষেপ করে চলছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সব ব্যাপারে। আর উন্নয়নের স্বরূপ সম্পর্কেও প্রচার করা হচ্ছে বিভ্রান্তিকর সব ধারণা। 

দরকার রাজনীতির মান উন্নত করা। দরকার গতানুগাতিক পতনশীল রাজনীতির জায়গায় সর্বজনীন কল্যাণের নতুন রাজনীতি। বৃহৎ শক্তিবর্গ এবং তাদের অনুসারী সিভিল সোসাইটিসমূহ রাজনীতি নিয়ে টকশোতে যেসব কথা বলেন এবং দৈনিক পত্রিকায় যেসব উপ-সম্পাদকীয় লেখেন, সেগুলো দ্বারা তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে গতানুগতিক পতনশীল রাজনীতিকেই অব্যাহত রাখতে।

আমাদের উপলব্ধি করা দরকার যে, ‘উন্নতি’ আর ‘উন্নয়ন’ এক নয়। উন্নতির ধারণা আমাদের নিজেদের, আর উন্নয়নের ধারণা বৃহৎ শক্তিবর্গ কর্তৃক আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। উন্নতির ধারণার মধ্যে বৃদ্ধির সঙ্গে কল্যাণের ধারণাও যুক্ত। উন্নতি মানে কল্যাণকর বৃদ্ধি। উন্নয়ন সর্বাঙ্গীন ব্যাপার। বাংলাদেশ উন্নতি করেছে- বললে বোঝায়, বাংলাদেশ তার রাজনীতি ও প্রশাসনকে সামঞ্জপূর্ণ, অধিকতর কার্যকর ও জনগণের জন্য কল্যাণকর করেছে, জনগণের সঙ্গে শাসকদের সম্পর্ক সহযোগিতা ভিত্তিক করেছে। মোট জাতীয় আয় বাড়িয়েছে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়েছে। দেশব্যাপী জনগণের পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে সামাজিক ন্যায়, সম্প্রীতি ও সংহতি বাড়িয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং শিক্ষা-দীক্ষা বাড়িয়েছে। পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সম্মানজনক অবস্থান লাভ করেছে। জনজীবনের সমস্যাবলী সমাধানে সফল হচ্ছে এবং সব ক্ষেত্রে তার বৃদ্ধির, অর্জনের ও কল্যাণের সম্ভাবনা বিকাশশীল আছে। উন্নতি অংশিকও হতে পারে, তবে তাতে সর্বাঙ্গীনতার প্রবণতা থাকে। উন্নতি কথাটির আওতায় রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় জীবনের সব কিছু এসে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে উন্নতির স্থলাভিষিক্ত করা হয় উন্নয়নকে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, উন্নয়ন ছাড়া আমাদের চলে না। আমরা আমাদের স্বকীয় ধারণাকে বিকাশশীল ও কার্যকর রাখার, কিংবা কালের পরির্বতনের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের প্রয়োজনে নতুন ধারণা উদ্ভাবনের কথা ভাবিনি। উন্নতির কোনো সূচক আমরা নির্ণয় করিনি। আমরা গ্রহণ করে নিয়েছি আমাদের নিয়ে অন্যদের প্রয়োজনে, অন্যদের দ্বারা উদ্ভাবিত ও অন্যদের দ্বারা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সব ধারণা। আমরা ব্যবহৃত হচ্ছি অন্যদের উদ্দেশ্য সাধনের কাজে। আমরা আত্মশক্তি হারাতে হারাতে পরের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। আর বাংলাদেশ বর্তমান সমস্যাসঙ্কুল অবস্থায় পৌঁছেছে।

উন্নয়নের বেলায় বাস্তবের সঙ্গে তত্ত্বীয় ধারণার মিল নেই। যা প্রচার করা হয় প্রকৃত পক্ষে তার কমই করা হয়। উন্নতি ও উন্নয়নে অনেক পার্থক্য। উন্নতি মানে উপরে ওঠা, আর উন্নয়ন হল উপরে তোলা। উন্নতি নিজের বুদ্ধিতে, নিজের শক্তিতে নিজেকে করতে হয়। তাতে অন্যের সহায়তা যতটা সম্ভব, নিজের স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব বজায় রেখে, নিজেকে নিতে হয়। আর উন্নয়ন পরনির্ভর। বিশ্বব্যাংক, আর্ন্তজাতিক অর্থ তহবিল এবং ধনী রাষ্ট্রসমূহের অর্থ লগ্নিকারী বিভিন্ন সংস্থা ইত্যাদির কূটনীতি ও সুদের ব্যবসার সঙ্গে গরিব রাষ্ট্রসমূহের উন্নয়ন সম্পূর্ণ শর্তাবদ্ধ। আর্ন্তজাতিক সুদের ব্যবসাদাররা এখন দাতাসংস্থা (doner agency) ও উন্নয়ন সহযোগী (development partner) নাম নিয়ে দুর্বল রাষ্ট্রসমূহের রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ইত্যাদি সব কিছুর উপর কর্তৃত্ব নিয়ে নিচ্ছে। যে মূল নীতি অনুযায়ী তারা ঋণ দেয় তা হল : আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতি ‘(Dominance and Dependence) বর্তমানে আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা নীতির প্রয়োগ যেভাবে করা হচ্ছে তাতে দুর্বল রাষ্ট্রগুলো আরো দুর্বল হচ্ছে এবং দ্রুত স্বাধীনতা হারাচ্ছে। স্বাধীনতা হারালে নিজের দেহ মনের উপর নিজের কর্তৃত্ব থাকে না। রাজনীতিও ক্রমেই বেশি করে পরিচালিত হয় বিদেশী অর্থ লগ্নিকারীদের দ্বারা। 

মানবোন্নয়নের নামে শিক্ষার ও স্বাস্থ্য সেবার বৃদ্ধি বোঝানো হয়। তাতেও উন্নতির সার্বিকতা বিবেচনা করা হয় না। মানব সম্পদ উন্নয়ন (Human Resource Development) কথাটির অর্থ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, কথিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদেরকে পণ্য গণ্য করা হয়। শক্তিশালী লোকেরা তাদের অভিলাষ সফল করার জন্য দুর্বল লোকদেরকে পরিণত করেছে মুনাফার পণ্যে। এই মনোবৃত্তিরই প্রকাশ আছে মানব পুঁজি (Human Capital) কথাটির মধ্যেও। মানবসম্পদে রফতানি করছে গরিব তথা দুর্বল রাষ্ট্র, আর আমদানি করেছে ধনী তথা শাক্তিশালী রাষ্ট্র। শক্তিশালী রাষ্ট্রের লোকেরা তাদের রাষ্ট্রে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজগুলো করাচ্ছে দুর্বল রাষ্ট্র থেকে মানুষ আমদানি করে তাদের দিয়ে। মানব উন্নয়ন বলে মানুষকে গড়ে তোলার যে আয়োজন, তারও উদ্দেশ্য এক শ্রেণির মানুষের উদ্দেশ্য সাধনের বা স্বার্থ হাসিলের যন্ত্ররূপে কিংবা পণ্য রূপে আর এক শ্রেণির মানুষকে ব্যবহার করা। বিশ্ব পরিসরে যারা শক্তিশালী ও কর্তৃত্বশীল তারা তাদের প্রয়োজনে বিকাশ ঘটিয়েছে এসব তত্ত্ব ও কর্মধারা। 

শোষিত- বঞ্চিত-নির্জিত মানুষ শক্তিশালী হতে পারে নিজেদের নেতৃত্ব সৃষ্টি করে সেই নেতৃত্বের পরিচালনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে। ঐক্যবদ্ধ না হয়ে দুর্বল থাকা অন্যায়। কেবল উন্নয়ন নিয়ে বাংলাদেশে আমরা পরিপূর্ণ মানুষ হতে পারছি না। মানুষ হিসেবে আমাদের অপূর্ণতার অন্ত নেই। আমরা ক্রমাগত মানবীয় গুণাবলী হারিয়ে চলছি। এ অবস্থায় উন্নতি ব্যাপারটিকে আমাদের পরিপূর্ণ গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের বুঝতে হবে প্রগতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অর্থ। আমাদের চলতে হবে প্রগতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারায়। প্রগতি, সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারা এখন আমাদের নেই। সব কিছু বিকারপ্রাপ্ত ও বিবর্ণ। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল এই ভূ-ভাগে এবং ষোল কোটি মানুষের জীবনে অপার সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনা আমাদের খুজতে হবে। আত্মবিক্রয় না করে আত্মশক্তি অবলম্বন করে চলতে হবে।

আমাদের উঠতে হলে ওঠার মতো রাজনীতি ও নেতৃত্ব লাগবে। বর্তমানে রাজনীতির ও নেতৃত্বের যে অবস্থা তা নিয়ে আমরা কোনো দিনই উঠতে পারব না। মার্কসবাদ এখন আর মানুষকে আকর্ষণ করে না। শ্রমিকরা পৃথিবীর কোথাও আর কমিউনিস্ট পার্টির ইশতিহারে বর্ণিত চরিত্র নিয়ে নেই। বাস্তবতা আমূল বদলে গেছে। এই সকল বিষয়ে বিবেচনা করে করণীয় নির্ধারণ করে কাজ করতে হবে। ভুল রাজনীতি নিয়ে যতই কাজ করা হোক, কোনো সুফল হবে না। বাংলাদেশে রাজনীতি যতই খারাপ হোক, এই রাজনীতির ধ্বংসাত্মক, নির্দয়, সহানুভূতিহীন সমালোচনায় আমরা কখনও উৎসাহ বোধ করি না। আমরা স্বদেশী রাজনীতির উন্নতি কামনা করি। স্বদেশী রাজনীতি শেষ হয়ে গেলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ পরাধীন হয়ে যাবে। আমাদের অস্তিত্ব ও সমৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে- রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করতে হবে।

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //